আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ

আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম, যিনি শহীদ জুয়েল নামে সর্বাধিক পরিচিত, (জন্ম: ১৮ জানুয়ারি ১৯৫০ - মৃত্যু: ৩১ আগস্ট, ১৯৭১) ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়া গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ক্রিকেটার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। [১] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ঢাকার কিংবদন্তিতুল্য ক্র্যাক প্লাটুন এর সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা তাকে আটক করে। ধারণা করা হয় ৩১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা ক্রিকেটার জুয়েলকে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। [২]

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

জুয়েলের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি তার পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকশা গ্রামে। তার বাবার আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী এবং মা ফিরোজা বেগম। রাজধানী ঢাকার টিকাটুলির ৬/১ কে এম দাস লেনেও তার বাবার বাড়ি ছিল, সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালে জুয়েল ঢাকার জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ক্রিকেটার জীবন[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের পূর্বে শহীদ জুয়েল ঘরোয়া লীগে আজাদ বয়েজে ও মোহামেডান ক্লাবে খেলেছেন। আজাদ বয়েজ ক্লাবের আক্রমণাত্মক ওপেনার ছিলেন শহীদ জুয়েল।[৩] উইকেটকিপার হিসেবেও আলাদা অবস্থান ছিল তার। ১৯৬৯ সালে তিনি মোহামেডানে যোগ দেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ ক্লাব। তিনি ঢাকা, ইস্ট পাকিস্তান ও ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে প্রথম শ্রেণীর সাতটি ম্যাচ খেলেন।

১৯৬৬ সালের ২১ মে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জুয়েলের অভিষেক হয়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আইয়ুব ট্রফিতে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের বিপক্ষে ঢাকার হয়ে তিন দিনের ম্যাচ খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৩৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ রান করেন। তার ৩৮ ছিল দুই দলের মধ্যে সর্বাধিক রানের ইনিংস। ম্যাচটি ড্র হয়।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর হায়দরাবাদের নিয়াজ স্টেডিয়ামে কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে হায়দরাবাদ, খায়েরপুর ও কোয়েটার বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচে তিনি ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৪ করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯ রান করেন। এ ম্যাচে ইস্ট পাকিস্তান ৫ উইকেটে জয়ী হয়।

১৯৬৯ সালের ২২ আগস্ট করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খেলেন করাচি হোয়াইট-এর বিপক্ষে। কায়দ-ই-আজম ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়।

একই টুর্নামেন্টে ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খায়েরপুরের বিপক্ষে খেলেন। তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১৫ রান করেন। ইস্ট পাকিস্তান এ ম্যাচে ইনিংস ও ৫ রানে জয়ী হয়।

১৯৬৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে হায়দরাবাদ হোয়াইট-এর বিপক্ষে তিনি খেলেন। তিন দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ রান করে। ইস্ট পাকিস্তান এ ম্যাচে ১৩৫ রানে জয়ী হয়।

১৯৭১ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিপি ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে খেলেন। প্রথম ইনিংস ৪৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫ রান করেন। এটি ছিল তার সেরা পারফরম্যান্স। ম্যাচটি ড্র হয়।

২৬ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে একই টুর্নামেন্টে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিপক্ষে খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৪ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রানে অপরাজিত থাকেন। তিন দিনের ম্যাচটি ড্র হয়।

সাতটি ম্যাচ খেলে তিনি ২১ দশমিক ৫৮ গড়ে ২৫৯ রান করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ক্রিকেটারদের পক্ষে এই রান ছিল উল্লেখযোগ্য।

জুয়েল জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছেন। ১৯৭০ সালের ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের হয়ে ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের বিপক্ষে খেলেন। তিন দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৫ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়। ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে তিনি লাহোর দলের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচ খেলেন। তিন দিনের ফাইনালে প্রথম ম্যাচে ২৩ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়।

