গিরিশ চন্দ্র সেন
এই নিবন্ধের যাচাইযোগ্যতার জন্য অতিরিক্ত তথ্যসূত্র প্রয়োজন। |
গিরিশ চন্দ্র সেন | |
---|---|
জন্ম | ১৮৩৪ |
মৃত্যু | আগস্ট ১৫, ১৯১০ |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারত |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত |
পরিচিতির কারণ | প্রকাশক, গবেষক |
গিরিশ চন্দ্র সেন (জন্ম: ১৮৩৪ - মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ১৯১০)[১] ছিলেন একজন বাঙালি ধর্মবেত্তা, অনুবাদক ও বহুভাষীক। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নামেই তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন এবং 'মৌলভী'[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] উপাধিও পেয়েছেন। বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারনের নিকট প্রথম বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ কুরআন প্রকাশের কৃতিত্ব তাকে দেয়া হয়। তিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু এবং ইসলামী বিষয়াবলী সমন্ধেও পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।[২]
নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে তার জন্ম। পেশাগত জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাচারিতে নকলনবিশ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে স্বল্প সময়ের জন্য ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি ঢাকা প্রকাশে কাজ করেন এবং এতে তার লেখা প্রকাশিত হয়। পরে তিনি সুলভ সমাচার ও বঙ্গবন্ধু পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক এবং মাসিক মহিলা (১৩০২) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবে ১৮৭১ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং প্রচারব্রত গ্রহণ করে উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত ও ব্রহ্মদেশ ভ্রমণ করেন। গুরু কেশবচন্দ্র সেনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি ইসলামি সাহিত্য-সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এ উপলক্ষে আরবি ভাষা ও ইসলামিক ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য তিনি ১৮৭৬ সালে লক্ষ্ণৌ গমন করেন। ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ, চারিত্রিক উদারতা এবং সত্যবাদিতার জন্য গিরিশচন্দ্র ব্রাহ্ম-হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এক কথায় তিনি ছিলেন সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীক। তাই সকলের নিকট তিনি ‘ভাই গিরিশচন্দ্র’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার প্রকাশনী হতে কুর'আনের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন।
গিরিশচন্দ্রের বিখ্যাত গ্রন্থ তাপসমালা (১৮৮০-৯৫) ৯৬ জন ওলি-আউলিয়ার জীবনচরিত, যা শেখ ফরীদুদ্দীন আত্তারের ফারসি ভাষায় রচিত তায্কেরাতুল আত্তলিয়ার ভাবাদর্শে রচিত। তিনি হাদিস-পূর্ব বিভাগ (১৮৯২) শিরোনামে মিশ্কাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] গিরিশচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য আরেকটি গ্রন্থ হলো তত্ত্বরত্নমালা (১৯০৭)।
এটি শেখ ফরীদুদ্দীন আত্তারের মানতেকুত্তায়েব ও মওলানা জালালউদ্দীন রূমীর মসনবী শরীফ নামক প্রখ্যাত ফারসি গ্রন্থদ্বয় থেকে সংকলিত। এতে নীতিকথা ও শিক্ষণীয় বিষয় ছোট ছোট গল্পের আকারে রসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া তিনি মূল ফারসি গ্রন্থ থেকে গুলিস্তাঁ ও বুস্তার হিতোপাখ্যানমালা, হাদিস বা মেসকাত্ মসাবিহ (১৮৯২-৯৮), দীউয়ান-ই-হাফিজ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ, মহাপুরুষচরিত (১৮৮২-১৮৮৭), মহাপুরুষ মোহাম্মদ ও তৎপ্রবর্তিত এসলাম ধর্ম, এমাম হাসান ও হোসায়নের জীবনী (১৯১১), চারিজন ধর্মনেতা, চারটি সাধ্বী মুসলমান নারী, খলিফাবর্গ, সবমিলিয়ে ৪২টি পুস্তক বাংলা ভাষায় রচনা ও প্রকাশ করেন। বইগুলো মুসলিম সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। তিনি রামমোহন রায় রচিত ইসলাম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ তুহ্ফাৎ-উল-মুয়াহ্হিদীনের (১৮৭৮) বঙ্গানুবাদ করে ধর্মতত্ত্ব পত্রিকায় প্রকাশ করেন। স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা প্রচারকল্পে বনিতাবিনোদন নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি ও জীবনী তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তার আত্মজীবনী গ্রন্থটি ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয়।
জন্ম, মৃত্যু এবং বংশপরিচয়
[সম্পাদনা]ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৩৪ সালে বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত বৈদ্য দেওয়ান বংশে জন্মগ্রহণ করেন।[৩] গিরিশচন্দ্রের পিতা ছিলেন মাধবরাম সেন এবং পিতামহ ছিলেন রামমোহন সেন। গিরিশচন্দ্ররা ছিলেন তিন ভাই। ঈশ্বরচন্দ্র সেন, হরচন্দ্র সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ গিরিশচন্দ্র সেন অন্য ধর্মের উপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
বাল্যকাল ও আরবি শিক্ষা
[সম্পাদনা]প্রাথমিক পড়া শেষ করে গিরিশচন্দ্র ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু তার বেশিদিন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয়নি। তার বিদ্যালয় ছাড়ার কারণ নিয়ে একটি ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। একদিন তিনি শ্রেণিকক্ষে দেখলেন শিক্ষক তার এক সহপাঠীকে পড়া না পারার জন্য খুব মারছেন। এই দেখে তার মনেও ভয় ধরে গেল, শিক্ষক যদি তাকেও মারেন। এই ভয়ে তিনি বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে বাসায় চলে এলেন। তার বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি। এরপর তিনি পাঁচদোনায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তার পাশের গ্রাম শানখোলায় কৃষ্ণ চন্দ্র রায় নামে একজন খুব ভালো ফার্সি জানা লোকের কাছে গিরিশচন্দ্র ফার্সি ভাষা শিখতে শুরু করেন।[৩] বছর দুয়েকের মধ্যে ফার্সি ভাষা তিনি বেশ ভালো ভাবেই আয়ত্ত করে ফেলেন। গিরিশচন্দ্র ময়মসিংহের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কাজী মৌলবী আব্দুল করিম সাহেবের কাছে রোক্কাতে আল্লামী অধ্যয়ন করেন।
১৮৭৬ সালের আরবি শিক্ষার জন্য গিরিশ চন্দ্র লক্ষ্মৌ যান। লক্ষ্মৌ ব্রাহ্ম সমাজের আনুকূল্যে এবং সহযোগিতায় জ্ঞানবৃদ্ধ মৌলবী এহসান আলী সাহেবের কাছে আরবি ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজের পাঠ গ্রহণ করেন। লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতায় ফিরে একজন মৌলবীর কাছে এ বিষয়ে আরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকায় নলগোলায় মৌলবী আলিমউদ্দিন সাহেবের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন।[৩]
কর্মজীবনে প্রবেশ
[সম্পাদনা]বেশ কিছুদিন বেকার বসে থাকার পর তিনি তার মেজভাইয়ের সাথে চাকরির খোঁজে ময়মনসিংহ গমন করেন। সেখানে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে শিক্ষকের (দ্বিতীয় পণ্ডিত) পদে যোগদান করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সামান্য এক চাকরির মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলেন না। তার ছিল জ্ঞানের পিপাসা। তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু করলেন গিরিশচন্দ্র। তৎকালীন ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকায় তিনি ময়মনসিংহের সংবাদদাতা ছিলেন। তাছাড়া এই পত্রিকায় তার অনেকগুলো লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল।
ব্রাহ্ম ধর্মের দীক্ষালাভ
