বিশ্ব শান্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রতীক, সাধারণভাবে বিশ্ব শান্তি প্রতীক বলা হয়।

বিশ্ব শান্তি বা বৈশ্বিক শান্তি বলতে সমগ্র বিশ্বের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যকার শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে বোঝায়। এটি সমগ্র বিশ্বের মধ্যেও হতে পারে আবার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেও হতে পারে।

বিভিন্ন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনের মানবাধিকার, প্রযুক্তি, শিক্ষা, প্রকৌশল বা কূটনীতির মাধ্যমে সব ধরনের যুদ্ধের অবসান হিসেবে ব্যবহৃত বিশ্ব শান্তি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য (চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কোনো প্রকার যুদ্ধ বা উত্তেজনা ছাড়াই পারস্পরিক ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব সমাধানের অঙ্গীকার করেছে। তা সত্ত্বেও, দেশগুলো তখন থেকে অসংখ্য সামরিক সংঘাতে প্রবেশ করেছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ফলস্বরূপ জন্ম হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের। এটি ছিল এমন একটা বৈশ্বিক সংস্থা যাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্য শান্তি, একতা, সমঝোতা ও মিত্রতা ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর উত্তরসূরী হিসাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতিসংঘই বিশ্বের প্রথম আন্তঃদেশীয় সংস্থা যেটি এখন পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে বিশ্ব শান্তি ধরে রাখতে সফল হয়েছে।

তবুও এটা পুরোপুরিভাবে বলা যাবে না যে বিশ্ব শান্তি অর্জিত হয়েছে। কারণ প্রত্যেক জাতি ও দেশের মধ্যকার সংঘাতহীন শান্তি পূর্ণ পরিস্থিতি ও সম্পর্ককেই বিশ্ব শান্তি বলা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো বৃহৎ বৈশ্বিক যুদ্ধ না হলেও আঞ্চলিক কিছু যুদ্ধে পরাশক্তি[ক] রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণ বিশ্ব শান্তিকে সাময়িক বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রাজনৈতিক টানপোড়ান ও অস্থিতিশীলতা বিশ্ব শান্তি বিনষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। এক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেকসময় একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক কোন্দলে পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধইরাক যুদ্ধ

তবুও অনেকে মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকাংশেই স্থিতিশীল হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি (যেমন, মহাকাশ প্রতিযোগিতা) ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই (সোভিয়েত সাম্রাজ্যমার্কিন সাম্রাজ্যবাদ) হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন সাম্রাজ্যবাদ থেকে দূরে সরে থাকা দেশগুলো নিজেদেরকে বিশ্বের সম্মুখে প্রতিষ্ঠা করার একটি সুযোগ পেয়েছে। বলা যায় একপ্রকার "সমতা আনায়ন" হয়েছে বা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ সমকক্ষ দেশ ও জাতি যুদ্ধ ও অশান্তির মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বদলে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি[সম্পাদনা]

গ্যারি মেলচার্স দ্বারা অঙ্কিত, শান্তির দেয়ালচিত্র, ১৯৮৬।

ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রায়শঃই মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যাসহ অন্য ব্যক্তির সাথে পরস্পর বিপরীতমুখী চিন্তা-ভাবনাকে চিহ্নিত ও পরিচিতি ঘটানোর সুযোগ তৈরী করা হয়।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে, কেবলমাত্র সকল প্রকার দুঃখ-দূর্দশা শেষে শান্তি লাভ করা সম্ভব। দুঃখ থেকে পরিত্রাণ লাভ কর ও শান্তি লাভ কর - বৌদ্ধদের দার্শনিক মতবাদের চারটি মহৎ গুণাবলীর অন্যতম একটি হিসেবে স্বীকৃত।

ইহুদী এবং খ্রীষ্টানগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সান্নিধ্য স্থাপনের মাধ্যমেই প্রকৃত শান্তি আসবে। খ্রীষ্টানরা দাবী করেন যে নাজারেথের যীশু শান্তির রাজপুত্র। ব্যক্তি, সমাজ এবং সকল প্রকার সৃষ্টির মধ্যে অবস্থানপূর্বক শয়তানকে দূর করে মশীহ খ্রীষ্ট শান্তির রাজত্ব প্রতিপালন করবেন। প্রভু যীশু খ্রিষ্ট বলেছেন,

তোমাদের শান্তিকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি; আমার শান্তি আমি তোমাদেরকে দিব। বৈশ্বিকভাবে যে শান্তি তোমরা কামনা করছ আমি সে শান্তি দিব না। তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হইও না। - জন

