রূপতত্ত্ব (দর্শন)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

উদ্ভব ও বিকাশ[সম্পাদনা]

এডমন্ড হুসার্ল-এর রুপতত্ত্বের বা প্রতিভাসতত্বের পর্যালোচনা আরম্ভ হয় বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধে Logical Investigation গ্রন্থে। তবে প্রতিভাস বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে প্রতিভাস বিজ্ঞান একটি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

ফ্রান্স ও জার্মান প্রত্যক্ষবাদ[সম্পাদনা]

ফ্রান্সের প্রত্যক্ষবাদ[সম্পাদনা]

অগাস্ট কোঁতের(১৭৯৮-১৮৫৭) মতে পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল বিষয়ের ভিত্তি হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। জগৎ প্রকৃতিতে এই বিষয়গুলোকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয় প্রতয়ক্ষণের মাধ্যমেই জানা যায়। এগুলো জানার জন্য কোনো বিচারবাদী ধারণার দরকার হয় না। এই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের জ্ঞান মানুষের ভিতরে ধীরে ধীরে জন্ম নেয়।মানুষের সাধারণ জ্ঞানবোধটি জগৎ প্রকৃতির সম্পর্কে জানতে পারেনা। এ প্রসংগে কোঁতে জগৎ প্রকৃতিকে জানার জন্য মানুষের জ্ঞানচর্চাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। যেমন-

১. পৌরাণিক ও বিশ্ব সম্বন্ধীয়। ২. অধিবিদ্যক সম্বন্ধীয়। ৩. প্রত্যক্ষবাদ।

এ প্রত্যক্ষবাদের মাধ্যমেই কোঁতে মনে করেন জগৎ প্রকৃতিকে জানা যায়।

জার্মান প্রত্যক্ষবাদ[সম্পাদনা]

জার্মান প্রত্যক্ষবাদীদের মধ্যে অ্যাভেনারিউস (১৮৫৩-১৮৯৬) ও আর্নস্ট মাখ (১৮৩৮-১৯১৬) উল্লেখযোগ্য।এরা প্রত্যক্ষণীয় জগৎ প্রকৃতি ও বাস্তব বিষয়কে জানা জরুরি বলে মনে করেন যেটি অধিবিদ্যার বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ দুজন প্রত্যক্ষবাদী ধর্মের স্থানে বিজ্ঞান, শিল্প ও সমাজকে প্রতিষ্ঠার চেস্টা করেছেন। তবে অ্যাভেনারিউস অভিজ্ঞতার সংগে বিচারবাদকে গ্রহণ করেছেন এবং এই বিচারবাদকে তিনি পদ্ধতিবাদের ছাঁচে ফেলেছেন।আর অন্যদিকে আর্নস্ট মাখ মনে করেন প্রত্যক্ষবাদ হলো একটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান যেখানে মনোবিজ্ঞানের স্থান আছে।হুসার্ল অ্যাভেনারিউসের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিচারবাদ ও আর্নস্ট মাখের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রণালীতত্ত্ব রুপত্ত্বের উদ্ভব হিসেবে গ্রহণ করেন।

ইংলিশ ও জার্মান অভিজ্ঞতাবাদ[সম্পাদনা]

ইংলিশ অভিজ্ঞতাবাদ[সম্পাদনা]

ইংলিশ অভিজ্ঞতাবাদ যেটি উনিশ শতকে বিস্তৃতি লাভ করেছিলো সেটি মানববুদ্ধি উন্মেষকে স্বীকার করতো।এ কথার অর্থ হলো এই ইংলিশ অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞান বিজ্ঞানকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে চায়।

উনিশ শতকের ইংলিশ অভিজ্ঞতাবাদ সতের ও আঠারো শতকের অভিজ্ঞতাবাদের ভুল সংশোধন করে এই অভিজ্ঞতাবাদ মনে করে যে বাস্তবকে ইন্দ্রিয়জ্ঞানের সাহায্যে জানা যায়।এই অভিজ্ঞতাবাদের প্রবর্তক ছিলেন মিল,স্পেন্সার প্রমুখ।

মিল-এর মতে জগৎ প্রকৃতিকে জানার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।বিজ্ঞান সবসময়ে তার নবয় কৌশলে জগৎ প্রকৃতি বিষয় বস্তুকে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যায় যে বিষয়টি উপযোগী মনে করা হয় সেটিকেই গ্রহণ করা হয়। এখানে নৈতিকতাকে স্বীকার করা হয় না। মিল-এর এই বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা রুপতত্ত্বের উদ্ভবে বিস্তর অবদান রেখছে।

