বাঘা যতীন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বাঘাযতীন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
বীর বিপ্লবী বাঘা যতীন
জন্ম(১৮৭৯-১২-০৭)৭ ডিসেম্বর ১৮৭৯
মৃত্যু১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫(1915-09-10) (বয়স ৩৫)
অন্যান্য নামবাঘা যতীন
প্রতিষ্ঠানযুগান্তর দল
আন্দোলনভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র, বড়দিনের ষড়যন্ত্র

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (৭ ডিসেম্বর ১৮৭৯ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫) ছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী নেতা। তিনি বাঘা যতীন নামেই সকলের কাছে সমধিক পরিচিত।

ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার প্রধান বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের প্রধান নেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে কলকাতায় জার্মান যুবরাজের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে তিনি জার্মানি থেকে অস্ত্র ও রসদের প্রতিশ্রুতি অর্জন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান প্লট তারই মস্তিষ্কপ্রসূত।[১]

সশস্ত্র সংগ্রামের এক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন এবং বালাসোর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তিনি সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্ট্যানোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত হন। যতীন ছিলেন শক্ত-সমর্থ ও নির্ভীক চিত্তধারী এক যুবক। অচিরেই তিনি একজন আন্তরিক, সৎ, অনুগত এবং পরিশ্রমী কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। একই সঙ্গে তার মধ্যে দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ জন্মেছিল।

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

কলকাতার বিডন স্ট্রিটে বাঘা যতীনের মূর্তি,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

বাঘা যতীনের জন্ম হয় কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। ঝিনাইদহ জেলায় পৈতৃক বাড়িতে তার ছেলেবেলা কাটে। ৫ বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়। মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হন বলে তার নাম রটে যায় বাঘা যতীন

যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। সমসাময়িক বাঙালি চিন্তাবিদদের রচনাবলীর পাঠিকারূপে তিনি অবগত ছিলেন দেশের মঙ্গলের পথ এবং সেইমতো তিনি লালন করতেন তার সন্তান দু'টিকে। পরোপকার, সত্যনিষ্ঠা, নির্ভীক চিন্তায় ও কর্মে অভ্যস্ত যতীন পড়াশোনা ও খেলাধুলার পাশাপাশি কৌতুকপ্রিয়তার জন্যও সমাদৃত ছিলেন। পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ ও অভিনয় করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং বেছে নিতেন হনুমান, রাজা হরিশচন্দ্র, ধ্রুব, প্রহ্লাদ প্রভৃতি চরিত্র।[২]

যতীনের বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় (বিপ্লবী হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা) ছিলেন কৃষ্ণনগরের আইনজীবী এবং আইনের অধ্যাপক। তার পরামর্শ নিতেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - পার্শ্ববর্তী শিলাইদহে তার জমিদারী সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে। কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে অনুরাগ নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তারই প্রেরণায় শরৎশশী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যতীনকে। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ইতিহাস-ভক্ত। যতীনের চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তিনি হাজির হতেন যতীনের ফুটবল ক্লাবে; সেখানে দামাল ছেলেগুলির সামনে সুরেন তুলে ধরতেন দেশপ্রেমের আদর্শ। গীতাপাঠের মধ্যে তাদের বুঝিয়ে দিতেন নিষ্কাম কর্মের উপযোগিতা। যতীন কৃষ্ণনগর শহরে এংলো ভার্নাকুলার (এ ভি) বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমানের ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) ভর্তি হন। কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তার বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন।

স্বামী বিবেকানন্দের পরামর্শে যতীন শরীরচর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন। সেখানে তার সাথে সেসময়ের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের দেখা হয়। এদের একজন শচীন বন্দোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি শচীনের পিতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাক্ষাৎ পান। যোগেন্দ্রনাথ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালীয় বিপ্লবীদের জীবনের আলেখ্য রচনা করেছিলেন।

কলেজ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে যতীন অ্যাটকিনসন সাহেবের স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হন। সদ্য প্রচলিত টাইপরাইটার ব্যবহার করার এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোটা মাইনের চাকুরি পাওয়া সম্ভব ছিলো। ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ইস্তফা দিয়ে যতীন ১৮৯৯ সালে মজঃফরপুর চলে যান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। ভারতের জন্য মজুদ অর্থ দিয়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করছে সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তার বিরুদ্ধে কেনেডি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা মারফৎ এবং তার সম্পাদিত ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকায় প্রচারণা চালাতেন।[৩] কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিভোগী এই ভারত প্রেমিক ব্যারিস্টার কেনেডি ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের উপরে মৌলিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে কেনেডি'র স্ত্রী ও কন্যার জীবননাশ ঘটে ক্ষুদিরাম বসুপ্রফুল্ল চাকীর বোমায়। কেনেডির উৎসাহে মজঃফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তুলেন।

