বাঙালি হিন্দু বিবাহ
বঙ্গের সংস্কৃতি |
---|
বিষয় সম্পর্কিত ধারাবাহিক |
ইতিহাস |
বাঙালি হিন্দু বিবাহ বলতে সাধারণত বোঝানো হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা-সহ বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা প্রান্তে বসবাসকারী সনাতন হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে হওয়া শাস্ত্রীয় বিধি ও পারিবারিক ঐতিহ্যগত প্রথাসম্মত পবিত্র সামাজিক পরিণয়কে। উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত দু’টি আচার-উপাচারগত বিভাগ পরিলক্ষিত হয়। যথা— বৈদিক এবং লৌকিক। লৌকিক আচারসমূহ ‘স্ত্রী আচার’ নামে পরিচিত।[১] বৈদিক আচার অন্তর্ভুক্ত অবশ্যপালনীয় প্রথাগুলি হল: কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম।[১] বৈদিক আচারগুলির সঙ্গে লৌকিক আচারগুলির কোনও সম্পর্ক নেই।[১] লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক-এক প্রকারের হয় থাকে।[১] নিম্নবর্ণীয় হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই, বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়।[১]বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ আচার-রীতিকে সাধারণত দু’-ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে৷ যথা: ঘটি এবং বাঙাল আচার-অনুষ্ঠান৷
অতীতে বাঙালি হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ তথা দণ্ডনীয় অপরাধ। বর্তমানে পরিণত বয়সেই বিবাহ প্রথা প্রচলিত। তবে, বিবাহে পণপ্রথা এখনও বহুল প্রচলিত। যদিও পণপ্রথা নিবারণী আইন বলবৎ আছে।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি হিন্দুসমাজে বিবাহবিচ্ছেদ আইনসিদ্ধ হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। হিন্দু এই দুই প্রথা আজও সমাজের বৃহত্তর অংশে প্রচলিত নয়।[১] নাগরিক সমাজে অসবর্ণ বিবাহও বর্তমানে প্রচলিত হয়েছে। বাংলায় রেজিস্ট্রি ছাড়া প্রথম অসবর্ণ বিবাহ সম্পন্ন হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবীর কন্যা অপর্ণা দেবীর মধ্যে।
বিবাহ অনুষ্ঠান
[সম্পাদনা]ব্রাহ্মণ সমাজে পাঁচটি শাখা রয়েছে — রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও মধ্যশ্রেণী। কায়স্থ সমাজে রয়েছে চারটি শাখা — উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ।[১] এই সকল বর্ণ এবং তাদের শাখা ও উপশাখাগুলির মধ্যে বিবাহ প্রথায় দুটি বিভাগ দেখা যায় — বৈদিক ও লৌকিক।[১] লৌকিক প্রথাগুলি মেয়েলি আচার। এই কারণে এগুলি ‘স্ত্রী আচার’ নামে পরিচিত। বৈদিক আচারে সাম, যজুঃ ও ঋক্ বেদত্রয়ের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ প্রথায় আবার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।[১] হিন্দু বিবাহের বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অপরিহার্য হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম (লাজ বা খই দিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান), সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ (কন্যার পাণি অর্থাৎ হস্ত গ্রহণ), ধৃতিহোম (ধারণ করার অর্থাৎ কন্যাকে ধরে রাখার যজ্ঞ) ও চতুর্থী হোম।[১] এছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন, ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন, শিলারোহণ ইত্যাদি কয়েকটি বৈদিক প্রথাও।[১] বৈদিক প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ।
হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়।
বিবাহ পূর্ব আচার
[সম্পাদনা]পাটিপত্র
[সম্পাদনা]পাটিপত্র হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।[১][২]
পানখিল
[সম্পাদনা]পানখিল হিন্দু বিবাহের দ্বিতীয় আচার। এটি পাটিপত্রের ঠিক পরেই পালিত হয়। পানখিলের অর্থ পান পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খিল দেওয়া বা খড়কে বেঁধানো। এই আচারটি প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পানখিল আচারে বাড়ির মেয়েরা এবং প্রতিবেশিনীরা বিয়ের গান গেয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হল রাম ও সীতার বিবাহ।[১][৩]