স্পেন্সার মনে করেন নৈতিকতার প্রয়োজন আছে তবে এই নৈতিকতাকে ইতিহাস সংস্কৃতি সভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের সংগে পরখ করে দেখতে হবে। কারণ নৈতিকতা মানুষের জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সে কারণেই বাস্তব জগতে নৈতিকতার প্রয়োজন আছে।স্পেন্সারের এই জীবনমুখি বাস্তব নৈতিকতাকে রুপতত্ত্বে হুলার্স গ্রহণ করেন।

জার্মান অভিজ্ঞতাবাদ[সম্পাদনা]

জার্মান অভিজ্ঞতাবাদের জনপ্রিয় প্রবক্তা ছিলেন ফ্রান্স প্রেটানো (১৮৩৮-১৯১৭)। এরিস্টটল ও স্কলাস্টিক দর্শন সম্বন্ধে তিনি খুবই ভালো জানতেন। তার তিনি প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিত স্থানে পৌছানোর চেস্টা করেন। তার কাছে নিশ্চিত জগৎ হল অভিজ্ঞতা। এখানে উল্লেখ্য যে কান্টও নিশ্চিত জ্ঞানে পৌছাতে গিয়ে অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।অর্থাৎ প্রেটানো তার দর্শনে কোনো প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে প্রশ্রয় দেননি।

প্রেটানো-এর একজন ঘনিস্ঠ শিষ্য হিসেবে হুসার্ল তার এই অভিজ্ঞতাকেই তার রুপত্ত্ত্বের জন্য গ্রহণ করেন।

জার্মান নব্য কান্টীয় চিন্তাধারা[সম্পাদনা]

উনিশ শতকের চিন্তাধারায় বস্তুবাদ ও উপোযোগবাদে নতুন নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটে। এ নতুন চিন্তাধারার প্রবক্তারা ভাববাদী দর্শনকে সংস্কার করার চেস্টা করেন। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে জার্মানীতে নব্য কান্টীয় স্তর তৈরি হয়।

জার্মান নব্য কান্টীয় চিন্তাধারার মধ্যে বলতে গেলে ধর্মের বিষয়টি ছাড়া বাকী সবগুলো বিষয়কেই হুসার্ল তার রুপতত্ত্বে গ্রহণ করেছেন।

রুপতত্ত্বের বিকাশ[সম্পাদনা]

আধুনিক দর্শন বিভিন্ন শাখায় নতুন নতুন মতবাদের পতাকা উড়িয়েছে। হুসার্লের রুপত্ত্ব থেকে ও বিংশ শতকের তিনটি নব্য ধারার বিকাশ ঘটে। যেমন:

১. অস্তিত্ববাদ ২. নব্য প্রত্যক্ষবাদ ৩. জ্ঞানবিদ্যক উত্তরণ

অস্তিত্ববাদ[সম্পাদনা]

এটি বিংশ শতাব্দীর একটি শীর্ষ স্থানীয় মতবাদ। এই মতবাদটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। অস্তিত্ত্ববাদের কথা,নীতিমালা মানুষের কাছে একটা সময়ে কর্তব্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।বিশেষ করে সাধারণ মানুষে র কাছে।যেখানে উনিশ শতকের জীবন দর্শন অভিজাত শ্রেণীর জন্যই শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ ছিলো। এই অভিজ্ঞতাবাদ এককথায় সাধারণ মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছে।এ মতবাদ তাত্ত্বিক বিষয়ের বিপরীতে জাগতিক বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করে।এ দর্শন তৈরি হবার পিছনে কিছু পূর্ব শর্তের প্রয়োজন হয়। এ পূর্বশর্তগুলো আমেরিকা ইংল্যান্ড ও মতো পুজিবাদী দেশগুলোতে তৈরি হয়নি বা ব্যবহার হয়নি।

জার্মান অস্তিত্ববাদ[সম্পাদনা]

মানুষের মধ্যকার সামজিক নিরাপত্তাহীনতা,ভয় উৎকন্ঠাজনিত ইত্যাদি সমস্যার কথাকে অস্তিত্বের সংকট বিবেচনা করে তা আলোচনা করেন কার্ল জ্যাসপার্স।তার মতে হেগেল তার অধিবিদ্যা ও যুক্তিশাস্ত্রে সত্তা সম্বন্ধে এ কথা বলে গেছেন যে কাজ সম্পাদন করতে হবে।কারণ এ কাজ সামাজিক অবস্থা সহযোগী। অন্যদিকে হাইডেগার এই সমস্যার সমাধান খোঁজবার চেষ্টা করেন যেমনটি তার গুরু হুলার্স রুপতত্ত্বে সন্ধান করেছিলেন। হাইডেগারের মতে বস্তুবাদী দার্শনিকের বিপরীতে ভাববাদী দর্শনকে নতুনভাবে বিকশিত করার কথা বলেছেন। তার মতে কান্ট হেগেল ও জার্মান ভাববাদ সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। যদি আদতে হতোই তবে জার্মান সমাজের এ দুরবস্থা হতোনা বলে তিনি মনে করতেন।