[সম্পাদনা]চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিরিশচন্দ্র কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় যাওয়ার পর তার সাথে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের তৎকালীন প্রচারক কেশবচন্দ্র সেনের। সে সময় কেশবচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের নববিধান শাখার প্রধান। তারই প্রভাবে গিরিশচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ তার কর্তব্যনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভাই উপাধিতে ভূষিত করে। [৪]
লেখক জীবন
[সম্পাদনা]তিনি কুরআনের সম্পূর্ণ অংশ, মিশকাতুল মাসাবীহের প্রায় অধিকাংশ, হাদিস, তাজকিরাতুল আউলিয়া, দিওয়ান-ই-হাফিজ, গুলিস্তাঁ, বুঁস্তা, মকতুব্বত-ই-মাকদুস, শারফ উদ্দিন মুনিবী, মসনভী-ই-রুমী, কিমিয়া-ই-সাদত, গুলশান-ই-আসরার ইত্যাদিসহ বহু ইসলামি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
বিভিন্ন গ্রন্থাবলী রচনা
[সম্পাদনা]তার প্রথমগ্রন্থ ব্রহ্মময়ী-চরিত(জীবনী) প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ 'হিতোপদেশমালা'-র গল্পগুলো ছিল কবি শেখ সাদির গুলিস্তাঁ গ্রন্থের কিছু গল্পের অনুবাদ। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকার গিরিশ প্রেস থেকে। 'ধর্ম ও নীতি' প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার ওল্ড ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে। এরপর তিনি 'আকসিরে হেদায়েত' থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন 'ধর্ম-বন্ধু' গ্রন্থটি। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার বাহ্মসমাজ থেকে। তিনি তিন খণ্ডে পারস্যের কবি হাফিজের জীবনী, নৈতিক উপদেশ ও বাণীসমূহের অনুবাদ প্রকাশ করেন। এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর। তিনটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয় কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ থেকে। 'তাজকিরাতুল আউলিয়া' নামক গ্রন্থ থেকে তিনি মুসলিম দরবেশদের বাণীসমূহ সঙ্কলন ও অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ১৮৭৭ সালের ১৯ আগস্ট। 'দরবেশদিগের উক্তি (তাসাউফ)' শিরোনামের এই গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে। উর্দুগ্রন্থ 'আকসিরে হেদায়েত' থেকে তিনি মুসলিম দরবেশগণের বাণী সঙ্কলন ও অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। 'নীতিমালা' শিরোনামের এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালের ১৯ আগস্ট। 'দরবেশদের ক্রিয়া'(তাসাউফ) প্রকাশিত ১৮৭৮ সালে এবং মুসলিম পীর-দরবেশরা কীভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত হন, নামাজ আদায় করেন ও কীভাবে তত্ত্বলাভ করেন, এ সম্পর্কিত আলোচনা বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ 'দরবেশদিগের সাধন প্রণালী' প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। কুরআনের বাছাই করা আয়াতের অনুবাদ 'প্রবচনবলী (ধর্ম উপদেশ)' প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে ১৮৮০ সালের ২০ জানুয়ারি।
ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মিশনারিসুলভ কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল 'তাজকিরাতুল আউলিয়া'-র বাংলা অনুবাদ 'তাপসমালা' শিরোনামে একটি ধারাবাহিক গ্রন্থের প্রকাশ। তাজকিরাতুল আউলিয়াতে মোট ৯৬ জন মুসলিম দরবেশের কাহিনী বর্ণিত আছে। এই কাহিনীগুলো ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি মোট ছয় খণ্ডে এই বিশাল অনুবাদ কর্মটি সম্পন্ন করেন।
কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ
[সম্পাদনা]অনুবাদক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কুরআনের অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে মোট ১২ টি খণ্ডে এই অনুবাদকর্ম সমাপ্ত করেন। 'তাপসমালা'র দুটো খণ্ড বের হওয়ার পর ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কুরআনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড প্রকাশের সময় গিরিশচন্দ্র অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। গ্রন্থটিতে কেবল প্রকাশক গিরিশচন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিল। গ্রন্থটিতে প্রকৃত অনুবাদকের নাম ছিল না। ৩২ পৃষ্ঠার এই খণ্ডের মূল্য ছিল মাত্র চারআনা। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। যদিও কিছু আলেম এর সমালোচনা করেছিলো কিন্তু দুইটি মুসলমান সম্প্রদায় তার অনুবাদ সম্পাদন করার জন্য এই অজ্ঞাতনামা অনুবাদকের প্রশংসা করে ব্রাহ্মসমাজের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তাদের প্রশংসাপূর্ণ পত্রের অংশবিশেষ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
“ | আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আপনার প্রতি আমাদের আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা। | ” |
“ |
কুরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণ সমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমন্ডলীয় এতোদৃশ্য উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইবেন, তখন সেই সকল লোকের নিকট আত্ন-পরিচয় দিয়া তাঁহার উপযুক্ত সম্ভ্রম করা উচিত। |
” |
কুরআন অনুবাদ শেষ করে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বলেছিলেনঃ
“ |
আজ কুরআনের সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এত কালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রী মদাচার্য্য কেশবচন্দ্রের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম। তিনি তাহাতে পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। শেষাংশ আর তাঁহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাঁহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া তাঁহার কত না আহ্লাদ হইত, এছাড়াও তাঁহার কত আশীর্ব্বাদ লাভ করিত। |
” |
কুরআনের সম্পূর্ণ খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। সম্পূর্ণ খণ্ডেই প্রথম তিনি স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেন।
আবুল কাশেম মুজাফ্ফর আবদুল্লাহ, একজন বিশিষ্ট জমিদার, আইনজীবী, এবং ঢাকার বেচারাম দেউরী, তার সময়ের একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তিনি পাঁচটি ভাষায় সাবলীল ছিলেন: আরবি, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলা। বাংলায় কুরআনের অনুবাদের জন্য তিনি ফারসি ভাষায় একটি অভিনন্দন পত্র লেখেন। যাইহোক, ছাপাখানায় ফারসি হরফের অনুপলব্ধতার কারণে, তার চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রথম প্রকাশের পর থেকে বাংলা কুরআনের প্রতিটি সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভাই গিরিশ চন্দ্র তার কুরআনকে চূড়ান্ত করার আগে পর্যালোচনা ও সম্পাদনার জন্য আবদুল্লাহর কাছে অর্পণ করেন। এই কুরআনের একটি মূল কপি এখনও আবদুল্লাহর বংশধরদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
ভাই গিরিশ্চন্দ্র সেন অনূদিত কুরআনের চতুর্থ সংস্করণে মৌলানা আকরাম খাঁ একটি প্রশংসাসূচক ভূমিকা লিখেছিলেন।
হাদিসের অনুবাদ
[সম্পাদনা]কুরআনের পর তার আর একটি বড় কাজ হাদিসের অনুবাদ। হাদিসও কয়েক খণ্ড পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম খণ্ড হাদিস-পূর্ব-বিভাগ (১ম খণ্ড) প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। শেষ খণ্ড হাদিস-উত্তর-বিভাগ (৪র্থ খণ্ড) প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
জীবনী গ্রন্থমালা
[সম্পাদনা]তার জীবনী গ্রন্থমালা সমূহও মূলত 'তাপসমালা'র সমতুল্য। 'মহাপুরুষ চরিত' প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে। প্রথম ভাগে ছিল হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত দাউদ (আ.)-এর জীবনী। দ্বিতীয় ভাগে ছিল হযরত মুসা (আ.)-এর জীবনী। এটি ১৮৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি। তৃতীয় ভাগে আছে ইহুদী রাজা কিং ডেভিডের জীবনী। তার 'জীবনচরিতমালা'-র আরেকটি বড় গ্রন্থ মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনী। এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালের ২৪ জানুয়ারি। তৃতীয় ও শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালের ২৮ মে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