জননী শরৎশশীর অসুস্থতার সংবাদে যতীন কয়াগ্রামে এসে দেখেন এক কলেরা রোগীর সেবা করতে করতে তার সংক্রমণে যতীনের মা মৃত্যুবরণ করেছেন। দিদি বিনোদবালার কাছে যতীন জানতে পারেন, তার প্রয়াত মা কুমারখালীর উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে ইন্দুবালার সাথে যতীনের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। ১৯০০ সালে যতীন ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। তাদের ৪টি সন্তান হয় - অতীন্দ্র (১৯০৩-০৬), আশালতা (১৯০৭-৭৬), তেজেন্দ্র (১৯০৯-৮৯) এবং বীরেন্দ্র (১৯১৩-৯১)।

যতীন মজঃফরপুরে আর ফিরবেন না - এই খবর পেয়ে কেনেডি একটি সুপারিশ দেন তার বন্ধু হেনরি হুইলারের নামে, যিনি তখন বাংলা সরকারের অর্থসচিব। যতীনকে হুইলার নিজের স্ট্যানোগ্রাফার হিসাবে নিয়োগ করেন। যতীনের পেশাগত নৈপুণ্যের সঙ্গে তার আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম মুগ্ধ করে হুইলারকে। ভারতীয় প্রজাদের উপরে ইংরেজ অফিসারদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন বিপিন চন্দ্র পাল নিউ ইন্ডিয়া (New India) পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপছেন; তারই প্রতিধ্বনি তুলে বংগদর্শনের পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন মুষ্টিযোগের উপযোগিতা বিষয়ে - ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত ইংরেজের পক্ষ নিয়ে সরকার যেভাবে তার বদলা নেয়, সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ হতে। এর পিছনে প্রচ্ছন্ন আছে বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতি গঠনের পরিকল্পনা।

শহীদ বাঘা যতীনের স্মৃতিবিজড়িত বিদ্যালয়, কৃষ্ণনগর

সশস্ত্র আন্দোলনে[সম্পাদনা]

১৯০৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। সরকারী নথিপত্রে যতীন পরিচিত হন শ্রী অরবিন্দের দক্ষিণহস্ত হিসাবে।[৪] অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (এম.এন রায়) সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং একে-অপরের আস্থাভাজন হন।

দেশপ্রেমিক, প্রতিবাদী ও কৌশলী দৃষ্টিভঙ্গী[সম্পাদনা]

১৯০০ সাল থেকে মূল অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জেলায় জেলায় যতীন পত্তন করেন এই গুপ্তসমিতির শাখা। পথে-ঘাটে ভারতীয় নাগরিকদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সদা প্রস্তুত যতীনের এই দেশাত্মবোধ গুণগ্রাহী হুইলারের মনে কৌতুক জাগাত।

১৯০৫ সালে যুবরাজের ভারত সফরকালে কলকাতায় বিরাট শোভাযাত্রা উপলক্ষে যতীন স্থির করলেন এদেশে ইংরেজদের আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন যুবরাজকে। একটি ঘোড়াগাড়ির ছাদে একদল সৈনিক বসে মজা লুটছে, তাদের বুটসমেত পা দুলছে গাড়ীর যাত্রী, কয়েকজন দেশী মহিলার নাকের সামনে। যুবরাজ নিকটবর্তী হওয়ামাত্র যতীন অনুরোধ করলেন গোরাদের নেমে আসতে। অশালীন রসিকতায় মুখর গোরাদের হতভম্ব করে একছুটে যতীন গাড়ীর ছাদে ওঠা মাত্র একজোটে গোরারা তাঁকে আক্রমণ করে। ইতিমধ্যে নিছক বাঙ্গালী থাপ্পড় মারতে মারতে যতীন তাদের ধরাশায়ী করছেন দেখে যুবরাজ তার গাড়ী থামাতে বলেন।[৫]

যতীন জানতেন, নিয়মিত লণ্ডনে ভারত-সচিব মর্লি'র দফতরে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয় এইসব দুষ্কৃতকারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে। যুবরাজ দেশে ফিরে গিয়ে ১৯০৬ সালে ১০ মে দীর্ঘ আলোচনা করেন মর্লি'র সংগে এর প্রতিকার চেয়ে।[৬] তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন।

বারীণের সাথে মতবিরোধ[সম্পাদনা]