ফরাসি অস্তিত্ববাদ[সম্পাদনা]

ফ্রেঞ্চ অস্তিত্ববাদের কথা প্রথম যিনি বলেন তিনি হলেন জাঁ পল সার্ত্রে।এ অস্তিত্ববাদ নান্দনিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। সার্ত্রে সামাজিক সংস্কারবন্চিত লোক। তিনি প্রথম জীবনে হাইডেগারের অনুসারী হতে চেয়েছিলেন।সামাজিক সমস্যা সমাধানে তার কথা হলো মানুষের সত্তা বা অধিবিদ্যক ধারণার আদতে কোনো প্রয়োজনই নেই কারণ তা মানুষের জীবনে সুখ পরিপূর্ণভাবে প্রদান করে না। মানুষের জন্য দরকার নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। অস্তিত্ব স্বীকার হলেই মানুষের জীবনে সত্য অর্জিত হয়। কারণ মানুস সবসময়েই মূলত স্বাধীন।স্বাধীনতাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুকে চিনতে,ভাবতে ও অর্জন করতে। সার্ত্রে তার নানা সাহিত্য কর্মে উপন্যাসে দেখিয়েছেন একটি সমগ্রের বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যক্তিমানুষ কতই না অসহায়! তিনি মনে করেন এই মানবতাবাদ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল মানুষের জন্য হতে পারে চূড়ান্ত মানবতার। ব্যক্তি যদি তার অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন থাকে তবে তাকে শোষন করা সহজ নয়।

নব্য প্রত্যক্ষবাদ[সম্পাদনা]

এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা দর্শন, হুলার্সের অধিবিদ্যা বিরোধী ও বিজ্ঞানমনষ্ক মনোভাবটি পরবর্তীকালে নব্য প্রত্যক্ষবাদী এ দর্শনকে মৌলিক প্রেরণা দিয়েছে। অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত দার্শনিক হ্বিটগেনস্টেইনের দর্শনে যার সার্থক প্রতিফলন ঘটে। তিনি তার Tractatus গ্রন্থে দর্শন অনুসন্ধান করেন বাস্তব ঘটনার সাথে সংযুক্ত করে।

হ্বিটগেনস্টেইনের মতে "বাস্তব ঘটনার সাথে সংযুক্ত বাস্তবসত্তা বাস্তব ঘটনা থেকেই উদ্ভূত"। তিনি বলেন ভাষার উদ্দেশ্য হলো বাক্যের যৌক্তিক প্রতিফলনের সাহায্যে প্রত্যক্ষণীয় বিষয়কে জানা, ভাষার সাহায্যে বস্তুর প্রকৃত রুপ বা চিত্র-কে উপস্থাপন করা।তার মতে ""The proporsition is a picture of reality"

নব্য প্রত্যক্ষবাদে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে ভিয়েনা চক্র । এ চক্রের সদস্য ছিলেন মরিজ শ্লিক, হ্যানস হ্যান, রুডলফ কার্নপ,ফ্রাংক প্রমুখ। তারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে স্বচ্ছ ও যথার্থ করার জন্য বিজ্ঞানকে অধিবিদ্যা থেকে দূরে রাখার কথা বলেন। এবং তা করার জন্য পরখনীতি সাধনের কথা বলেন।

জ্ঞানবিদ্যক উত্তরণ[সম্পাদনা]

কার্ল পপার পরখনীতির সমালোচনা করে মিথ্যায়ন নীতির অবতারণা করেন। জ্ঞানবিদ্যক উত্তরণে এই নীতির ধারাবাহিকতায় কার্ল পপারের শিষ্য লাকাটোস এসে আবার কারণাপের সাথে একমত পোষন করেন এবং বলেন পপার কারণাপের পরখনীতিকে যে ভুল বলেছেন তা একদম ঠিক নয়।তিনি বলেন এখানে আংশিক ভুল ছিলো।সে ভুল ঠিক করলেই পুরোপুরি সত্য প্রতিষ্ঠা হয়।ল্যাকাটোস বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য হিউরিস্টিক পদ্ধতির কথা বলেন। হিউরিস্টিক পদ্ধতি হলো বিশেষ কোন পদ্ধতি অনুসরন না করে সুবিধা অনুযায়ী কাজ করা।