ফ্রেডেরিক রাইনেস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ফ্রেডেরিক রাইনেস
ফ্রেডেরিক রাইনেস
জন্ম(১৯১৮-০৩-১৬)১৬ মার্চ ১৯১৮
মৃত্যুআগস্ট ২৬, ১৯৯৮(1998-08-26) (বয়স ৮০)
নাগরিকত্বমার্কিন
পরিচিতির কারণনিউট্রিনো
দাম্পত্য সঙ্গীসিলভিয়া স্যামুয়েলস (বি. ১৯৪০); দুই সন্তান
পুরস্কার
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রপদার্থবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠানসমূহ
অভিসন্দর্ভের শিরোনামনিউক্লিয়ার ফিশন অ্যান্ড দ্য লিকুইড ড্রপ মডেল অব নিউক্লিয়াস (১৯৪৪)
ডক্টরাল উপদেষ্টারিচার্ড ডি. প্রেজেন্ট
ডক্টরেট শিক্ষার্থীমাইকেল কে. মোয়ে (১৯৬৫)

ফ্রেডেরিক রাইনেস (/ˈrnɛs/ RY-nes;[১] ১৬ মার্চ ১৯১৮ – ২৬ আগস্ট ১৯৯৮) একজন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি কাউয়ান-রাইনেস পরীক্ষায় ক্লাইড কাওয়ানের সাথে যৌথভাবে নিউট্রিনো আবিষ্কারের জন্য ১৯৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সম্ভবত তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি " কোনো মৌলিক কণা আবিষ্কারের সাথে এবং পরবর্তীতে এর মূল বৈশিষ্ট্যাবলী আবিষ্কারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।"[২]

স্টিভেন্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১৯৪৪ সালে তিনি ম্যানহাটন প্রকল্পের লস আলামোস ল্যাবরেটরির তাত্ত্বিক বিভাগে রিচার্ড ফেইনম্যানের দলে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বহু পারমাণবিক পরীক্ষার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে অপারেশন গ্রিনহাউস নামের এক পারমাণবিক পরীক্ষার পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে হ্যানফোর্ড ও সাভানাহ রিভার সাইটে রাইনেস ও কাওয়ান তাদের আবিষ্কারের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও কার্যপ্রণালীর উন্নয়ন করেন যার দরুন ১৯৫৭ সালে তারা প্রথমবারের মত অনাবিষ্কৃত নিউট্রিনো আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। তিনি তার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়েই নিউট্রিনোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে নিয়োজিত ছিলেন। তার এই কাজের দরুন বহু গবেষককে নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলশ্রুতিতে কসমিক রশ্মি কর্তৃক বায়ুমণ্ডলে নিউট্রিনো তৈরি ঘটনা শনাক্ত হয় এবং আবিষ্কৃত হয় সুপারনোভা এসএন১৯৮৭এ থেকে নিউট্রিনো নির্গমনের ঘটনা, যার দরুন যাত্রা শুরু করে নিউট্রিনো জ্যোতির্বিজ্ঞান।

প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

ফ্রেডেরিক রাইনেস নিউ জার্সির প্যাটারসনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গুসি (কোহেন) ও ইজরায়েল রাইনেসের চার সন্তানের মাঝে অন্যতম। তার বাবা মা সোভিয়েত রাশিয়ার একই শহরের অধিবাসী ছিলেন। তারা অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। কিন্তু, তাদের পরিচয় ঘটেছিল নিউইয়র্ক শহরে, যা পরবর্তীতে পরিণয়ে গড়ায়। তার বড় বোন পলা পরবর্তীতে ডাক্তারি পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং তার বড় দুই ভাই আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি বলেছেন "ছোটবেলায় তার পড়াশোনা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছে" তার সহোদরদের পড়াশোনা থেকে। তার সাথে আত্মীয়তা ছিল র‍্যাবাই আইজ্যাক জ্যাকব রাইনেসের, যিনি মিজরাচি নামের এক ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।[৩]

তার পরিবার নিউইয়র্ক শহরের হিলবার্নে বসতি স্থাপন করে। সেখানে তার বাবা একটি দোকান চালাতেন। তিনি তার শৈশবের একটি বড় সময় কাটিয়েছেন সেখানে। তিনি ছিলেন একজন ঈগল স্কাউট (মার্কিন স্কাউটের সবচেয়ে বড় র‍্যাংক)। তিনি তার শৈশব সম্পর্কে বলেছেন : "আমার শৈশবের শুরুর দিককার স্মৃতি মার্কিন শহুরে দোকান এবং ছোট মার্কিন শহর কেন্দ্রিক, যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত ছিল জুলাই মাসে স্বাধীনতা দিবসের আতশবাজি ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য তৈরিকৃত পটমণ্ডপ থেকে ভেসে আসা দেশাত্মবোধক গান।"[৪]