অতীন্দ্রের অকাল মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান যতীন দিদি বিনোদবালা আর স্ত্রী ইন্দুবালাকে নিয়ে তীর্থভ্রমণে বের হন। হরিদ্বারে তারা স্বামী ভোলানন্দ গিরি'র কাছে দীক্ষা নিয়ে অন্তরের শান্তি ফিরে পেলেন। গিরিজি জানতে পারেন যতীনের দেশসেবার কথা এবং পূর্ণ সম্মতি জানান এই পন্থায় অগ্রসর হবার সপক্ষে।

১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বপরিবারে যতীন দেওঘরে বাস করতে থাকেন, বারীণ ঘোষের সঙ্গে একটি বোমা কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে কলকাতার মানিকতলায় বারীণ আরো বড় করে কারখানা খোলেন। যতীন চাইতেন প্রথমে একদল একক শহীদ এসে দেশের লোকের চেতনায় নাড়া দেবে; দ্বিতীয় ক্ষেপে আসবে ছোট ছোট দল বেঁধে ইতস্তত খণ্ডযুদ্ধ; তৃতীয় পর্বে দেশব্যাপী এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণআন্দোলন। বারীণ চাইতেন আচমকা সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠে ফুরিয়ে যেতে। সংগঠনের দিক থেকে বারীণ তার একচ্ছত্র নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। যতীন চাইতেন জেলায় জেলায় আঞ্চলিক নেতাদের অধীনে গুপ্তসমিতি শক্তিশালী হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সহযোগিতা করবে। আপাতদৃষ্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে বন্যাত্রাণে, কুন্তিমেলায়, অধোদয়যোগে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে মিলিত হয়ে দলের ঐক্য ও শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পেতেন তারা।[৭]

সামরিক অফিসারের সাথে মারামারি[সম্পাদনা]

১৯০৭ সালে বিশেষ কর্ম-দায়িত্ব নিয়ে হুইলারের সচিবদের সংগে যতীন সপরিবারে দার্জিলিংয়ে স্থানান্তরিত হলেন। সমস্ত উত্তর বাংলার মতো এখানেও যতীন "অনুশীলন"-এর সক্রিয় শাখা স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল প্রমুখ চারজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে যতীনের মারপিট হয় শিলিগুড়ি স্টেশনে। চারজনের চোয়াল ভেঙ্গে ধরাশায়ী করে দেবার অপরাধে যতীনের নামে মামলা রুজ্জু হলে সারাদেশে বিপুল হর্ষ জাগে-কাগজে কাগজে এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে। ঠাট বজায় রাখতে ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে শাসিয়ে দেন, “এমনটি আর যেন না ঘটে!” দর্পভরে যতীন জবাব দেন “নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করব না, এ শপথ আমি করতে অপারগ।”[৮]

হুইলার একদিন ঠাট্টা করে যতীনকে জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, একা হাতে ক'টা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?” হেসে যতীন বলেন, “ভাল মানুষ হয় যদি, একটাও নয়; দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব।”

দৃঢ়চেতা মনোভাবী ও সমাজ সংস্কারক[সম্পাদনা]

১৯০৬ সাল থেকে স্যার ডেনিয়েল হ্যামিলটনের সহযোগিতায় যতীন একাধিক মেধাবী ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। শুরু হয় তারকনাথ দাসকে দিয়ে; পরপর তার পিছু পিছু রওনা হন গুরনদিৎ কুমার, শ্রীশ সেন, অধর লস্কর, সত্যেন সেন, জিতেন লাহিড়ি, শৈলেন ঘোষ। ...... এদের কাছে নির্দেশ ছিল, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক লড়াইয়ের কায়দা ও বিস্ফোরক প্রস্তুতের তালিম নিয়ে আসতে এবং বিদেশের সর্বত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে। ১৯০৮ সালে বারীণ ঘোষের প্রথম প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন গোপনে শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ দুই প্রধান বিপ্লবী কানে কানে রটিয়ে দিলেন: "ওরে, হতাশ হস্‌নে! যতীন মুখার্জি হাল ধরে আছে!" এই দু'জনের নাম অন্নদা কবিরাজমুন্সেফ অবিনাশ চক্রবর্তী। বাস্তবিক সভা-সমিতি যখন বেআইনি, সারাদেশ যখন ধড়-পাকড়ের আতঙ্কে বিহ্বল, যতীন তখন স্যার ডেনিয়েলের কাছ থেকে জমি লীজ নিয়ে গোসাবা অঞ্চলে পত্তন করলেন Young Bengal Zamindari Cooperative : পলাতক কর্মীদের গ্রাসাচ্ছাদনের সংগে তিনি সোদপুরের শশীভূষণ রায় চৌধুরী'র দৃষ্টান্ত অনুযায়ী শুরু করলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়, ছোট ছোট কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠান, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। গ্রামাঞ্চলের সংগে বিপ্লবীদের এই প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় অত্যন্ত সুফল আসলো।[৯]