— ১৪:২৭

ইসলাম ধর্মে শান্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি ইসলাম ধর্মের অন্যতম মূলনীতি। ইসলাম শব্দটি সালাম ও "সিলম" শব্দ থেকে এসেছে যেগুলোর অর্থ হল যথাক্রমে শান্তি এবং আত্মসমর্পণ। ব্যাপকার্থে, শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করাকেই ইসলাম ধর্ম হিসেবে সঙ্গায়িত করা হয়। এছাড়া ইসলামকে বোঝাতে "রিলিজিয়ন অব পিস" বা "শান্তির ধর্ম" শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আল্লাহর ("ঈশ্বর" শব্দের আরবি বিশেষ্য, এক এবং অদ্বিতীয়) নিকট আত্মসমর্পণের ভিত্তি হল নম্রতা। ইসলাম মতে, কোন ব্যক্তির নিজস্ব কোন নম্র আচরণ সহিংসতা বর্জন ও শান্তির উদ্দেশ্যে তা অভিমুখীকরণ ব্যতীত পরিপূর্ণরূপে সম্পন্ন হবে না।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

খেলাধুলা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অভিমত দিয়েছেন কয়েজন গবেষক। দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে খেলা দেশগুলোর মধ্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঠিকই, কিন্তু খেলাধুলা একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী হেরে গেলেও তা যুদ্ধের থেকেও অধিক মান্য।

প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার কুরুচিপূর্ণ সম্পর্ককে অলিম্পিক খেলা অনেকাংশে লাঘব করেছিল। এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা হতো ঠিকই, কিন্তু তা হতো একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভিতরে, ফলে হারলেও হেরে যাওয়া পক্ষের কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ থাকতো না। তৎকালীন অলিম্পিক গেমস দেবতা জিউসের সম্মানে খেলা হতো তাই হেরে যাওয়া পক্ষের তখন নিয়ম ভঙ্গ করে যুদ্ধ ঘোষণার সাহস ছিল না।

উপর্যুক্ত শিক্ষা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপ্রধান) বা জাতি অপর জাতির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে উভয় দেশের মধ্যকার শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে চাবে না। আপাতদৃষ্টিতে এতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতি বিদ্যমান। শুধুমাত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ-সংঘাত থেকে বিশাল পরিমাণ আর্থিক ও সামরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষার ফলে মানুষ তুলনামূলক জ্ঞান লাভ করে। ফলে সে সহজেই তুলনা করতে পারে কি খারাপ আর কি ভালো। যুদ্ধ-সংঘাতের ক্ষতির দিকটি তার নিকট স্পষ্ট থাকে। এছাড়াও শিক্ষিত ব্যক্তি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপে নিজেকে নিয়োজিত করে পারে, যেমন- রাজনৈতিক আন্দোলন

বিশ্ব শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য আঞ্চলিক ও আন্তঃদেশীয় সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেমন, জাতিসংঘ, সার্ক, ওআইসি, আসিয়ান, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন ইত্যাদি। এগুলোর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মাঝের শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা। এই কাজ করতে গিয়ে কিছু সংস্থা সামরিক আশ্রয়ও গ্রহণ করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন তন্মধ্যে প্রধান।

প্রতিবন্ধকতা[সম্পাদনা]

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থনৈতিক অসমতা। দেখা যায়, যে অধিকাংশ রাষ্ট্রই সামরিকভাবে শক্তিশালী হলেও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। ফলে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখনও অনেক দেশ যুদ্ধকেই বেছে নিচ্ছে। এছাড়াও সীমান্ত জটিলতা বিশ্ব শান্তির সামনে একটি প্রধান বাধা। সমঝোতা বা মীমাংসায় কাজ না হলে প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যার কোনো বিকল্প নেই। সেখানে আবার পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পরলে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘাত, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত সংঘাত এবং ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত বর্তমানের কিছু প্রধান ও আলোচিত সীমান্ত সমস্যা, যেখানে পূর্বেও পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপে যুদ্ধ সংঘটনের ইতিহাস আছে।

ধর্মীয় ও জাতিগত অসমতা বিশ্ব শান্তি বিনাশের অন্যতম কারণ। এটি কোনো অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনাশেরও কারণ। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা যুদ্ধ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এছাড়াও আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধও জাতিগত সংঘাতের ফলেই হচ্ছে। দেশের প্রধান ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রভাব বিস্তার এবং একই সঙ্গে বিদেশি হস্তক্ষেপ এর প্রধান কারণ। একটি ধর্মীয় সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করলে তা আরও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ একই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্বধর্মীদেরকেই সমর্থন দিবে। বিনিময়ে বিপক্ষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ও স্থিতিশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হবে। এই কারণেই অধিকাংশ মুসলিম দেশের সঙ্গে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ।

বিশ্ব শান্তি দিবস[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস বা বিশ্ব শান্তি দিবস হলো জাতিসংঘ-ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস, যা প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোষিত দিবসটির উদ্দেশ্য হলো পৃথিবী থেকে যুদ্ধ ও সংঘাত চিরতরে নিরসন; এবং সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর যুদ্ধরত অঞ্চলসমূহে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মাধ্যমে সেসব অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। দিবসটি ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম উদ্‌যাপিত হয়।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. "পরাশক্তি" বলতে এমন কিছু রাষ্ট্রকে বোঝায়, যেগুলো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত ও বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]