রাইনেস কখনো দলবদ্ধভাবে আর কখনো এককভাবে গান গাইতেন। তিনি মেট্রোপলিটন অপেরা থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে বিনামূল্যে গানের তালিম লাভ করতেন কেননা, তার বাবা মায়ের গান শেখানোর মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না।[৪] তাদের পরিবারকে পরবর্তীতে নিউ জার্সির নর্থ বেরগান থেকে কেনেডি বৌলেভার্দে বসতি স্থাপন করতে হয়, কেননা নর্থ বেরগানে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না।[৫] তিনি ইউনিয়ন হিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন যেটি নিউ জার্সির ইউনিয়ন হিলে (বর্তমান ইউনিয়ন সিটি) অবস্থিত।[৪][৫] ইউনিয়ন হিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা শেষ হয় ১৯৩৫ সালে।[৫]

শৈশবকাল থেকেই তার মনে বিজ্ঞান সম্পর্কে এবং নতুন কিছু তৈরি করা ও বানানোর বিষয়ে আগ্রহ ও ইচ্ছস জাগত। তিনি তার সে সময়ের স্মৃতি সম্পর্কে বলেন:

যতদূর আমার মনে পড়ে, বিজ্ঞানে আমার আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মীয় বিদ্যালয়ে ক্লান্তি সৃষ্টি হবার একটি মুহূর্তে যখন, গোধূলি লগ্নে আমি জানালার বাইরে তাকালাম তখন একটি হাতকে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের বোতাম ঘোরাতে দেখলাক, আমি আলোক বিষয়ক অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম; সেটা ছিল আলোর অপবর্তনের ঘটনা। এটাই পরবর্তীতে আমার আলো নিয়ে আগ্রহের সূত্রপাত ঘটায়।[৪]

দুর্ভাগ্যবশত, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম বছরর তিনি সাহিত্য ও ইতিহাসে তুলনামূলক বেশি নম্বর পেয়েছিলেন আর গণিত ও বিজ্ঞানে পেয়েছিলেন গড়পড়তা বা কম নম্বর। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরবর্তী বছরগুলোতে তার এসব বিষয়ে তার উন্নতি হয়। তিনি তার এক শিক্ষকের নিকট থেকে উৎসাহ পেয়েছিলেন যিনি তাকে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারের চাবি দিয়েছিলেন। এটি পরবর্তী জীবনে তার বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করেছিল। তার বয়োজ্যেষ্ঠরা যখন জিজ্ঞেস করত্রন তিনি ভবিষ্যতে কি হতে চান, তখন তিনি "বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী" হবার কথা বলতেন।[৪]

তিনি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ার জন্য নির্বাচিত হলেও তিনি নিউ জার্সির হোবোকেনে অবস্থিত স্টিভেন্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে তিনি যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক হন। তিনি ১৯৪১ সালে "আ ক্রিটিকাল রিভিউ অব অপটিকাল ডিফ্রাকশন থিওরি" শিরোনামে থিসিস লিখে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।[৩] ১৯৪০ সালের ৩০ আগস্ট তিনি সিলভিয়া স্যামুয়েলসের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।[৩] তাদের রবার্ট ও আলিসা নামের দুই সন্তান আছে।[৪] এরপর তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সেখানে সের্গে এ. কর্ফের অধীনে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন।[৪] কিন্তু, তিনি রিচার্ড ডি. প্রেজেন্টের তত্ত্বাবধায়নে "নিউক্লিয়ার ফিশন অ্যান্ড দ্য মডেল অব দ্য নিউক্লিয়াস" শিরোনামের থিসিস লিখেছিলেন।[৩][৬] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দরুন তার থিসিস প্রকাশে বিলম্ব ঘটে। যুদ্ধ শেষ হবার পর তার থিসিস ১৯৪৬ সালে ফিজিকাল রিভিউ এ প্রকাশিত হয়।[৩][৭]

লস আলামোস গবেষণাগার[সম্পাদনা]