বিপ্লবীদেরকে অস্ত্র শিক্ষা ও ইংরেজ সরকার[সম্পাদনা]

জেলার সুবিদিত অস্ত্র-ব্যবসায়ী নূর খাঁ'র কাছে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে যতীন নিয়মিত বাদা অঞ্চলে গিয়ে নির্বাচিত কর্মীদের তালিম দিতেন। আলিপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ব্যয়ভার বহন, অস্ত্র সংগ্রহ ইত্যাদির জন্য অর্থের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও যতীন এইবার গণ-চেতনায় প্রত্যয় জাগানোর জন্য দুর্ধর্ষ কিছু স্বদেশী ডাকাতির আয়োজন করলেন। ১৯০৮ সালের ২ জুন থেকে ধাপে ধাপে এই অভিযান হয়ে উঠল ইংরেজ সরকারের বিভীষিকা। এই পর্যায়ের তুংগস্থান এসে পড়ল ১৯০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউটর আশু বিশ্বাসের হত্যা এবং ১৯১০ সালের ২৪ জানুয়ারি ডেপুটি কমিশনার শামসুল আলমের হত্যাঃ এঁরা দু'জনে সোনায় সোহাগার মতো যথেচ্ছভাবে আলিপুর বোমার আসামীদের ঠেলে দিচ্ছিলেন মর্মান্তিক পরিণামের দিকে; মূল অভিসন্ধি ছিল শ্রীঅরবিন্দকে চরম দণ্ড দেওয়া। ২৫ জানুয়ারি প্রকাশ্য সভায় বড়লাট মিন্টো ঘোষণা করলেন: "অভিনব এক মানসিকতা আজ দেখা দিয়েছে ........ যা চায় ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে।"[১০]

একটিমাত্র অপরাধী[সম্পাদনা]

২৭ জানুয়ারি, ১৯১০ তারিখে যতীনকে গ্রেপ্তার করা হল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে। শুরু হল হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা। দশম জাঠ বাহিনীকেই বিপ্লবীদের সংগে সহযোগিতার অপরাধে ভেঙ্গে দেওয়ার আগে প্রধান অফিসারদের ফাঁসিতে ঝোলানো হল। এক বছর ধরে এই মামলা চলতে দেখে নতুন বড়লাট হার্ডিঞ্জ অসহিষ্ণু হয়ে দাবি করলেন "একটিমাত্র অপরাধী"কে দণ্ড দিয়ে বাকি আসামীদেরকে রেহাই দেবার। "একটিমাত্র অপরাধী" হিসেবে যতীন কারাগারে বসেই খবর পেলেন যে অদূর ভবিষ্যতে জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের লড়াই বাঁধবে।

"দুই বাংলাতেই আজ শাসনব্যবস্থা বিফল", মরিয়া হার্ডিঞ্জ অনুযোগ করে ক্ষান্ত নন; কারামুক্ত যতীনকে গৃহবন্দী রেখে সরকার তৎপর হল শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। পুলিশী রিপোর্টে নিক্সন সাহেব লিখেছেন যে, মহাযুদ্ধ বেঁধে গেলে স্বাধীনতা-লাভের পথ প্রশস্ত হবে, এটা সম্যক উপলব্ধী করেন যতীন মুখার্জি। জার্মান যুবরাজ কলকাতায় সফর করতে এলে যতীন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুবরাজের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পান-সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য জার্মানি থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য পাওয়া যাবে।[১১] সমস্ত সন্ত্রাসমূলক কাজ স্থগিত রেখে যতীন পরামর্শ দিলেন জেলায় জেলায়, কেন্দ্রে কেন্দ্রে শক্তি সংহরণে নিবিষ্ট হতে। আকস্মিক এই সন্ত্রাস-বিরতি দিয়ে যতীন প্রমাণ করলেন যে, সুনিয়ন্ত্রিত পথেই তিনি হিংসাত্মক কর্মে নেমেছিলেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার প্রয়োজনে, যেটা টোরিটোরার সময়ে গান্ধীজির হাত ফসকে শোচনীয় আকার নেয়।

পুলিশের চোখে ধুলো[সম্পাদনা]

কলকাতার পুরো দায়িত্ব অতুলকৃষ্ণ ঘোষের হাতে অর্পণ করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যতীন উপস্থিত হলেন তার পৈতৃক ভিটা ঝিনাইদহে। সেখানে ঠিকাদারের ব্যবসা শুরু করলেন তিনি যশোর-ঝিনাইদহ রেলপথ নির্মাণ উপলক্ষে। ব্যবসার সুবাদে তিনি সাইকেলে অথবা ঘোড়ার পিঠে চড়ে জেলায় জেলায় অবিশ্রাম ঘুরে গুপ্তসমিতির শাখাগুলিকে সন্নিহিত করে তুললেন।