আইবুড়ো ভাত
[সম্পাদনা]বিয়ের আগের দিনে আইবুড়ো ভাত অনুষ্ঠানটি ছেলে এবং মেয়ের বাড়িতে আলাদাভাবে করা হয় । এটি হল বিয়ের আগের শেষ অবিবাহিত অবস্থায় খাওয়া ।মেয়েদের বিয়ের পর নিজের পরিবারের সাথে আপেক্ষিক ভাবে সম্পর্ক শেষ হয়। সেদিক দিয়ে এটি তাদের বাপের বাড়িতে শেষ আনুষ্ঠানিক খাওয়া ।
দধি মঙ্গল
[সম্পাদনা]দধি মঙ্গল: বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্য্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিঁড়ে ও দই খাওয়ানো হয়।
গায়ে হলুদ
[সম্পাদনা]সংস্কৃত ভাষায় এই রীতিকে বলা হয় গাত্রহরিদ্রা। হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়। যেমন শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদি। প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ ছেলের বাড়ি থেকে একটি নতুন শাড়ি,গামছা এবং অন্যান্য জিনিসসহ পাঠানো হয়। কন্যার বাড়ি পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো ও স্নান করানো হয়।[৪]
শঙ্খ কঙ্কন
[সম্পাদনা]শঙ্খ কঙ্কন: কন্যাকে শাঁখা পরানো হয়। বিয়ের আগের দিন কন্যাকে শাঁখা পরানো হয়। বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বিয়ের প্রধান অনুষ্ঠান
[সম্পাদনা]বর যাত্রী
[সম্পাদনা]বর যাত্রী: বরের বাড়ির সদস্যদের পাশাপাশি তার বন্ধুরা তাদের ভালো পোষাক পরে এবং কনের বাড়িতে যাত্রা করে যেখানে বিয়ে হবে। বরকে কনে পক্ষ থেকে একটি গাড়ি পাঠানো হয়। এতে বর সাথে একজন কনে পক্ষের লোক, তার নিজের বাবা (বরকর্তা), পাশাপাশি তার পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যকে নিতবর (মিতবর) সাজিয়ে নিয়ে চলে (নিতবর অনেকটা পশ্চিমা ঐতিহ্যের "বেস্ট ম্যান" এর মতো)। বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার আগে বরকে তার মা আশীর্বাদ করেন এবং বর আনুষ্ঠানিকভাবে শীঘ্রই তার "অর্ধাঙ্গী"কে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার অনুমতি চান।
বর বরণ
[সম্পাদনা]বর বরণ: বর বিবাহ করতে এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষ। সাধাবনত: কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান দুর্বা অন্যান্য বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। এরপর বরকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয় ।
পট্টবস্ত্র
[সম্পাদনা]পট্টবস্ত্র:বরকে ছাদনাতলায় (বিয়ের বেদি ও ছাউনি) বসানো হয়। ছাদনাতলাতে কেবল বর, কনে এবং পুরোহিত বসে। বরকে সেই ব্যক্তির দ্বারা নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় যিনি সম্প্রদান করতে চান। পরিবারের প্রবীণ পুরুষ সদস্য যিনি সম্প্রদান করেন তিনি কনের দায়িত্ব বরকে প্রদান করেন।
সাত পাক
[সম্পাদনা]সাত পাক: বিবাহের মণ্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়। সাধারণত: কন্যার বিবাহিত বন্ধুরা পিঁড়ি ধরে থাকে। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়। স্বামী-স্ত্রী ৭টি পাকে ৭টি প্রতিশ্রুতি দেয়-
প্রথম পাকে ভবিষ্যতের সন্তানদের যত্ন নেওয়ার অঙ্গীকার নেন।
দ্বিতীয় পাকে স্ত্রী-কে সমস্ত রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেন।
তৃতীয় পাকে পরিবারে উন্নতির জন্য অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দেন।
চতুর্থ পাকে পরিবারের কল্যাণের ভার স্ত্রীর হতে অর্পন করেন।
পঞ্চম পাকে স্বামীর প্রতি বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি নেন।
ষষ্ট পাকে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস রাখার প্রতিশ্রুতি নেন।
সপ্তম পাকে স্বামী ও স্ত্রী বন্ধু থাকার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হন।[৫]
শুভদৃষ্টি
[সম্পাদনা]শুভদৃষ্টি: বিবাহের মন্ডপে জনসমক্ষে বর ও কন্যা একে অপরের দিকে চেয়ে দেখেন।
মালা বদল
[সম্পাদনা]মালা বদল: কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। মুসলমান মতে একই ভাবে কন্যাকে বলতে হয় "কবুল"। আবার ঠিক এই রকমই খৃষ্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সম্মতি জানান।