অপারেশন গ্রিনহাউস–ডগ শট

১৯৪৪ সালে রিচার্ড ফেইনম্যান কর্তৃক ফ্রেডেরিক রাইনেস ম্যানহাটন প্রকল্পের লস আলামোস গবেষণাগারের তাত্ত্বিক বিভাগে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি পরবর্তী ১৫ বছর কাজ করেন।[৪] তিনি ফেইনম্যানের টি-৪ (বিকিরণ সমস্যা) দলে যোগ দেন, যেটি ছিল হ্যান্স বেথের টি (তাত্ত্বিক) বিভাগের অংশ। বিকিরণ খুব সূক্ষ্ম ভর পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয়।[৩] ১৯৪৬ সালের জুন মাসে তিনি দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হন এবং টি-১ (ড্রাগন তত্ত্ব) দলের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। তিনি ড্রাগন পশ্চাদাংশ বেষ্টনকরণ পরীক্ষায় সফলতার দরুন এই পদে অধিষ্ঠিত হন। ড্রাগন হল এমন এক ধরনের যন্ত্র যা খুব অল্প সময়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় পরিগণিত হয় এবং এটি গবেষণায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।[৮]

রাইনেস বিভিন্ন পারমাণবিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে বিকিলি অ্যাটোলে অপারেশন ক্রসরোড, ১৯৪৮ সালে এনিওয়েটক অ্যাটলে অপারেশন স্যান্ডস্টোন এবং নেভাদা পরীক্ষাস্থানে অপারেশন রেঞ্জার ও অপারেশন বাস্টার জ্যাঙ্গল। ১৯৫১ সালে তিনি অপারেশন গ্রিনহাউসের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একগুচ্ছ পারমাণবিক পরীক্ষার সমষ্টি। এতে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত উন্নত বিভাজন অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল যা তাপীয় পারমাণবিক অস্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। তিনি পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে গবেষণা করেছেন ও জন ভন নিউম্যানের সাথে বিস্ফোরণের পর বায়ুমণ্ডলে নির্গত রশ্মিতে বৃক্ষের কাণ্ডগঠন নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন।[৩][৪]

সম্ভবত, পারমাণবিক পরীক্ষায় তার সংশ্লিষ্টতার দরুন তিনি পারমাণবিক পরীক্ষার পর বায়ুমণ্ডলে নির্গত রশ্মি থেকে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় দূষণ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন এবং ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষার সমর্থকে পরিণত হন। স্পুৎনিক ১ উৎক্ষেপণের পর সৃষ্ট মহাকাশীয় স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে জন আর্চিব্যাল্ড হুইলারের প্রকল্প ১৩৭ এ যোগদান করেন যা পরবর্তীতে জ্যাসন নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। তিনি ১৯৫৮ সালে জেনেভায় শান্তির জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন।[৩][৪]

নিউট্রিনো ও তারার অন্তঃস্থ ক্রিয়া আবিষ্কার[সম্পাদনা]

১৯৩০ সালের ৪ ডিসেম্বরে উলফগ্যাং পাউলি নিউট্রিনোর ধারণা প্রদান করেছিলেন। তিনি পরমাণু ভাঙলে নিউট্রিনো পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছিলেন। বিটা ক্ষয়ে নিউট্রন ভেঙে প্রোটনইলেকট্রন তৈরির সময় হারিয়ে যাওয়া শক্তি পূরণে এটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নতুন বস্তুকণা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। এনরিকো ফের্মি এর নাম নিউট্রিনো প্রদান করেন ইতালীয় ভাষায় যার মানে "ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ কিছু"।[৯] ১৯৩৪ সালে তিনি "বিটাক্ষয়ের তত্ত্ব" প্রদান করেন যেখানে নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন নির্গমনের সময় নিউট্রন ভেঙে একটি করে প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনে পরিণত হয়।[১০][১১]

নিউট্রিনোর শক্তির ঘাটতি পূরণের জন্য দেওয়া হলেও ফের্মির তত্ত্বে বলা হয়, ক্ষুদ্র ভর ও আধানহীন কিছু সরাসরিভাবে দেখা সম্ভব নয়। ১৯৩৪ সালের গবেষণাপত্রে রুডলফ পেইয়েরলস ও হ্যান্স বেথে দেখান যে, নিউট্রিনো ভূমি দিয়ে গমন করতে পারে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে "নিউট্রিনো পর্যবেক্ষণ করা কার্যত অসম্ভব"।[১২]