১৯১৩ সালে বাংলা এবং বাংলার বাইরের বিভিন্ন শাখার কর্মী ও নেতারা মিলিত হলেন বর্ধমানে বন্যাত্রাণ উপলক্ষে। উত্তর ভারত থেকে রাসবিহারী বসু এসে যতীনের সংগে আলোচনা করে নূতন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হলেনঃ অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে যতীনের সংগে একাধিক বৈঠকে রাসবিহারী সিদ্ধান্ত নিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সৈন্য-বহরের পরিচালকদের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে পেশোয়ার অবধি বিদ্রোহের আগুন জ্বলবে ১৮৫৭ সালের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে।[১২]

ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র[সম্পাদনা]

১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন 'গদর'-নেতা সত্যেন সেন; সংগে এলেন বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কর্তারসিং সরাংগা ও বিরাট একদল 'গদর'-কর্মী। সত্যেন জানালেন যে, বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বিপ্লবীরা খোদ কাইজারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন ভারতে অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ পৌঁছে দেবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাঠানো কয়েকটি জাহাজ; এর দায়িত্ব নিয়েছেন ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও তার মিলিটারী আতাশে ফন্‌পাপেন। কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হচ্ছে কাবুল অভিমুখে; পথে তারা জার্মানির হাতে বন্দী ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয় জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে হাজির হবে দিল্লীতে, যোগ দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে। বার্মা সীমান্তেও সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত থাকছে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে বলে। দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

যতীনের চিঠি নিয়ে পিংলে ও কর্তারসিং গেলেন রাসবিহারী'র সঙ্গে দেখা করতে। টেগার্টের রিপোর্টে দেখা যায়, এই সময়ে সত্যেন সেনকে নিয়ে যতীন কলকাতার বিভিন্ন রেজিমেন্টের অফিসারদের সংগে আলোচনায় ব্যস্ত।[১৩] ভারতের এই যজ্ঞ-অনলে ইন্ধন দেবার জন্য সাজসাজ পড়ে গেল দূরপ্রাচ্যে আমেরিকায়, ইউরোপে, মধ্যপ্রাচ্যেভূপতি মজুমদার স্পষ্ট লিখে গিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক এই সহযোগিতার উদ্ভাবন করেন স্বয়ং যতীন মুখার্জি। ইতিহাসে একে অভিহিত করা হয় "ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র" নামে।

সমাগত 'গদর' কর্মীরা কাজে নামতে চান, জার্মান অস্ত্র আসার জন্য তাঁদের তর সইছে না। যতীনের সঙ্গে পরামর্শ করে রাসবিহারী দিন ধার্য্য করলেন ২১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের জন্য। মিঞাসির (মহীসুর), লাহোর, ফিরোজপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস-সর্বত্র তেরংগা ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেওয়া হবেঃ নীল হবে মুসলমান কর্মীদের প্রতীক; হলদে শিখ; লাল হিন্দু। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে সমস্ত রেলপথ উড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে করে সরকার পক্ষ প্রত্যুত্তরের জন্য সৈন্যবাহিনী না আনাতে পারে। ইতিমধ্যে ২৬ আগস্ট ১৯১৪ সালে কলকাতার রডা কোম্পানী থেকে বিপ্লবীরা যথেষ্ট শক্তিশালী মাউজার পিস্তল সংগ্রহ করেছেন, প্রয়োজনমতো যা দূরপাল্লার রাইফেলের মতো ব্যবহার করা চলে। রাসবিহারী'র অনুরোধে অর্থ সংগ্রহ করতে যতীন নতুন একপ্রস্থ হিংসাত্মক অভিযানের শরণ নিলেন- মোটরচালিত ট্যাক্সির সাহায্যে অভিনব এই ডাকাতির পদ্ধতি অবিলম্বে ফ্রান্সে দেখা যাবে, প্রখ্যাত নৈরাজ্যবাদী সর্দার "বোনো"র পরিচালনায়। পরিশীলিত, শৃংখলাবদ্ধ দুঃসাহসিক এই কীর্তির সামনে মুগ্ধ আতঙ্কে ইংরেজ সরকার হতবুদ্ধি হয়ে রইল।[১৪] আর পুলকে মুগ্ধ দেশবাসী প্রত্যয় ফিরে পেল বিপ্লবীদের কর্মক্ষমতায়। ১২/২/১৯১৫, ২২/২/১৯১৫ - দুই দু'টো চোখ ধাঁধানো ডাকাতির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। ২৪/২/১৯১৫ যতীন এক গুপ্ত বৈঠকে কর্মসূচী নির্ধারণ করছেন, এমন সময়ে এক সরকারী গোয়েন্দা সেখানে উপস্থিত দেখে নেতার ইংগিতক্রমে চিত্তপ্রিয় তাকে গুলি করেন। গুপ্তচরটি তখনো মরেনি। মরার আগে সে যতীনকে তার হত্যাকারী বলে শনাক্ত করে।

