সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
জন্মআগস্ট ১৫ ১৯২২
ষোলশহর, চট্টগ্রাম
মৃত্যুঅক্টোবর ১০ ১৯৭১
প্যারিস, ফ্রান্স[১]
ছদ্মনামআবু শরিয়া [২]
পেশা
  • কূটনীতিবিদ
  • ঔপন্যাসিক
  • গল্পকার
  • কবি
  • সাহিত্য সমালোচক
ভাষাবাংলা, ইংরেজি, ফরাসি
জাতীয়তাবাংলাদেশ বাংলাদেশী
নাগরিকত্ববাংলাদেশী
সময়কালকল্লোল যুগ
ধরনঅস্তিত্ববাদ
উল্লেখযোগ্য রচনালালসালু (১৯৪৮)
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারপূর্ণ তালিকা
সক্রিয় বছর১৯২২-১৯৭১
দাম্পত্যসঙ্গীআজিজা মোসাম্মত নাসরিন (পূর্বের নাম: আন-মারি)
ওয়েবসাইট
www.syedwaliullah.com

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৫ আগস্ট ১৯২২ - ১০ অক্টোবর ১৯৭১) ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন কথাশিল্পী। কল্লোল যুগের ধারাবাহিকতায় তাঁর আবির্ভাব হলেও তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতায় পরিশ্রুত নতুন কথাসাহিত্য বলয়ের শিলান্যাস করেন। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরসূরি এই কথাসাহিত্যিক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করলেও বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিকতর বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে তার বাবা কলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিল। বাবা এমএ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড় মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতী হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং তার স্ত্রী (ওয়ালীউল্লাহর বড় মামী) ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক।

শিক্ষা[সম্পাদনা]

পারিবারিক পরিমণ্ডলের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনন ও রুচিতে প্রভাব ফেলেছিলো। পিতার বদলির চাকরির সুবাদে ওয়ালীউল্লাহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশ দেখার সুযোগ লাভ করেন।ওয়ালীউল্লাহর শিক্ষাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি একাধিক মাসিকপত্রে লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে জড়িত থাকার সূত্রে কর্মজীবনের বড় একটা সময় তিনি বিদেশে কাটান। ১৯৫৫ সালে তিনি ফরাসি আন মারী-র সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

ছাত্র অবস্থাতেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বাধ্য হয়ে নয়, স্বেচ্ছায়। তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সৈয়দ নসরুল্লাহ এমএ ও বিএ পাশ করেছিলেন। তার পক্ষেও খুব স্বাভাবিক ছিল এমএ পড়াটা। কিন্তু হয় নি। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় চাকরি নেন। এ বছর ২৬ জুন তার পিতা প্রয়াত হন। তার তিন মাস আগে, মার্চ মাসে, তার প্রথম গ্রন্থ গল্প সংকলন নয়নচারা প্রকাশিত হয়।

নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন ১৯৪১-৪২ সাল নাগাদ। এমন মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, তিনি ভবিষ্যতে লেখকবৃত্তি বেছে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরই তিনি দ্য স্টেটসম্যানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা চলে আসেন এবং সেপ্টেম্বরে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদকের চাকরি নেন। এ চাকরিতে কাজের ভার কম ছিল। লালসালু উপন্যাস[৩] লেখায় হাত দিলেন ঢাকার নিমতলীর বাসায়। পরের বছরই এ উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে কমরেড পাবলিশার্স।

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়ে ঢাকা ছাড়েন ১৯৫০ সালে। সেখান থেকে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হয়ে যান ১৯৫১ তে। অতঃপর একই পদে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বদলি হন ১৯৫২-র শেষের দিকে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে এলেন তথ্য অফিসার হিসেবে ঢাকাস্থ আঞ্চলিক তথ্য-অফিসে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় বদলি করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদাভিষিক্ত হয়ে, ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে, দেড় বছর পর পদটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে জাকার্তার পাকিস্তানি দূতাবাসে দ্বিতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হয়ে রয়ে গেলেন ১৯৫৮’র ডিসেম্বর অবধি। এরপর ক্রমান্বয়ে করাচি-লন্ডন-বন, বিভিন্ন পদে ও বিভিন্ন মেয়াদে। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে ফার্স্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হিসেবে যোগ দিলেন প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসে। একনাগাড়ে ছয় বছর ছিলেন তিনি এ শহরে। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল লালসালু উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ “লারব্র্ সা রাসিন” (L'arbre sans racines, অর্থাৎ শিকড়বিহীন গাছ)।

অত:পর দূতাবাসের চাকুরি ছেড়ে ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট ইউনেস্কোতে চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট পদে যোগ দেন। চাকুরিস্থল ছিল প্যারিস শহরে ইউনেস্কো’র সদরদপ্তরে। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোতে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অবসরগ্রহণের নিয়ম হিসাবে পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদে তাকে বদলি করে। তবে তিনি ইসলামাবাদে না গিয়ে প্যারিসেই থেকে গিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান[সম্পাদনা]