১৯৫১ সালে রাইনেস এবং তার সহকর্মী ক্লাইড কাওয়ান নিউট্রিনো শনাক্ত করার প্রকল্প হাতে নেন যাতে তারা এর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন। গ্রিনহাউস গুচ্ছ পরীক্ষার সময়ে তিনি টি বিভাগের প্রধান জে. ক্যারসন মার্কের নিকট থেকে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে গবেষণা করার অনুমতি লাভ করেন। জে. ক্যারসন তাকে জিজ্ঞেস করেন, "কেন তুমি মুক্ত নিউট্রিনো শনাক্ত করতে চাও?" প্রশ্নের পর তিনি তার জবাবে বলেন, "কেননা সবাই বলে তুমি এটা করতে পারবে না।"[১৩]

ফের্মির তত্ত্ব অনুসারে, ঐসময়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয় যেখানে নিউট্রিনো প্রোটনের সাথে মিলে নিউট্রন ও পজিট্রন সৃষ্টি করে।[১৩] পজিট্রন খুব তাড়াতাড়ি ইলেকট্রন দ্বারা বিলুপ্ত হয় এবং ২ ইলেকট্রন ভোল্টের গামা রশ্মি সৃষ্টি করে, যখন নিউট্রন প্রোটনের সাথে মিলে ২.২ ইলেকট্রন ভোল্টের গামা রশ্মি তৈরি করে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ঘটনা হিসেবে ঘটে যা আলাদা করা সম্ভব। তারপর রাইনেস ও কাউয়ান বুঝলেন যে তারা যদি তাদের তরল স্ফুলিঙ্গে ক্যাডমিয়াম লবণ ঢালতে পারেন, তবে তারা ঐ প্রক্রিয়া দেখতে সক্ষম হবেন এবং তখন ৯ ইলেকট্রন ভোল্ট গামা রশ্মি নির্গত হবে।[১৪] নিউট্রিনোর উৎসর জন্য তারা পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তারা গবেষণাগারের পরিচালক নরিস ব্র‍্যাডবারির নিকট থেকে অনুমতি লাভ করেন। পরীক্ষার জন্য খাফ খননের মাধ্যমে তাদের কাজ শুরু হয়। তখন জে. এম. বি. কেলগ পারমাণবিক বোমার পরিবর্তে পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করতে অনুরোধ করেন। এতে কম নিউট্রিনো পাওয়া গেলেও এর সাহায্যে অনেক সময় ধরে বহু পরীক্ষা চালানো সম্ভব।[৩][১৪]

১৯৫৩ সালে তারা একটি বিশাল পারমাণবিক চুল্লির সাহায্যে হ্যানফোর্ড পরীক্ষাস্থানে তাদের পরীক্ষা চালান, যে পরীক্ষাটি এখন কাওয়ান–রাইনেস নিউট্রিনো পরীক্ষা নামে পরিচিত। তাদের শনাক্তকরণ যন্ত্রে ৩০০ লিটার (৬৬ ইম্পেরিয়াল গ্যালন; ৭৯ ইউএস গ্যালন) তরল স্ফুলিঙ্গ ও ৯০ টি ফটোমেট্রিক টিউব অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, কসমিক রশ্মি দ্বারা সৃষ্ট শব্দ তাদের প্রচেষ্টায় পানি ঢালে। ১৯৫৫ সালে জন এ. হুইলারের উৎসাহে তারা আবার তাদের পরীক্ষা চালান এবং আরো বড় ৭০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক চুল্লির সাহায্য নেন যার থেকে 1.2x 1012 / cm2 sec মানের উচ্চ নিউট্রিনো ফ্লাক্স নির্গত হত। তারা সুবিধাজনক ও চুল্লি থেকে ১১ মিটার (৩৬ ফু) দূরে এবং ভূপৃষ্ঠের ১২ মিটার (৩৯ ফু) গভীর চারদিকে ভালোভাবে ঘেরে জায়গা বেছে নিয়েছিলেন।[১৩] ১৯৫৪ সালের ১৪ জুন তারা নিউট্রিনো শনাক্তকরণে সফলতার কথা পাউলিকে টেলিগ্রাম মারফত পাঠাতে সক্ষম হন।[১৫] যখন বেথে এটি সম্পর্কে অবগত হন যে তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তখন তিনি বলেন "ভাল, তুমি পত্রিকায় যা পড়, তার সব কিছুই তোমার বিশ্বাস করা উচিত নয়।"[১৩]