থরহরিকম্পা পুলিশ রিপোর্টে অসহায় টেলিগ্রাম দেখা যায় "চড়া ইনাম ঘোষণা করেও যতীনের হদিশ মিলছে না। এখনো তিনি ছদ্মবেশে কলকাতায় বহাল তবিয়তে যাতায়াত করছেন, কিন্তু তাঁর মতো উগ্র চরিত্রের নাগাল পাবার যোগ্য চর পাওয়া দুর্লভ, বিশেষত সর্বদাই তিনি সশস্ত্র থাকেন"। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ "কলকাতায় Flying Squad, Armoured Car-এর সশস্ত্র পাহাড়ার ব্যবস্থা হল। বড় রাস্তাগুলিতে ড্রপ-গেট করা হল - রেললাইন বন্ধ করার যেরূপ লোহার পাল্লা খাড়া রাখা হয়, ঠিক তেমনি। থানায় সাইরেন বসানো হল। কলকাতা থেকে উত্তর ও পূর্বদিকে খাল পার হবার যত পোল আছে - চিৎপুর, টালা, বেলগেছে, মানিকতলা, নারকেলডাংগাহাওড়ার পোলে সশস্ত্র প্রহরী দেওয়া হল। যাকে-তাকে এবং যে-কোনও গাড়ীকে ধরে তল্লাশ করা হতে লাগল। **তথ্যসূত্র অস্পষ্ট, .......... ২য় সংস্করণ, ১৯৮২, পৃ. ৩২৮

কৃপাল সিং: বিশ্বাসঘাতক 'গদর' কর্মী[সম্পাদনা]

কোন মহৎ সাধনার পথে যতীন নেমেছেন, তা স্মরণে রেখে পুলিশের দেশী কর্মচারীরা পর্যন্ত মনেপ্রাণে যতীনের অনুরাগী হয়ে উঠলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জি। তিনি বিপ্লবীদের জব্দ করতে বদ্ধপরিকর। বারেবারে সুরেশের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে একদিন যতীন বললেন, "যতক্ষণ না সুরেশকে সরানো হচ্ছে, ততক্ষণ আমি জলস্পর্শ করব না"। ২৮/২/১৯১৫ তারিখে ভোরবেলা সুরেশ সদলবলে টহলে বেরিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লাট যাবেন-তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা পাকা করতে। নিপুণহাতে সুরেশকে নিধন করে যতীনের সহকারীরা গা ঢাকা দিলেন। এদেঁর কর্মতৎপরতায় এমনকি টেগার্টও মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে স্বীকৃতি জানিয়েছেন যে, বাঙ্গালী এই বিপ্লবীদের চরিত্রের সমতুল জগতে আর কোথাও পাওয়া বিরল। এদেঁর আত্মবিশ্বাস ও দেশের কাজের জন্য সর্বস্বত্যাগের ব্রত টেগার্টকে মনে করিয়ে দিয়েছে গাঁন্ধীর কথা।[১৫]