অন্যান্য জীবনীগ্রন্থ
[সম্পাদনা]- পরমহংসের উক্তি ও জীবনী। এই গ্রন্থে ১৮৪ টি বাণী আছে। প্রকাশকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৩।
- ইমাম হাসান ও হোসাইন। প্রকাশকাল ১ জানুয়ারি, ১৯০১।
- বিশ্বাসী সাধক গিরিন্দ্রনাথ। প্রকাশকাল ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩।
- চারিজন ধর্মনেতা [ প্রথম চার খলিফা, তথা হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত ওসমান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.)]-এর জীবনী। প্রকাশকাল ২৫ জুলাই, ১৯০৬।
- সতীচরিত্র ( মহারাণী শরৎ সুন্দরী দেবী-র জীবনী। প্রকাশকাল ২৫ জানুয়ারি, ১৯১১। মৃত্যুর পর প্রকাশিত।
- চারি সাধ্বী মোসলমান নারী (হযরত খোদেজা, ফাতেমা, আয়েশা ও রাবেয়ার জীবনী। মৃত্যুর পর প্রকাশিত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
অন্যান্য গ্রন্থ
[সম্পাদনা]- তত্ত্ব কুসুম (ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন)। প্রকাশকাল ২০ এপ্রিল, ১৮৮২।
- তত্ত্বরত্নমালা (ফার্সি ভাষা থেকে ধর্মীয় নীতিকথার অনুবাদ)। প্রকাশকাল ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৮২।
- ১৮৮৫ সালের ৮ আইনের সহজ বাংলা অনুবাদ (দুখন্ড)। প্রকাশকাল ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৫।
- নববিধান প্রেরিতগণের প্রতিনিধি (ব্রাহ্মধর্মের নববিধান সংঘের কার্যক্রমবিষয়ক গ্রন্থ)। প্রকাশকাল ২৪ জানুয়ারি, ১৮৮৭।
- নববিধান কি?। প্রকাশকাল ২৪ ব্জানুয়ারি, ১৮৮৭।
- তত্ত্ব সন্দর্ভমালা (নববিধানের মূলতত্ত্ব)। প্রকাশকাল ২৭ আগস্ট, ১৮৯৩।
- কাব্যলহরী (পাঠ্যপুস্তক : কবিতা)। প্রকাশকাল ১৮ জুন, ১৮৯৭।
- দরবেশী (তাসাউফ)। প্রকাশকাল ১৯ এপ্রিল, ১৯০২।
- ধর্মবন্ধুর প্রতি কর্তব্য (বিবিধ)। প্রকাশকাল ২২ মার্চ, ১৯০৬।
- আত্মজীবনী। প্রকাশকাল ১৯০৭।
- মহালিপি (পারস্যের শরাফত-আল-দীন আহমদ মালিরির পত্রাবলীর অনুবাদ। প্রকাশকাল ১৯০৯।
সম্পাদনা কর্ম
[সম্পাদনা]ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধু' ও 'সুলভ সমাচার' নামের দুটি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। তৎকালীন পশ্চাৎপদ নারী সমাজের জাগরণে নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন 'মহিলা' নামের একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এর সম্পাদক ছিলেন।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি সংরক্ষণ কাজের উদ্বোধন"। প্রথম আলো। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
- ↑ "বাংলায় কুরআনের প্রথম অনুবাদক কে"। দৈনিক নয়া দিগন্ত। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৫।
- ↑ ক খ গ ফজলুর রহমান, "শতাব্দীর দর্পণ", ২০০০, পৃষ্ঠা ৫৯
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩০ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০২০।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- বাংলাদেশী ধর্ম প্রচারক
- বাংলাদেশী অনুবাদক
- ব্রাহ্মধর্ম
- বাঙালি হিন্দু
- ১৮৩৬-এ জন্ম
- পূর্ববঙ্গে জন্ম
- ১৯১০-এ মৃত্যু
- ভারতীয় হিন্দু
- বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি
- নরসিংদী জেলার ব্যক্তি
- কুরআনের বাংলা অনুবাদক
- বাঙালি লেখক
- ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের শিক্ষক
- পোগোজ স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাংলাদেশী সাংবাদিক
- ১৮৩৫-এ জন্ম
- কলকাতার পণ্ডিত
- ২০শ শতাব্দীর বাঙালি
- ১৯শ শতাব্দীর বাঙালি
- ব্রাহ্ম
- হিন্দুধর্ম ও ইসলাম
- আরবি ভাষা থেকে অনুবাদক
- বাংলা অনুবাদক
- ভারতীয় অনুবাদক
- ভারতীয় পণ্ডিত
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় পণ্ডিত
- পশ্চিমবঙ্গের লেখক