১৯৭০-৭১ মৌসুমে ক্রিকেট লিগে তিনি দুর্দান্ত খেলেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বড় স্কোর গড়েন। কারদার সামার ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেন। কিন্তু তারপরও তার মূল্যায়ন যথাযথভাবে করা হয়নি। তবে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান দলেও ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। তন্মধ্যে যে ক’জন বাঙালি পূর্ব পাকিস্তান দলে স্থান করে নেন, তিনি তাদের একজন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সফরে আসে নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দল। এ সফরে কিউইরা তিনটি টেস্ট খেলে। এ সিরিজে খেলার জন্য জুয়েল পাকিস্তান ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল দলে তিনি সুযোগ পাননি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষ দিকে ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে যান শহীদ জুয়েল। সেখানে তাকে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্ল্যাটুনে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসে গেরিলা অপারেশন শুরু করেন। ফার্মগেট ছাড়াও এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

ভারতের মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টার অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলাদা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সব ঘাড়ত্যাড়াগুলোর আখড়াও ছিল বলা যায়। এর মূল কারণ হলো তারুণ্যনির্ভর শক্তি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে সেখানে কঠোর প্রশিক্ষণ হতো। সেখান থেকে বিভিন্ন অপারেশন নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এই বাংলাদেশে আসতে হতো। মেলাঘরের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন তৎকালীন সময়ের একেবারে তরুণ প্রজন্ম। সবকিছুর মধ্যে একটা দল নজর কেড়েছিল আলাদাভাবে। মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে কে ফোর্সের সদস্যদের কথা বলা হচ্ছে। শহীদ রুমি, বদি, আজাদ ও বিখ্যাত ক্রিকেটার জুয়েলসহ আরও অনেকে ছিল এই দলে। তাদেরকে শেখানোই হতো, কীভাবে দ্রুত অপারেশন করে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাওয়া যায়। অনেকটা কমান্ডো আর গেরিলার মিশেল আরকি। কেউ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র, কেউ বা কেবলই বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করেছে, কারো নতুন চাকরি, আবার কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতো, কিন্তু দেশের ডাকে আর হয়ে ওঠেনি। কে ফোর্সের সদস্যদের বয়সের পারদ ছিল এমনই।

কে ফোর্সের প্রথম অপারেশনের জায়গা ছিল ঢাকাতেই। মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক আক্রমণের জন্যই তাদের তৈরি করা হয়েছিল। গোপনে পুরো একটা দল যখন ঢাকায় ঢুকলো, তখন কেবলই অপেক্ষার ঘুণে সময় কেটেছে তাদের। প্রতীক্ষা, কখন দলপতি খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে অপারেশনের বার্তা আসবে। বার্তা এলোও, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশেপাশে খানিকটা গোলাগুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে, এটুকুই কাজ। কারণ সেখানে আসছে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল। উদ্দেশ্য, ঢাকার অবস্থা বুঝে প্রতিবেদন পেশ করা। পাকিস্তান সরকার তাদের সেনাবাহিনী বিশেষভাবেই তৈরি করে রেখেছে, যেন কোনোরকম গণ্ডগোল না হতে পারে। যেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল বুঝতে পারে, এখানে কিছুই নেই। কে ফোর্সের ছোট্ট এই দলের কাছে যে বার্তা এলো, বাস্তবায়ন হয়েছিল তার চেয়েও বেশি কিছু। হোটেলের আশেপাশে নয়, তারা হোটেলের ভেতরে গিয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে এসেছিল সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়েই। টের পাইয়ে দিয়েছিলো, এখানে আসলেই কিছু হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে হচ্ছে। পুরো ঢাকা তটস্থ করে দিয়েছিল ছেলেগুলো। আর খালেদ মোশাররফ? অবাক হয়ে কেবল বলেছিলেন, "হোটেলের আশেপাশে গোলাগুলি করতে বললাম, এরা হোটেলের ভিতরে গিয়ে গ্রেনেড ফাটিয়ে এলো! দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল!" সেই থেকে কে ফোর্সের নাম হয়ে গেলো ক্র্যাকপ্লাটুন। ঢাকার স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল 'বিচ্ছুবাহিনী' নামে। পুরো ৯ মাসে শত শত সফল অপারেশন চালিয়েছে তারা। এই ক্র্যাক কিংবা বিচ্ছুদের একজন ছিলেন জুয়েল। পরাধীন বাংলার অন্যতম সেরা ওপেনার, সঙ্গে উইকেটকিপিং। জুয়েল হতে পারতেন লাল-সবুজ বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক, অন্তত সেই স্বপ্ন তিনি দেখতেন। যুদ্ধে প্রথমবার আহত হওয়ার পর, হয়তো বা পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে শেষ পর্যন্ত প্রাণ থাকা অবস্থাতেও স্বপ্নটা দেখতেন।