জটিল এই পরিস্থিতিতে যতীনের আর কলকাতা থাকা সমীচীন নয়, বিবেচনা করে তার শিষ্য ও সহকারীরা খুঁজে পেলেন বালেশ্বর (বালাসোর)-এর আশ্রয়। ওখানকার উপকূলেই জার্মান অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রধান জাহাজটি আসার কথা। তার প্রতীক্ষায় যতীন ওখানে চার-পাঁচজন কর্মীকে নিয়ে আস্তানা গাড়লেন। স্থানীয় অভিভাবকরূপে রইলেন মনীন্দ্র চক্রবর্তী। দীর্ঘ ছ'মাস তিনি বুকের পাঁজরের মতো আগলে থেকেছেন মহানায়কের এই অজ্ঞাতবাসের আস্তানা। যতীনকে বালেশ্বরে নিরাপদ দেখে নরেন ভট্টাচার্য (এম.এন. রায়) রওনা হলেন বাটাভিয়া অভিমুখে, বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশমাফিক; সেখানে হেলফেরিষ্‌ ভ্রাতাদের কাছে বিশদ অবগত হলেন জার্মান অস্ত্র নিয়ে জাহাজ আসার পাকা খবর; ফিরে এসে নাটকীয়ভাবে গুরুর চরণে একথলে মোহর ঢেলে দিয়ে প্রণাম করে জানালেন, জার্মান সহযোগিতার দরুন প্রাপ্য অর্থের এটি প্রথম কিস্তি। মনীন্দ্র সবই দেখেছেন। সবই জানতেন। বিশাল ঝুঁকি নিয়ে তবু তিনি এঁদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে এঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন।[১৬] ইতিমধ্যে রাসবিহারী'র প্রচেষ্টা যেমন উত্তরাঞ্চলে ভেস্তে যায় কৃপাল সিং নামে বিশ্বাসঘাতক 'গদর' কর্মীর জন্য, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে সমাগত বিপ্লবীরা ইন্দো-জার্মান সহযোগিতার সংবাদ ফাঁস করে দেয় মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের দপ্তরে-প্রতিদানে নিজেদের সংগ্রামের অনুকূল সহানুভূতি পাবার প্রত্যাশায়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের উদ্যোগে জার্মান সরকারের সংগে জার্মান বিভিন্ন দূতাবাসের পত্র ও তারবার্তা হস্তগত করে ব্যাপক এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের মূল উপড়ে ফেলতে উদ্যত হল সমবেত ব্রিটিশ ও মার্কিন সুরক্ষা বিভাগ।[১৭] পেনাং'এর একটি সংবাদপত্রের কাটিং থেকে যতীন খবর পেলেন যে, অস্ত্রশস্ত্রসমেত জাহাজ ধরা পড়ে গিয়েছে। মারাত্মক এই নিরাশায় তিনি ভেঙ্গে পড়বেন ভয় ছিল সহকারীদের। পরিবর্তে তিনি হেসে উঠলেন, যেন কিছুই তেমন ঘটেনি: "দেশের সুরাহা বাইরে থেকে নয়, তা আসবে অভ্যন্তর থেকে!" রোজ বিকেলে বনভূমির নীরব আশ্রয়ে যতীন গীতার ক্লাস নিতেন। শিষ্য নলিনীকান্ত কর তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "মনে হত যেন গৌতম মুনির কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে বেদমন্ত্র"। ক্লাসের শেষে অস্তসূর্যের আলোকে একাকী যতীন কিছুক্ষণ ধ্যান করতেন। একদিন মনীন্দ্রও বসে রইলেন। হঠাৎ যতীন অদূরবর্তী মনীন্দ্রের হাত ছুঁয়ে বলে উঠলেন: "ওই দ্যাখ! কৃষ্ণ আমাদের দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছেন!" মনীন্দ্র সেই দৃষ্টির অভাবে প্রত্যক্ষ করলেন-যতীনের স্পর্শে এক তীব্র পুলকের স্রোত।

বুড়ি বালামের তীরে খণ্ডযুদ্ধ ও যতীনের আত্মদান[সম্পাদনা]

কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাস চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই। দুর্গম ডুভিগর পর্বতশ্রেণী দিয়ে গা ঢাকা দেবার উপযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ যখন জল্পনা-কল্পনা করছেন, যতীন দৃঢ়স্বরে জানালেন, "আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরব। তাতেই দেশ জাগবে।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাত্রে যতীন নিজের সাময়িক আস্তানা মহলডিহাতে ফিরে এলেন। সঙ্গে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জঙ্গলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে। সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি অসংখ্য সশস্ত্র পুলিস ও সামরিক বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিল। পরীখার আড়ালে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন, হাতে মাউজার পিস্তল। যুদ্ধ শুরু হলে পুলিসের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী।[১৮][১৯] এই যুদ্ধের এমন নজির ইতঃপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সংগে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখনো রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন:

"এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।"

কয়েকটি পত্র[সম্পাদনা]

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি পত্রঃ-[সম্পাদনা]

[১৯১০ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে দিদি বিনোদবালা দেবীকে লেখা]

২০ অগাস্ট, ১৯১০-এর পত্র[সম্পাদনা]

[১৯১০ সালের ২০শে অগাস্ট জেল থেকে দিদিকে এই পত্রটি লেখা]

১৯১৫ সালের মে মাসের পত্র[সম্পাদনা]

[১৯১৫ সালের মে মাসে বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে এই চিঠিটি দিদি বিনোদবালাকে লেখা]

১৯১৫ সালের মে মাসে অজ্ঞাতবাস থেকে লেখা[সম্পাদনা]

