বড়ি (খাদ্য)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বড়ি
বড়ি
ধরনপুডিং
উৎপত্তিস্থলভারত
অঞ্চল বা রাজ্যপূর্ব মেদিনীপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
সংশ্লিষ্ট জাতীয় রন্ধনশৈলীভারত
প্রধান উপকরণবিউলির ডাল, ডাল, পপি বীজ এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা
ভিন্নতাগহনা বড়ি

বড়ি শুকনো মসুর ডালের পুডিংবিশেষ যা বাঙালি খাবারে বেশ জনপ্রিয় । এটি মাষকলাই ডাল এবং চালকুমড়া একটি পেস্ট থেকে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত ৩-৫ দিনের জন্য রোদে শুকনো থাকে। একবার পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে সহজেই এটি প্রায় এক বছরের জন্য স্থায়ী হতে পারে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

পূর্ব মেদিনীপুর জেলাটি নকশা বড়ির জন্যে বিখ্যাত। [১] বোড়ি প্রস্তুত করা প্রায় স্বতন্ত্রভাবে পরিবারের মহিলারা করেন, কখনও কখনও বাচ্চাদের দ্বারা সহায়তা করেন। সাধারণ ধারণার বিপরীতে, এটি গাছে জন্মে না।

বোড়ি ভাজা এবং একটি জলখাবার হিসাবে খাওয়া যেতে পারে বা স্বাদ বাড়াতে এবং বিভিন্ন জাতের মাছ বা উদ্ভিজ্জ খাবার রান্নায় যোগ করা যায়।

তৈরির পদ্ধতি[সম্পাদনা]

পেস্টটি সূর্যের আলোতে একটি মাদুরের উপরে হাতে রেখে দেওয়া হয়। ভিজার সময় এটি মাদুরের সাথে লেগে থাকে তবে যখন বোরি পুরোপুরি শুকায় তবে সহজেই তা নামতে পারে। বোরির সরলতম রূপে পেস্টটি ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া শঙ্কুগত আকার নেয়।

জড়িত শৈল্পিক ডিজাইনগুলি যখন ফানেলের মাধ্যমে আটকানো হয় তখন পেস্ট দিয়েও তৈরি করা যায়। একে নকশা বোরি বলা হয়। একে গহনা বড়ি বা গায়না বোড়িও বলা হয় কারণ নকশাগুলি প্রায়শই গহনাগুলির মতো দেখায় (গহনা বা গায়না গহনাগুলির জন্য বাঙালি)। মাদুর থেকে অপসারণের সময় নকশা বোরি ভঙ্গ করা এড়াতে পেস্ট দেওয়ার আগে পোস্ত বীজের একটি স্তর ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

বড়ি তৈরী হয় শীতকালে। কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বড়ি দেওয়ার শুভ সূচনা হয়। বড়ি দেওয়ার দিন বাড়ির মহিলারার স্নান করে, পরিষ্কার কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে গহনা বড়ির প্রস্তুতিতে হাত দেন। বড়ি দেওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় ভাঙা বিরিকলাই জলে ভেজাতে দেওয়া হয়। সারা রাত জলে ভেজার পর বিরিকলাইগুলো ফুলে ওঠে। পরের দিন ভোরবেলা বিরিকলাইগুলো ধুয়ে তার থেকে খোসাগুলো ছাড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয় যাতে বড়ি কালো না হয়ে যায়। তারপরে বিরিকলাইগুলো শিলনোড়ায় মিহি করে বাঁটা হয়। এরপর বাঁটা বিরিকলাইকে একটা বড় গামলায় ফেটাতে হয়। যত বেশি এবং যত ভালো ফেটানো হবে বড়ি তত মুচমুচে ও সুস্বাদু হবে। ফেটানোর গুণমান যাচাই করার জন্য খানিকক্ষণ ফেটানোর পর একটু লেই জলে ফেলে দেখা হয় ডুবে যাচ্ছে কি না। যতক্ষণ না লেই জলে ভেসে থাকার মত হালকা হয় ততক্ষণ ফেটানো চালিয়ে যাওয়া হয়। ফেটানোর পর লেই হালকা হলেও যতক্ষণ না তা দিয়ে বড়ি দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ লেইকে অনবরত ফেটিয়ে যেতে হয়। সেই জন্য গহনা বড়ি দেওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে দু'জন লাগে।