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রাজনীতিসম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চাকরিহীন, বেকার। তা সত্ত্বেও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করেছেন, সঙ্গতিতে যতোটুকু কুলোয় তদানুযায়ী টাকা পাঠিয়েছেন কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। তার সন্তানদের ধারণা, তাদের পিতার অকাল মৃত্যুর একটি কারণ দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা। তিনি যে স্বাধীন মাতৃভূমি দেখে যেতে পারেন নি সে বেদনা তার ঘনিষ্ঠ মহলের সকলেই বোধ করেছেন। তার ছাত্রজীবনের বন্ধু পরবর্তীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর সাত মাস পরে তার স্ত্রীকে এক আধা সরকারি সান্ত্বনাবার্তা পাঠিয়েছেন। তাতে লেখা ছিল,

ব্যক্তিগত জীবন[সম্পাদনা]

১৯৫৬ সালে আন্-মারির সাথে করাচিতে

তার ফরাসিনী স্ত্রীর নাম আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো। তাদের পরিচয় হয় সিডনিতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তখন পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত, অন্যদিকে আন্-মারি কর্মরত ছিলেন ফরাসি দূতাবাসে। দেড়-দু বছরের সখ্যতা ও ঘনিষ্টতা শেষাবধি বৈবাহিক বন্ধনের পরিণতি লাভ করে। ওয়ালীউল্লাহ তখন করাচিতে। সেখানেই ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। ধর্মান্তরিত বিদেশিনীর নাম হয় আজিজা মোসাম্মত নাসরিন। নবলব্ধ নামকে বিয়ের কাবিননামাতেই বিসর্জন দিয়েছিলেন দু-জনে। তাদের দু সন্তান। প্রথমে কন্যা সিমিন ওয়ালীউল্লাহ, তার পরে পুত্র ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

৪৯ বছর বয়সে, ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে ওয়ালীউল্লাহ পরলোকগমন করেন। গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু হয়। প্যারিসের উপকণ্ঠে তারা একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, সেখানেই ঘটনাটি ঘটে এবং ওখানেই সমাহিত করা হয় তাকে।

গ্রন্থতালিকা[সম্পাদনা]

উপন্যাস[সম্পাদনা]

ছোটগল্প সংগ্রহ[সম্পাদনা]

  • নয়নচারা (১৯৪৫)
    • নয়নচারা
    • জাহাজী
    • পরাজয়
    • মৃত্যুযাত্রা
    • খুনী
    • রক্ত
    • খণ্ড চাঁদের বক্রতায়
    • সেই পৃথিবী
  • দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫)
    • দুই তীর
    • "একটি তুলসী গাছের কাহিনী"
    • পাগড়ী
    • কেরায়া
    • নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা
    • গ্রীষ্মের ছুটি
    • মালেকা
    • স্তন
    • মতিনুদ্দির প্রেম

অগ্রন্থিত গল্পাবলি

  • সীমাহীন এক নিমেষে
  • চিরন্তন পৃথিবী
  • চৈত্র দিনের এক দ্বিপ্রহরে
  • ঝড়ো সন্ধ্যা
  • প্রাস্থনিক
  • পথ বেধে দিল
  • মানুষ
  • অনুবৃত্তি
  • সাত বোন পারুল
  • সাত বোন পারুল (দ্বিতীয় দফা)
  • ছায়া
  • দ্বীপ
  • প্রবল হাওয়া ও ঝাওগাছ
  • হোমেরা
  • স্থাবর
  • সপ্ন নেবে এসেছিল
  • ও আর তারা
  • সবুজ মাঠ
  • স্বগত
  • মানসিকতা
  • কালচার
  • সূর্যালোক
  • মাঝি
  • অবসর কাব্য
  • নকল
  • রক্ত ও আকাশ
  • মৃত্যু
  • সপ্নের অধ্যায়
  • সতীন
  • বংশের জের
  • নানির বাড়ির কেল্লা
  • না কান্দে বুবু।

নাটক[সম্পাদনা]

  • বহিপীর (১৯৬০)
  • উজানে মৃত্যু (১৯৬৩)
  • সুড়ঙ্গ (১৯৬৪)
  • তরঙ্গভঙ্গ (১৯৭১)

রচনাবলি[সম্পাদনা]

  • গল্পসমগ্র (১৯৭২)
  • সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌-রচনাবলি: ১ (সম্পা. সৈয়দ আকরাম হোসেন), ১৯৮৬; ঢাকা
  • সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌-রচনাবলি: ২ (সম্পা. সৈয়দ আকরাম হোসেন), ১৯৮৭; ঢাকা

পুরস্কার[সম্পাদনা]

পুরস্কারের তালিকা
পুরস্কার অনুষ্ঠানের তারিখ বিভাগ/শাখা কাজের শিরোনাম সূত্র
পেন পুরস্কার (দ্বিতীয় স্থান) ১৯৫৫ নাটক বহিপীর ঢাকা পেন ক্লাবের উদ্যোগে এক আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন
বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৬১ উপন্যাস লালসালু
একুশে পদক ১৯৮৩ সাহিত্য মরণোত্তর
আদমজী পুরস্কার ১৯৬৫ গল্প দুই তীর ও অন্যান্য গল্প
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০০১ শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার লালসালু

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. শফিউল আলম, [১], বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা
  2. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, [২], প্রথম আলো: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা
  3. Choudhury, Serajul Islam (২০০৫)। "Introduction" Tree Without Roots। Dhaka, Bangladesh: writers.ink। পৃষ্ঠা ix। আইএসবিএন 984-32-2546-5 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]