[১৯১৫ সালের মে মাসে বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে যতীন্দ্রনাথ এই পত্রটি লেখেন ইন্দুবালা দেবীকে; স্ত্রীকে লেখা এটি তার একমাত্র পত্র যা রক্ষা করা গিয়েছে পুলিশের আক্রমণ থেকে। বছরে একবার অন্তত পুলিশে এসে খানাতল্লাস ক'রে যেত তার দিদি ও স্ত্রীর কাছে যদি দৈবাৎ আপত্তিজনক কিছু পাওয়া যায়-এই প্রত্যাশা নিয়ে। তাদেঁর মৃত্যুর আগে জ্যেষ্ঠা পুত্রবধু ঊষারাণী দেবীর হাতে তারা এই অমূল্য পত্রগুলি গচ্ছিত রেখে যান।]

কাব্যে[সম্পাদনা]

বাঘা যতীন ও তার সাথীদের অসমসাহসী যুদ্ধের কথা বাংলা কবিতায় প্রতিভাত হয়েছে দুই বিখ্যাত কবি দ্বারা। কাজী নজরুল ইসলামের প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের 'নব ভারতের হলদিঘাট' তাদের লড়াইকে স্মরণ করে রচিত। ১৯৩০ এর ডিসেম্বরে প্রলয় শিখা বইয়ের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনে সরকার। চারণ কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের 'বুড়িবালামের তীরে' তার বই সব হারানোর গান' এ স্থান পেয়েছে।[২০]

চলচ্চিত্র[সম্পাদনা]

বাঘা যতীনের জীবনকাহিনী নিয়ে বাংলা সিনেমা 'বাঘা যতীন' প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। অভিনয় করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, নিমু ভৌমিক, ছায়া দেবী প্রমুখ।

গ্যালারি[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Nixon Report", in Terrorism in Bengal,[abbreviation Terrorism] Edited and Compiled by A.K. Samanta, Government of West Bengal, Calcutta, 1995, Vol. II, p.625.
  2. যতীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের বহু তথ্য পাওয়া গেছে তাঁর দিদি বিনোদবালা দেবীর লিখিত খাতায়। তাঁর ছোট মামা ও প্রথম পর্বের বিপ্লবী সহকর্মী ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা তিনটি পুস্তকেও বহু সংবাদ পাওয়া যায়: "দুর্গোৎসব", কৃষ্ণনগর, ১৯৩৬, পৃঃ ৩১, "পারিবারিক কথা", কৃষ্ণনগর, ১৯৪৭ পৃঃ ১০২, "বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ", বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৪৭, পৃঃ ৮২ (ভূমিকা) ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)।
  3. বিমান বিহারী মজুমদার্‌ "Militant Nationalism in India", কলকাতা, ১৯৬৬, পৃঃ ১১১।
  4. “Terrorism in Bengal”, Government of West Bengal, 1995, Vol. V, p. 63 (Sealy's report)
  5. যতীন্দ্রনাথে যৌবনের বন্ধু ও সহকর্মী ভবভূষণ মিত্র (স্বামী সত্যানন্দ) এমন বহু দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকা থেকে লিখে রেখেছিলেন।
  6. India under Morley and Minto, M.N. Das, George Allen and Unwin, London, 1964, p. 25
  7. Political Trouble in India: 1907-1917, James Campbell Ker, 1917-1973 First Reprint, Delhi, p. 9; Tegart's Report in Terrorism in India, Vol. IV, p. 1366
  8. Two Great Indian Revolutionaries, Uma Mukherjee, 1966, p. 166
  9. First Spark of Revolution, Arun Chandra Guha, 1971, p. 161
  10. India under Murley and Minto, p. 122
  11. Terrorism in Bengal, Vol. II, p. 625 (Nixon's Report)
  12. Two Great ....., p. 119; also Jadugopal Mukharjee's Biplabi jivaner smriti, 2nd ed., p. 537
  13. Terrorism........, Vol. III, p. 505 (Tegart's Report)
  14. Rowlatt Report, p. 68-71 ("Notable leaders, Jatin Mukherjee and Bepin Ganguli")
  15. Terrorism........, Vol. III, Introduction, XIX)
  16. মনীন্দ্র চক্রবর্তীর খাতা থেকে, নলীনিকান্ত করের লিখিত বিবৃতিও
  17. CSmagasin, Ross Hedvisek, Spren 2006
  18. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৭৩।
  19. শৈলেশ দে, মৃত্যুর চেয়ে বড়, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলিকাতা, প্রথম (বি) সংস্করণ অগ্রহায়ণ ১৩৯২, পৃষ্ঠা ১২১-১২৬।
  20. পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (২০১০)। বাঘা যতীন। কলকাতা: দেজ পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ১২৪, ১২৫। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]