মধুসূদন গুপ্ত
পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত | |
---|---|
জন্ম | ১৮০০ |
মৃত্যু | ১৫ নভেম্বর ১৮৫৬ | (বয়স ৫৫–৫৬)
শিক্ষা | |
পেশা | চিকিৎসক |
পরিচিতির কারণ | প্রথম ভারতীয় যিনি পাশ্চাত্য রীতিতে শবব্যবচ্ছেদ করেন |
মেডিকেল কর্মজীবন | |
প্রতিষ্ঠান | মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল, কলকাতা |
বিশেষজ্ঞতা |
|
গবেষণা | বয়ঃসন্ধি সম্পর্কিত |
পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (১৮০০ – ১৫ নভেম্বর ১৮৫৬) বাঙালি হিন্দু বৈদ্য পরিবারের একজন অনুবাদক এবং আয়ুর্বেদিক। তিনি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুশ্রুতের প্রায় ৩০০০ বৎসর পর ভারতীয় হিসেবে প্রথম পাশ্চাত্যরীতিতে শব ব্যবচ্ছেদ করেন।[১]
জন্ম ও বংশপরিচয়
[সম্পাদনা]মধুসূদন গুপ্ত ১৮০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তিনি ছিলেন হুগলি জেলার বৈদ্যবাটী গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী বৈদ্য পরিবারের সন্তান। অনেক আগে থেকেই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে তার পরিবারের সমাজিক পরিচিতি ও প্রতিপত্তি ছিল। তার প্রপিতামহ বক্সী উপাধি পেয়েছিলেন। তার পিতামহ হুগলির নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসকও ছিলেন। প্রসঙ্গত ১৮০০ সালেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি ছোটবেলায় থেকেই খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন এবং প্রচলিত নানা প্রথা বিরোধী কাজকর্মেই উৎসাহী ছিলেন। এমনকি তিনি প্রথাগত লেখাপড়াতেও অনুৎসাহী ছিলেন। তার পড়াশোনার অমনোযোগীয়তা কারণে কিশোর মধুসূদনকে তার পিতা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।[৩]
শিক্ষা জীবন
[সম্পাদনা]প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৮২৬ সালে সংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন মধুসূদন গুপ্ত।[৪] শিক্ষাগ্রহণকালে তিনি আয়ুর্বেদে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত, ন্যায়শাস্ত্র, অলংকার প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন ও যথেষ্ট বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দেন। সংস্কৃত কলেজে ভর্তির আগে তিনি রাম কবিরাজ নামে এক বৈদ্যের কাছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ দেওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা নেন। বিভিন্ন বৈদ্যের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখতে গিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে ব্যুৎপত্তি অর্জনে পরবর্তীতে সাহায্য করেছিল।[৫]
সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদশাস্ত্র সম্পর্কে পাঠরত অবস্থায় তিনি শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধে আকৃষ্ট হন। কাঠ বা মোম নির্মিত অস্থি দেখে ও বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহ ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যবচ্ছেদ কার্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।[৬]
চিকিৎসাজীবন
[সম্পাদনা]ডাক্তারি জীবনের সূত্রপাত ঘটে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে সংস্কৃত কলেজ থেকে বৈদ্যক বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হলে।[৭] যার ফলে ছাত্রদের মেডিকেল কলেজের ক্লাসে যেতে হয়। ছাত্র মধুসূদন ১৮৩৫ সালের ১৭ই মার্চ থেকে মেডিকেল কলেজের ডিমনস্ট্রেটরের কাজে নিযুক্ত হয়ে সহকারী অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন।[৮] কিন্তু সহপাঠীর কাছে শিক্ষা গ্রহণে ছাত্ররা আপত্তি করলে[৯] ছাত্রদের অসন্তোষ প্রশমনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ মধুসূদনকে ডাক্তারী ডিগ্রির চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বলেন। ছাত্র মধুসূদন ডাক্তারী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলে কবিরাজ থেকে ডাক্তারে পরিণত হন। অধ্যয়নের পর, গুপ্ত একজন সংস্কৃত পণ্ডিত এবং একজন আয়ুর্বেদি চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। তারপর, তিনি সংস্কৃত কলেজে শিক্ষক হন। তার সময়কালে, স্থানীয় ভারতীয়দের জন্য সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি কোর্স পড়ানো হতো। হঠাৎ করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশীয় চিকিৎসা শেখার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। পরিবর্তে, তারা ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে পাশ্চাত্য চিকিৎসার দ্বার উন্মোচন করে। ভারতে পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির পদ্ধতিগত শিক্ষার জন্য এটিই ছিল প্রথম প্রতিষ্ঠান এবং অধিকন্তু এশিয়ায় ভারতীয়দের নিরাময়ের শিল্পে প্রশিক্ষণের জন্যও প্রথম প্রতিষ্ঠান। কলকাতা মেডিকেল কলেজ গুপ্তকে স্থানীয় শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং তাকে পশ্চিমা চিকিৎসা নিয়েও পড়াশোনা করতে বলেছিল, যার ফলে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম শিক্ষার্থী।