সুপারনোভা এসএন১৯৮৭এ (কেন্দ্রে থাকা সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু) হাবল স্পেস টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণকৃত।

এরপর রাইনেস তার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়েই নিউট্রিনোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে নিয়োজিত ছিলেন। তার এই কাজের দরুন বহু গবেষককে নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করে।[১৬] কাউয়ান ১৯৫৭ সালে লস আলামোস ত্যাগ করে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করলে তাদের যৌথ গবেষণার পরিসমাপ্তি ঘটে।[৩] প্রথমবারের মত নিউট্রিনো শনাক্ত করার দরুন রাইনেসকে ১৯৫৯ সালে কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি সেখানে থাকতে একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে দল কসমিক রশ্মি দ্বারা বায়ুমণ্ডলে সৃষ্ট নিউট্রিনো প্রথমবারের মত শনাক্ত করতে পেরেছিল।[১৪] ছোটবেলা থেকেই রাইনেসের গানের গলা ভালো ছিল ও তিনি গায়ক হতে চাইতেন। কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি তার দায়িত্বের পাশাপাশি ক্লিভল্যান্ড অকেস্ট্রা কোরাসে রবার্ট শয়ের দিকনির্দেশনায় জর্জ সজেল ও ক্লিভল্যান্ড অকেস্ট্রার সাথে গেয়েছিলেন।[১৭]

১৯৬৬ সালে তার নিউট্রিনো গবেষণা দলের অধিকাংশকে নিয়ে নব্য প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনে যোগদান করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ভৌতবিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিন ছিলেন। সেখানে থাকাকালে রাইনেস স্নাতক ছাত্রদের সাথে মেডিকেল রেডিয়েশন ডিটেক্টরের উন্নতিতে আত্মনিয়োগ করেন ও পুরো মানব শরীরে রেডিওথেরাপি প্রদানের পর সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করেন।[১৭]

রাইনেস সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট দূরবর্তী ঘটনা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ঘটনা বিরল হলেও রাইনেস ভাবলেন তিনি ভাগ্যবান হলে একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখতে পারেন ও বিশেষভাবে তৈরি শনাক্তকরণ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি নিউট্রিনো নির্গমন দেখতে পারবেন। তিনি তার অপেক্ষাকালীন সময়ে তার বড় নিউট্রিনো শনাক্তকরণ যন্ত্রগুলোতে সংকেত প্রদান করেন যাকে তিনি "আশু সুপারনোভা পূর্বাভাস প্রক্রিয়া" বলে অভিহিত করেন।[১৭] ১৯৮৭ সালে সুপারনোভা এসএন১৯৮৭এ থেকে নিউট্রিনো নির্গমনের ঘটনা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিন, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ব্রুকহ্যাভেন জাতীয় গবেষণাগারের সমন্বিত উদ্যোগে ক্লিভল্যান্ডের লবণ খনির নিকট ৮,০০০ টন চেরেনকভ শনাক্তকরণ যন্ত্রের সাহায্যে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।[২] সাধারণত, শনাক্তকরণ যন্ত্রটি অল্প কিছু ঘটনা রেকর্ড করলেও সুপারনোভা ঘটনার দিন মাত্র ১০ সেকেন্ডে ১৯ টি ঘটনা রেকর্ড করেছিল।[১৩] এই আবিষ্কারকে নিউট্রিনো জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনা বলে গণ্য করা হয়।[২]

১৯৯৫ সালে রাইনেসকে মার্টিন লুইস পার্লের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি কাউয়ানের সাথে নিউট্রিনো শনাক্তকরণ পরীক্ষায় অংশ নেবার দরুন এই পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে কাউয়ান মারা যাবার দরুন পুরস্কারে ভূষিত হন নি কেননা, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় না।[১৮] রাইনেস ১৯৮১ সালে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার স্মৃতি পুরস্কার,[১৯] ১৯৮৩ সালে জাতীয় বিজ্ঞান পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে ব্রুনো রসি পুরস্কার, ১৯৯০ সালে মিচেলসন-মর্লি পুরস্কার, ১৯৯২ সালে পানোফস্কি পুরস্কার এবং ফ্রাঙ্কলিন পদকও লাভ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য ও ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির বিদেশি সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন।[৩] ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের ডিন হিসেবে কাজ করেছেন ও ১৯৮৮ সালে প্রফেসর এমেরিটাস হিসেবে নিযুক্ত হলেও ১৯৯১ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের ফ্যাকাল্টির সাথে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন।[২০]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের ভবনগুলোর মাঝে ফ্রেডেরিক রাইনেস অন্যতম (এটি পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগ এবং রসায়ন বিভাগের অন্তর্গত।