এ কথা মিথ্যে নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ কী তা বুঝে উঠতে একটু সময় লেগেছিল সাধারণ মানুষের। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কারেন্ট জাল থেকে সবাই বের হতে চাইতো বটে, রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীদের স্বপক্ষে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আলাদা একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নও দেখতো তারা। কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রথম প্রতিক্রিয়াটা এসেছিলো ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের কাছ থেকেই।

'৬০ এর দশকে অনেক বাঙালি ক্রিকেটার পাকিস্তানের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দাপুটে সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সালমান কবির, রকিবুল হাসান, দৌলাত-উজ-জামান ও শহীদ জুয়েল। পাকিস্তানের সেরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কায়েদ-ই-আজম তখন এই পূর্ব পাকিস্তানেও অনুষ্ঠিত হতো, ঢাকা স্টেডিয়াম ছিল নিয়মিত ভেন্যু। ১৯৭১ সালের মৌসুমে ৯ মার্চ থেকে টুর্নামেন্টের ম্যাচ গড়ানোর কথা ছিল। চতুর্থ গ্রুপে পশ্চিম পাকিস্তানের পিআইএ, পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলা ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এই দুই দল মাঠেই নামেনি। পিআইএ ওয়াক ওভার পেয়ে যায় এ কারণে। মূলত ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পশ্চিম পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে অনেকটা ‘প্রথম’ প্রতিরোধ ও চলমান আন্দোলনের পক্ষে ম্যাচ বয়কট করে এই দুই দল।

এরপর ২৫ মার্চ কালোরাতে যখন গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, তারপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পরের গল্পটা সবার জানা।

যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, জুয়েল তখন নিজের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে ছিলেন। তরুণ এই ক্রিকেটার আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, জিতেছেন ঢাকা লিগ। যে 'মোশতাক ভাই'-এর হাত ধরে আজাদ বয়েজ ক্লাবের শুরু, সেই মোশতাক ভাইয়ের সঙ্গে জুয়েলের ছিল আপ্রাণ সম্পর্ক। কিন্তু ২৭ মার্চ যখন মোশতাক ভাইয়ের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত দেহটা জেলা ক্রীড়া পরিষদের মূল ভবনের সামনে খুঁজে পেলেন জুয়েল, তখন আর নিজেকে থামাতে পারেননি তিনি। ক্রিকেট ব্যাট আর কিপিং গ্লাভস খুলে রেখে হাতে তুলে নিয়েছেন স্টেনগান। মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থানে জুয়েল ও তার সহ গেরিলারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। জুয়েলের যুদ্ধে যাওয়ার লড়াইটাও সহজ ছিল না। পিতৃহীন ছেলেটাকে ছাড়তে চাননি মা। চাননি চোখের আড়াল করতে। তাই জুয়েল একদিন নিজের একটা ছবি বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর মাকে বললেন, "আমাকে মনে পড়লে এইটা দেখবা, আমারে দেখবা।" ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরই বাসা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যান জুয়েল। কিন্তু যুদ্ধে গিয়েও তার ধ্যানেজ্ঞানে ছিল শুধুই ক্রিকেট। বলা যায়, স্বাধীন বাংলার ক্রিকেট। একবার ক্র্যাকপ্লাটুনের উপর সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো। তারই ধারাবাহিকতায় এক রাতে জায়গাটা রেকি করতে বের হলেন বদি, আজাদ, জুয়েলসহ মোট ১০ জন যোদ্ধা। বাড্ডার পিরুলিয়া গ্রাম থেকে নৌকায় যাত্রা করার পর বেশ কিছুদূর গিয়ে সবাই টের পেলেন, সামনে থেকে আরেকটা নৌকা আসছে। আর সেটা পাকিস্তানি আর্মিতে ভরা। একমাত্র বদি ছাড়া সবার স্টেনগান ছিল নৌকার পাটাতনের নিচে। সেটা বুঝতে পেরেই বদি কোনো কিছু না ভেবেই সমানে ব্রাশফায়ার চালিয়ে দিলেন সামনের নৌকার দিকে। হানাদার অনেকে মরলো, নৌকা উল্টে গেল; কয়েকজন হয়তো বেঁচেছিলো সাঁতরে। ওদের পক্ষ থেকেও গুলি ছোঁড়া হয়েছিলো। যে কারণে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর জুয়েল হঠাৎ অন্ধকার থেকে বলে উঠলেন, "আমার হাতে যেন কী হইছে!" টর্চের আলোয়  দেখা গেল, পাক হানাদারদের ছোঁড়া গুলি জুয়েলের আঙুল ভেদ করে চলে গেছে। সেই অবস্থাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ডা. আজিজুর রহমানের চেম্বারে। যাওয়ার পথে সহযোদ্ধা আজাদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "জুয়েল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না?" মুখে একচিলতে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে জুয়েল বলেছিলেন, "নাহ, হেভি আরাম লাগতেছে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়াও হইলো, আবার জানটাও বাঁচলো।" অভিজ্ঞ ডাক্তার আজিজুর রহমান জুয়েলের হাতের অবস্থা দেখে সেদিন চমকে উঠেছিলেন। আঙুলের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিলো না কোনোমতেই। ড্রেসিং করতে গিয়ে অবস্থা আরও বেগতিক। জুয়েল দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলছিলেন, "প্লিজ স্যার, আমার আঙুল তিনটা রাইখেন। দেশ স্বাধীন হলে আমি ওপেনিং নামবো, স্বাধীন বাংলার ক্যাপ্টেন হবো।"

মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে জুয়েল আহত হওয়ার আর অপারেশনে নামা হয়নি জুয়েলের। থাকতেন সহযোদ্ধা আজাদের বাড়িতে।সেখানেই একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় ২৯ আগস্ট দিবাগত রাতে, অর্থাৎ ৩০ আগস্ট হামলা চালিয়ে আটক করে ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায় জুয়েল ও তার সহযোদ্ধাদের। অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে সহযোদ্ধাদের সব তথ্য তার কাছ থেকে আদায় করতে চেয়েছিলো শত্রুরা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের মতোই মাটি কামড়ে সেদিন দেশের জন্য ব্যাট করে গেছেন জুয়েল। পাক হানাদাররা শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছিলো জুয়েলকে। স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ব্যাট হাতে আর মাঠে নামতে পারেননি বীর জুয়েল। বাংলাদেশের ক্রিকেট তাকে মনে রেখেছে। 'হোম অব ক্রিকেট'খ্যাত মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের 'জুয়েল স্ট্যান্ড' তারই নামানুসারে করা। আর আজাদ বয়েজ ক্লাবের সেই মোশতাক ভাইয়ের নামে 'মোশতাক স্ট্যান্ড'। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে তাদের স্মরণে সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ জুয়েল-শহীদ মোশতাক স্মৃতি প্রীতি ম্যাচ।

যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন বাংলার মৃত্তিকায়, বাংলার আকাশে-বাতাসে শহীদ জুয়েল অনন্য উজ্জ্বলতায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন নিঃসন্দেহে।[৪]

সম্মাননা[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদানের ঘোষণা দেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার জুয়েলকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৮। ১৯৯৭ সালে "জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার (মরণোত্ত, ক্রিকেট) প্রদান করা হয়।

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  1. বাংলাদেশ

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

বহি:সংযোগ[সম্পাদনা]

১৯৯৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার (মরণোত্ত, ক্রিকেট) প্রদান করা হয়।