মৌলিকভাবে, অ্যানাটমি বা শারীরস্থান ছিল পশ্চিমা চিকিৎসা শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি এবং একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যদিও দেশীয় কুসংস্কার কারণে সেসময় ভারতে মৃতদেহে স্পর্শ করা এবং ব্যবচ্ছেদ করা নিষিদ্ধ ছিল। তবে, গুপ্ত পাশ্চাত্য চিকিৎসায় অত্যন্ত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং সেই সাথে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন বর্ণহিন্দুদের গোঁড়া কুসংস্কারের জন্য শবব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ থাকলেও ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি অথবা ২৮শে অক্টোবর কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা ভেঙে মহর্ষি সুশ্রুতের ৩,০০০ বছর পরে প্রথম বাঙালি হিসেবে ডাঃ হেনরি গুডইভের নির্দেশনায় মধুসূদন গুপ্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন অধ্যায় শুরু করেন এবং আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষার অগ্রগতির দিকে প্রথম অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এটি এশিয়ার প্রথম মানব ব্যবচ্ছেদ হিসেবেও স্বীকৃত ছিল। গুপ্তকে "ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ভারতীয় ব্যবচ্ছেদকারী" হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত করা হয়েছিল। এটি পশ্চিমা সভ্যতার একটি বড় বিজয় হিসাবে স্বীকৃত করা হয়েছিল। তার সহকারী হিসেবে ছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্র।[১০]
মেডিকেল কলেজের হিন্দুস্থানী বিভাগকে ১৮৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে নতুনভাবে গড়ে তোলা হলে মধুসূদন গুপ্তকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভাগ খোলা হলে তার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। আমৃত্যু দীর্ঘ ২২ বছর তিনি মেডিকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট পদে বহাল ছিলেন। তিনি বয়ঃসন্ধি সম্পর্কিত গবেষণা করেন।[১১]
অনুবাদকার্য
[সম্পাদনা]সংস্কৃত কলেজে থাকাকালীন সময়েই তিনি অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলেন। [১২] একটি সাধারণ ভারতীয় ভাষায় কিংবা একটি ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষায় ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা সহজ ছিল না এবং কীভাবে ইউরোপীয় বিজ্ঞানকে ভারতে প্রতিস্থাপন করা যায় তা নিয়ে অনেক দ্বিধা সৃষ্টি করেছিল। পণ্ডিতরা সচেতন ছিলেন যে শতাব্দী ধরে ভারতীয়রা যা শিখেছে তা মুছে ফেলা এবং পশ্চিমা তাত্ত্বিক কাঠামোর সাথে তাদের অদলবদল করা অসম্ভব। এই বিষয়ে বিতর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিল হুপারের বইয়ের চারপাশে সংশয়।[১৩][১৪]
সংস্কৃত কলেজে পাঠকালে বিভিন্ন ইংরেজি বই পড়ায় এনাটমি সম্পর্কে মধুসূদনের গভীর জ্ঞান অর্জন হয়। সংস্কৃত কলেজে পাঠকালে তিনি ১৮৩৪ সালে হুপারের লেখা “Anatomist’s Vade Mecum” বইটি সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। শারীরবিদ্যা শিরোনামে বইটি তিনি সম্পন্ন করেন। বইটি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ছাপানোর কথা হলেও বইটি কোন ভাষায় ছাপানো হবে এই নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তবে শেষ পর্যন্ত বইটি সংস্কৃতে মুদ্রিত হয়।[১৫] বইটি অনুবাদের জন্য তিনি ১০০০ টাকায় পুরস্কৃত হন।[১৬] এছাড়াও তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আরো কিছু বই অনুবাদ করেন।[১৭]
মৃত্যু