সম্প্রদান
[সম্পাদনা]সম্প্রদান: কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলেন। বিবাহের মন্ত্র হল
" যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।"
যজ্ঞ
[সম্পাদনা]যজ্ঞ: বর -কনে পবিত্র অগ্নির সামনে বসে পুরোহিতের সাথে মন্ত্র জপ করেন। অগ্নিদেবকে বিয়ের ঐশ্বরিক সাক্ষী করা হয়।
সপ্তপদী
[সম্পাদনা]সপ্তপদী গমন:বাঙালি হিন্দু বিবাহের সপ্তপদী ভারতের অন্যান্য অনেক অঞ্চলের জনপ্রিয় "ফেরে"র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতে ধারাবাহিকভাবে সাতটি পান পাতা রাখা হয়। এই পাতার উপর কনে একের পর এক বরকে অনুসরণ করে পা ফেলে। বর এগিয়ে যাওয়ার সময় তার পা দিয়ে একটি বিশেষ পাথর "নোড়া"কে (সাধারণত মসলা গুঁড়ো করা ও বাটার জন্য ব্যবহৃত হয়) সরায়।[৬]
অঞ্জলি
[সম্পাদনা]অঞ্জলি / লাজহোম : কন্যা ও বর খৈ অগ্নাহুতি দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খৈ পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম।
সিঁদুর দান
[সম্পাদনা]সিঁদুর দান ও ঘোমটা: বিবাহের মূল অনুষ্ঠানের শেষ রীতি অনুসারে বর কন্যার সিঁথিতে সিঁদুর লেপন করেন। বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন। সিঁদুর দানের সময় কনের মাথা বরের পরিবারের দেওয়া নতুন শাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে। এটিকে ঘোমটা বা "লজ্জা বস্ত্র " বলা হয়।
বিবাহোত্তর আচার
[সম্পাদনা]কনকাঞ্জলি
কনকাঞ্জলি : এটি কনের বিদায় অনুষ্ঠান । যা আনন্দ এবং দুঃখের মিশ্র মুহূর্ত। কারণ এতে নববধূ তার পিতা -মাতা এবং আত্মীয়দের আশীর্বাদ নিয়ে বিদায় নেয় তার স্বামীর সাথে নতুন জীবন শুরু করার জন্য। নববধূকে কিছু চাল দরজার দিকে পিছনে তাঁর মায়ের শাড়ির আঁচলে তিনবার ফেলতে হয় ও বলতে হয়। কারন নারী হল লক্ষ্মী স্বরূপা ঠিক তেমনি চাল ও লক্ষ্মী স্বরূপা। যেহেতু বাবার বাড়ি থেকে লক্ষ্ণী শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে সেহেতু চাল সমতুল্য লক্ষীকে বাবার বাড়ি দিয়ে যায় ।[৭]
বধূ বরণ
বধূ বরণ: কনে বরের বাড়িতে পৌঁছলে এটি করা হয়। একটি থালা আলতা এবং দুধ দিয়ে পূর্ণ করে নানা উপকরণে নববধূকে বরণ করা হয় । নববধূ এতে পা রাখে ও শাশুড়ির বরণ করে নেওয়ার পর বরের সাথে গৃহপ্রবেশ করে।
কাল রাত্রি
কাল রাত্রি: কনে বরের বাড়িতে পৌঁছানোর পরে এবং প্রাথমিক স্বাগত অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তারা সেই রাতের জন্য আলাদা হয়ে ঘুমায় একটি সতেজ ঘুম পেতে এবং পরের দিনের চূড়ান্ত বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিতে।
বৌভাত
বৌভাত: নববধূ রান্না করেন এবং তার স্বামীর পরিবারের সকল সদস্যদের পরিবেশন করেন। স্বামীকে নববধূকে একটি শাড়ি উপহার দিতে হবে এবং কনের মৌলিক চাহিদার দায়িত্ব নেওয়ার শপথ নিতে হবে ("ভাত কাপড়" - আক্ষরিক অর্থে খাদ্য ও পোশাক)। নতুন বধূকে উপহার দেওয়া অতিথিদের জন্য একটি ভোজের আয়োজন করা হয়।
ফুলশয্যা
ফুলশয্যা: দম্পতিদের বিছানা ফুল দিয়ে সজ্জিত করে তাদের ঘরে একঘরে রেখে দেওয়া হয়।
হিন্দু আইন
[সম্পাদনা]হিন্দুশাস্ত্রমতে, বিয়ে শুধুই চুক্তি নয়, বরং একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। হিন্দু আইন মূলত হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন। শাস্ত্রানুযায়ী পুরুষদের অবশ্য পালনীয় ১০টি ধর্মীয় কর্তব্যের (Ten sacraments) অন্যতম হলো বিয়ে। হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে হলো, ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন। হিন্দু আইনানুযায়ী কনের বাবা-মা বরের হাতে কনেকে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেন। সনাতন হিন্দু আইনে কনের সম্মতি কিংবা অসম্মতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত নয় [যদিও পরাশর সংহিতা বা কিছু কিছু পুরাণেও নারীদের পুনর্বিবাহের বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান দেওয়া আছে :
"নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চরাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।"