দীর্ঘ রোগভোগের পর ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের চিকিৎসাকেন্দ্রে ১৯৯৮ সালের ২৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।[১][৩] মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে যান।[১] তার গবেষণাপত্র ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।[২১] তার নামানুসারে প্রতিষ্টানটিতে রাইনেস হলের নামকরণ করা হয়েছে।

প্রকাশনা[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. উইলফোর্ড, জন নোবেল (আগস্ট ২৮, ১৯৯৮)। "Frederick Reines Dies at 80; Nobelist Discovered Neutrino"দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫ 
  2. শুলৎজ, ইয়োনাস; সোবেল, হ্যাঙ্ক। "Frederick Reines and the Neutrino"University of California, Irvine School of Physical Sciences। ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  3. ক্রপ, উইলিয়াম; শুলৎজ, ইয়োনাস; সোবেল, হেনরি (২০০৯)। Frederick Reines 1918-1998 A Biographical Memoir (পিডিএফ)। Washington D.C.: National Academy of Sciences। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৭, ২০১০ 
  4. "The Nobel Prize in Physics 1995"। Nobel Foundation। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৩, ২০১২ 
  5. Pope, Gennarose (মার্চ ২৫, ২০১২)। "Bridge of troubled Kennedy Boulevard"। The Union City Reporter। পৃষ্ঠা 12। 
  6. "Nuclear fission and the liquid drop model of the nucleus"New York University। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  7. প্রেজেন্ট, আর. ডি.; রাইনেস, এফ.; নিপ, জে. কে. (অক্টোবর ১৯৪৬)। "The Liquid Drop Model for Nuclear Fission"। Physical Review70 (7–8): 557–558। ডিওআই:10.1103/PhysRev.70.557.2বিবকোড:1946PhRv...70..557P 
  8. ট্রুসলো ও স্মিথ ১৯৬১, পৃ. ৫৬-৫৯।
  9. ক্লোজ ২০১২, পৃ. ১৫–১৮।
  10. ফার্মি, ই. (১৯৬৮)। উইলসন, ফ্রেড এল. (trans.)। "Fermi's Theory of Beta Decay"American Journal of Physics36 (12): 1150–1160। ডিওআই:10.1119/1.1974382বিবকোড:1968AmJPh..36.1150W। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ২০, ২০১৩ 
  11. Close 2012, পৃ. 22–25।
  12. বিথ, এইচ.; পেইর্লস, আর. (এপ্রিল ৭, ১৯৩৪)। "The Neutrino"Nature133 (3362): 532। আইএসএসএন 0028-0836ডিওআই:10.1038/133532a0বিবকোড:1934Natur.133..532B 
  13. রাইনেস, ফ্রেডেরিক (ডিসেম্বর ৮, ১৯৯৫)। "The Neutrino: From Poltergeist to Particle" (পিডিএফ)। Nobel Foundation। ডিসেম্বর ১৪, ২০১০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫Nobel Prize lecture 
  14. লুবকিন, গ্লোরিয়া বি. (১৯৯৫)। "Nobel Prize in Physics goes to Frederick Reines for the Detection of the Neutrino" (পিডিএফ)Physics Today48 (12): 17–19। আইএসএসএন 0031-9228ডিওআই:10.1063/1.2808286বিবকোড:1995PhT....48l..17L। ডিসেম্বর ১৭, ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  15. ক্লোজ ২০১২, পৃ. ৩৭–৪১।
  16. Close 2012, পৃ. 42।
  17. "In Memoriam, 1998. Frederick Reines, Physics; Radiological Sciences: Irvine"। University of California। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫ 
  18. ক্লোজ ২০১২, পৃ. ৪২।
  19. "Frederick Reines wins Oppenheimer Prize"। Physics Today34 (5): 94। মে ১৯৮১। ডিওআই:10.1063/1.2914589বিবকোড:1981PhT....34R..94. 
  20. "The Passing of Frederick Reines, Physics Nobel Laureate in 1995"University of California, Irvine। নভেম্বর ২, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  21. "Guide to the Frederick Reines Papers"। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫California Digital Library-এর মাধ্যমে। 

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]