[সম্পাদনা]তিনি ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে শবব্যবচ্ছেদ করতে নিষেধ করা হয়। একটি ব্যবচ্ছেদ করার পর তিনি একটি সংক্রমণে আক্রান্ত হলে তার হাতে গ্যাংগ্রিন হয়। তবে শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা করায় সেপ্টিসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।[১৮][১৯] কলকতা জাতীয় মেডিক্যাল কলেজ তার নামে অ্যানাটমিতে "পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত মেমোরিয়াল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড" প্রদান করে।[২০]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Bose, Pradip Kumar (২০০৬-০২-০৭)। Health and Society in Bengal: A Selection From Late 19th Century Bengali Periodicals (ইংরেজি ভাষায়)। SAGE Publishing India। আইএসবিএন 9789352802715।
- ↑ Dutta, Krishna (২০০৩)। Calcutta: A Cultural and Literary History (ইংরেজি ভাষায়)। Signal Books। আইএসবিএন 9781902669595।
- ↑ Zenker, Julius Theodor (১৮৪৬)। Bibliotheca orientalis (ফরাসি ভাষায়)। G. Engelmann।
- ↑ Bose, D. (জানুয়ারি ১৯৯৪)। "Madhusudan Gupta" (পিডিএফ): 31–40। আইএসএসএন 0019-5235। পিএমআইডি 11639687।
- ↑ Bala, Poonam (২০১৫-১০-০৬)। Medicine and Colonialism: Historical Perspectives in India and South Africa (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 9781317318224।
- ↑ Chatterjee, Shamita; Ray, Ramdip; Chakraborty, Dilip Kumar (২০১৩)। "Medical college bengal-a pioneer over the eras"। The Indian Journal of Surgery। ৭৫ (৫): ৩৮৫–৩৯০। আইএসএসএন 0972-2068। ডিওআই:10.1007/s12262-012-0714-2। পিএমআইডি 24426482। পিএমসি 3824763 ।
- ↑ Indian Journal of History of Science (ইংরেজি ভাষায়)। National Institute of Sciences of India। ১৯৭২।
- ↑ Samanta, Arabinda (২০১৪)। "Physicians, forceps and childbirth: Technological Intervention in Reproductive Health in Colonial Bengal"। Medicine and Colonialism: Historical Perspectives in India and South Africa। Routledge। পৃষ্ঠা 115। আইএসবিএন 978-1-84893-465-8।
- ↑ Bose, D. (জানুয়ারি ১৯৯৪)। "Madhusudan Gupta" (পিডিএফ): 31–40। আইএসএসএন 0019-5235। পিএমআইডি 11639687।
- ↑ Mittra, Kissory Chand। Memoir Of Dwarkanath Tagore।
- ↑ Pande, Ishita (২০০৯-১২-০৪)। Medicine, Race and Liberalism in British Bengal: Symptoms of Empire (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 9781136972416।
- ↑ Bose, D. (জানুয়ারি ১৯৯৪)। "Madhusudan Gupta" (পিডিএফ): 31–40। আইএসএসএন 0019-5235। পিএমআইডি 11639687।
- ↑ Bhattacharya, Jayanta (২১ ডিসেম্বর ২০১৬)। "The Hospital Transcends into Hospital Medicine: A Brief Journey through Ancient, Medieval and Colonial India" (পিডিএফ): 28–53। ডিওআই:10.16943/ijhs/2017/v52i1/41299।
- ↑ Ikhlef, Hakim (২০১৪)। "9. Constructive Orientalism: Debates on Languages and Educational Poilicies in Colonial India, 1830-1880."। Connecting Histories of Education: Transnational and Cross-Cultural Exchanges in (Post)Colonial Education। Berghahn Books। পৃষ্ঠা 160–165। আইএসবিএন 978-1-78238-266-9।
- ↑ Ikhlef, Hakim (২০১৪)। "9. Constructive Orientalism: Debates on Languages and Educational Poilicies in Colonial India, 1830-1880."। Connecting Histories of Education: Transnational and Cross-Cultural Exchanges in (Post)Colonial Education। Berghahn Books। পৃষ্ঠা 160–165। আইএসবিএন 978-1-78238-266-9।
- ↑ Bhattacharya, Jayanta (২১ ডিসেম্বর ২০১৬)। "The Hospital Transcends into Hospital Medicine: A Brief Journey through Ancient, Medieval and Colonial India" (পিডিএফ): 28–53। ডিওআই:10.16943/ijhs/2017/v52i1/41299।
- ↑ Arnold, David (১৯৯৩-০৮-১২)। Colonizing the Body: State Medicine and Epidemic Disease in Nineteenth-Century India (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। আইএসবিএন 9780520082953।
- ↑ "Sixty-Seventh Annual Meeting of the British Medical Association" (পিডিএফ)। British Medical Journal। 2 (2022): 830–851। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯। আইএসএসএন 0007-1447। পিএমসি 2412400 ।
- ↑ Bose, D. (জানুয়ারি ১৯৯৪)। "Madhusudan Gupta" (পিডিএফ): 31–40। আইএসএসএন 0019-5235। পিএমআইডি 11639687।
- ↑ Guha, Ranjit (১ এপ্রিল ২০২০)। "Prof. Asim Kumar Datta (1927–2020)" (ইংরেজি ভাষায়): 116। আইএসএসএন 0003-2778। ডিওআই:10.4103/JASI.JASI_104_20।