কিন্তু এ বিধানের বহু অপব্যাখ্যা অতীতে করা হয়েছে বা "প্রক্ষিপ্ত" বলে নস্যাৎ করা হয়েছে],এমনকি ধর্ম পরিবর্তন, বর্ণচ্যুতি, ব্যভিচার কিংবা বেশ্যাবৃত্তিও বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে না। হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী যেহেতু বিয়ে কোনো চুক্তি নয়, তাই বিয়ের জন্য সাবালকত্ব বিবেচিত হয় না- এই নিয়ম সনাতন হিন্দু আইনে অনুসৃত এবং বাংলাদেশী হিন্দুগণ এই আইন মেনে চলেন। হিন্দু আইনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধান নেই। হিন্দু আইন অনুযায়ী একজন নপুংসকও বিয়ে করতে পারে। বাংলাদেশের হিন্দু আইনে বর্ণপ্রথা রয়েছে অর্থাৎ আইনগতভাবে বর-কনেকে অবশ্যই সমগোত্রীয় হতে হবে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে হিন্দু আইনে ‘বিধবা বিবাহ’ আইনসম্মতভাবে স্বীকৃত, তবে বাস্তবে এর প্রয়োগ সচরাচর দেখা যায় না। হিন্দু আইনানুযায়ী স্ত্রীর, স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে হবে, আর স্বামীকে তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে ও ভরণপোষণ দিতে হবে। বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা ‘হিন্দু ম্যারিড উইমেনস রাইট টু সেপারেট রেসিডেন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অ্যাক্ট ১৯৪৬’ অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে পৃথকভা বসবাস করার ও ভরণপোষণ পাবার অধিকার পান, যেমন: যদি স্বামী কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন এবং ঐ রোগ স্ত্রীর দ্বারা সংক্রমিত না হয়ে থাকে, কিংবা যদি স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং ঐ খারাপ ব্যবহার এমন হয় যে, তা স্ত্রীর জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়; কিংবা স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে বা পুনরায় বিয়ে করেন; কিংবা স্বামী যদি স্ত্রীকে তার সম্মতি ছাড়া ত্যাগ করেন; কিংবা স্বামী যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন অথবা অন্য কোনো আইনগত কারণে স্ত্রী পৃথকভাবে বসবাস ও ভরণপোষণ লাভ করার অধিকারী হন।[৮]
পার্থক্য
[সম্পাদনা]জাতিভেদে ও অঞ্চলভেদে এই রীতি কিছু পরিবর্তিত হয়। লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়।[১] নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়।
গ্যালারী
[সম্পাদনা]-
সিঁদুর দান
-
সিঁদুর দান
-
বাঙালি হিন্দু বিবাহের আচার
-
আশীর্বাদ অনুষ্ঠান
-
গায়ে হলুদ ও স্নান
-
তত্ত্ব.jpg
-
সিঁদুর দান এবং ঘোমটা
-
সিঁদুর দান এবং ঘোমটা
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ বাংলার লোক-সংস্কৃতি, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, ২০০৫ মুদ্রণ, পৃ. ৫৯-৬৩
- ↑ "বাঙালির বিয়ে উৎসব"। Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০২।
- ↑ চক্রবর্তী, শুভাশিস। "বিয়েতে হারিয়ে যাওয়া ছড়া-গানের লোকাচার"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০২।
- ↑ amadernotunshomoy.com (২০১৯-০৩-২৯)। "বাঙালি হিন্দু বিবাহ ও লৌকিক আচার"। Amadernotun Shomoy। ২০২১-০৯-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০২।
- ↑ AppsDreamers। "যে কারণে বিয়ের সময় সাত পাক ঘোরা অনিবার্য! সাত পাকের মাহাত্ম্য"। বাংলা পঞ্জিকা (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০২।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "Saptapadi in Bengali wedding."।
- ↑ "বিয়ের পর চাল দিয়ে ঋণ শোধ হয়, কিন্তু 'কনকাঞ্জলি'র আসল মর্মার্থ জানেন কি?"। Bangla। ২০১৯-১২-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০২।
- ↑ "হিন্দু পারিবারিক আইনের বিয়ে বিষয়ক বিধান"[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], শেখ সাদী রহমান; সাপ্তাহিক একুশে (অনলাইন), ২ আগস্ট ২০১০; পরিদর্শনের তারিখ: জানুয়ারি ২৬, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ। [অকার্যকর সংযোগ]