একটি কাপড় তেলে ভিজিয়ে সেই কাপড় আলতো করে বুলিয়ে নেওয়া হয় কাঁসার থালার উপর, এমনভাবে যে থালায় যে তেল বুলোনো আছে তা বোঝা না যায়। তারপর থালার উপর বিছিয়ে দেওয়া হয় পোস্তর একটি আস্তরণ যাতে থালাটি আর দেখা না যায়। এবার বড়ি দেওয়ার পালা। যিনি বড়ি দেন তার এক হাতে থাকে পুঁটলি ও আর এক হাতে কাঠি। তিনি পুঁটলিতে একটু করে লেই নিয়ে হাতের চাপে পুঁটলির ছিদ্র দিয়ে লেইয়ের একটি সরু ধারা নিঃসরণ করান। তারপর শৈল্পিক দক্ষতায় কাঁসার থালার উপর সৃষ্টি করেন অপূর্ব নকশা সমন্বিত বড়ি। এক একটি বড়ির প্যাঁচ শেষ হয়ে গেলে লেইয়ের ধারাটিকে অন্য হাতে ধরা কাঠি দিয়ে কেটে পরের বড়িটি দেওয়া শুরু করেন। এটি অত্যন্ত দক্ষ হাতে করতে হয় যাতে বড়ি দেওয়া হয়ে গেলে বোঝা না যায় বড়ির প্যাঁচের শুরু আর শেষটা কোথায়। বড়ি দেওয়ার সময় নকশায় সামান্য ত্রুটি হয়ে গেলে বা রেখা জুড়ে গেলে তা কাঠি দিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়। রঙীন বড়ির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা রঙের জন্য পৃথক পাত্রে লেই প্রস্তুত করা হয়, এবং প্রত্যেক রঙের জন্য পৃথক পুঁটলি ব্যবহার করা হয়।

গহনা বড়ি (ভাজার পরে)

বড়ি শোকানোর জন্য প্রয়োজন শীতের সকালের হালকা রোদ। কড়া রোদে বড়ি ভেঙে যায়। সেই জন্য রোদ জোরালো হলে বড়িগুলোকে হালকা আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এক দিক ভালো করে শুকিয়ে গেলে বড়িগুলো উল্টে দেওয়া হয়। রোদে শুকিয়ে যাওয়ার পর বড়িগুলোকে কৌটোবন্দী করে ফেলা হয়।[২]

বিবরণ[সম্পাদনা]

শিল্পীরা নকশার জন্য কোন মডেল বা স্কেচ ব্যবহার করেন না, পরম্পরাগতভাবে চলে আসা গয়নার নকশাই ব্যবহার করেন। বড়িগুলি আকৃতিতে সাধারণত বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র, ত্রিভূজ ও উপবৃত্তের মত হয়। নকশায় থাকে মূলতঃ স্বর্ণালঙ্কারের প্রভাব। মুকুট, নেকলেস, দুল, টায়রা, বাজুবন্ধ, লকেট, কানপাশা, মাকড়ি, ঝরোখা ইত্যাদির নকশা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নানাবিধ জ্যামিতিক নকশা, বিভিন্ন ধরনের কল্কা, শাঁখ, পদ্মফুল ও বিভিন্ন বশুপাখি যেমন বিড়াল, টিয়া, কাকাতুয়া, ময়ূর, পেঁচা, হাঁস ও প্রজাপতি নকশায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Ray, Utsa (২০১৫-০১-০৫)। Culinary culture in colonial India। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 227। আইএসবিএন 110704281X 
  2. রায়, উৎসা (২০১৫)। Culinary Culture in Colonial India (ইংরেজি ভাষায়)। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা 225–228। আইএসবিএন 9781107042810। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  3. সেন, পৃথা (৩১ মার্চ ২০১৬)। "How British greed spurred the creation of one of Bengal's most loved dishes"দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ২১ আগস্ট ২০১৬ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]