অঘোরনাথ গুপ্ত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অঘোরনাথ গুপ্ত
জন্ম১৮৪১
মৃত্যু৯ই ডিসেম্বর ১৮৮১
পেশাব্রাহ্ম মিশনারি, বৌদ্ধধর্ম বিশেষজ্ঞ

অঘোরনাথ গুপ্ত (১৮৪১—১৮৮১ খ্রিঃ) ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একজন বিশেষজ্ঞ এবং ব্রাহ্মসমাজের একজন প্রচারক।[১] মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণের পর তার সৎ জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে '"'সাধু'"' বলে সম্মানিত করা হয়।[২] শিবনাথ শাস্ত্রী তার সম্বন্ধে বলেন, "তার অকপট ভদ্রতা, গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং আন্তরিক ভক্তি সমাজের সদস্যদের সম্মুখে অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।[২]

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

যাদবচন্দ্র রায় কবিভূষণের সন্তান অঘোরনাথ নদিয়ার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বারো বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ হয় এবং স্থানীয় টোল ও পাঠশালায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর সংস্কৃত কলেজে পঠনপাঠনের জন্য কলকাতায় গিয়ে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনে যোগ দেন।[১]

জন্মসূত্রে একই গ্রামের অধিবাসী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাথে দীক্ষা নিয়ে অঘোরনাথ হন ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অবলম্বকদের একজন। রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা ও সংকোচ সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে আসেননি।[২]

ব্যক্তিগত জীবনে অঘোরনাথ কঠোরভাবে নিরামিষ আহার করতেন এবং নিয়মিত দীর্ঘ সময় প্রার্থনা করতেন। ১৮৬৩ খ্রিঃ জাতিগত রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি নিজে বৈদ্য হয়ে একজন কায়স্থ বিধবাকে বিয়ে করেন।[১]

ধর্মপ্রচার[সম্পাদনা]

ব্রজসুন্দর মিত্র ১৮৫৭ খ্রিঃ ঢাকার আর্মেনিয়াটোলায় একটি বাড়ি কিনে সেখানে ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন বসাতে শুরু করেন। ১৮৬৩ খ্রিঃ এই বাড়িটি একটি ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। অঘোরনাথ এই বিদ্যালয়ে দশ মাস শিক্ষকতা করেন। তার প্রেরণায় যাঁরা ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে বঙ্গচন্দ্র রায় এবং ভুবনমোহন সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সময়েই দুই ভাই কালীমোহন দাস এবং দুর্গামোহন দাস ঢাকায় এসে প্রভাবশালী বক্তৃতার মাধ্যমে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার শুরু করেন। কেশবচন্দ্র সেন আসেন ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এবং ব্রাহ্মদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্ম-বিদ্বেষও বৃদ্ধি পায়।[২]

প্রথমদিকে অঘোরনাথ আদি সমাজের প্রচারক ছিলেন। ১৮৬৬ খ্রিঃ ১১ই নভেম্বর কেশবচন্দ্র সেন যখন কলকাতার চিৎপুর রোডের কলেজ চত্বরে ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ গঠনের প্রস্তাব দেন, অঘোরনাথ সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। ১৮৬৭ খ্রিঃ নতুন উদ্যমে তিনি দুর্গামোহন দাসকে সংস্কার ও প্রচারকার্যে সাহায্য করতে বরিশাল যান এবং সেখান থেকে যান চট্টগ্রাম। এর পর বিহারের মুঙ্গেরে গিয়ে কেশবচন্দ্র সেনের সাথে নতুন ভক্তি আন্দোলন শুরু করেন।[২]

১৮৭০ খ্রিঃ অঘোরনাথ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আসামে যান। তিনিই ঐ অঞ্চলে প্রথম ব্রাহ্ম প্রচারক ছিলেন। ওড়িশা এবং পাঞ্জাবেও তার কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল।[২]

১৮৬৯ খ্রিঃ নববিধান প্রতিষ্ঠা ও ১৮৭৮ খ্রিঃ ব্রাহ্মসমাজের দ্বিতীয় বিভাজনের পর অঘোরনাথ পাঞ্জাবে নববিধানের প্রচারকের দায়িত্ব পান।[৩] কিন্তু ঐ বছরেই ডায়াবেটিস রোগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি লখনউয়ে তার দাদার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।

বৈদগ্ধ্য[সম্পাদনা]

১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন তার মিশনারিদের মধ্য থেকে চারজনকে চারটি বিশ্ব-ধর্মের 'অধ্যাপক' নিযুক্ত করেনː হিন্দুধর্মের জন্য গৌরগোবিন্দ রায়, খ্রিস্টধর্মের জন্য প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, ইসলাম ধর্মের জন্য গিরিশ চন্দ্র সেন এবং বৌদ্ধধর্মের জন্য অঘোরনাথ গুপ্ত। পরবর্তীকালে ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল 'সঙ্গীতের অধ্যাপক' নিযুক্ত হন।[২]

বৌদ্ধধর্মের গভীরে প্রবেশ করার জন্য অঘোরনাথ পালি, সংস্কৃত ও বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষাও শিক্ষা করেছিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রসমূহ মূল ভাষায় তার অবগত ছিল। তার মূল কীর্তি হল শাক্যমুনিচরিত ও নির্বাণতত্ত্ব নামে একটি বই, যা পালি, বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষা ও সংস্কৃতে সুচিন্তিত অনুসন্ধান ও গবেষণার ফল। এটি বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্মের উপর লেখা প্রথম বই। এছাড়া শ্লোকসংগ্রহ সম্পাদনার কাজে কেশবচন্দ্র সেনকে তিনি সাহায্য করেছিলেন। ধর্মতত্ত্বসুলভ সমাচার পত্রিকাগুলিতেও তিনি লেখালেখি করতেন।[১]

রচনা[সম্পাদনা]

  • শাক্যমুনি ও নির্বাণতত্ত্ব,
  • ধ্রুব ও প্রহ্লাদ,
  • দেবর্ষি নারদের নবজীবন লাভ,
  • ধর্মসোপান,
  • উপদেশাবলী

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান (বাংলা), পৃ.৩, সাহিত্য সংসদ, আইএসবিএন ৮১-৮৫৬২৬-৬৫-০
  2. শিবনাথ শাস্ত্রী, ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস, ১৯১১-১২/১৯৯৩, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ
  3. Ghosh, Nirvarpriya, The Evolution of Navavidhan, ১৯৩০, পৃ. ১৪১, Navavidhan Press.