বিষয়বস্তুতে চলুন

বরিশালি উপভাষা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বরিশালি বাংলা
বরিশাইল্লা বাংলা
দেশোদ্ভববাংলাদেশ
অঞ্চলবরিশাল বিভাগ
জাতিবাঙালি জাতি
মাতৃভাষী

বাংলা বর্ণমালা
ভাষা কোডসমূহ
আইএসও ৬৩৯-৩
গ্লোটোলগvang1242  (Vanga বঙ্গ)[]
বাংলাদেশের মানচিত্রে বরিশাল বিভাগ

বরিশালি বাংলা বা বরিশালি উপভাষা হলো বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে প্রচলিত বাংলা ভাষার একটি উপভাষা। এটি প্রথমে অবিভক্ত বঙ্গের বাকেরগঞ্জ জেলা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের কথ্য বাংলা উপভাষা। এটি বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী এবং পিরোজপুর জেলার বাঙালিদের প্রধান উপভাষা।[] এছাড়া ভোলা, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জখুলনার কিছু অংশের মানুষও এ উপভাষায় কথা বলে। বরিশালি বাংলা মূলত বাংলা ভাষার বঙ্গ উপভাষার অন্তর্গত একটি খণ্ড-উপভাষা।

বিস্তার

[সম্পাদনা]

বরিশালি বাংলা মূলত বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, এবং পিরোজপুর জেলার বাঙালিদের প্রধান বাংলা উপভাষা। এছাড়া পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীপুর জেলা, খুলনা এবং ঢাকা বিভাগের অনেক অঞ্চলের মানুষও এই উপভাষায় কথা বলে।

বৈশিষ্ট্য

[সম্পাদনা]

বাংলা ভাষার অন্যান্য সকল বঙ্গালী উপভাষাগুলোর মতো বরিশালী বাংলাতেও একই ধরনের ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক এবং বাক্য তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও বরিশালি বাংলায় সাহিত্যিক বাংলার শুদ্ধ ক্রিয়াপদের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় এবং এটি প্রমিত উচ্চারণসহ বাংলার অন্যান্য উপভাষার সঙ্গেও বেশ বোধগম্য।[] এটিকে প্রধানত "কেন্দ্রীয় পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা" উপভাষাগুচ্ছের একটি খণ্ড-উপভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। বরিশালি বাংলা পার্শ্ববর্তী ঢাকা-বিক্রমপুরী বাংলার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় একটি উপভাষা।

ধ্বনিতাত্ত্বিক

[সম্পাদনা]
  1. ই,উ স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে অপিনিহিতির ব্যবহার লক্ষণীয়। যথাঃ- রাখিয়া>রাইখ্যা, আজি>আইজ
  2. “এ” কারের উচ্চারণ অনেক সময় “এ্যা” হয়। যথা- বেল>ব্যাল, মেঘ>ম্যাগ
  3. কখনাে কখনাে অনুনাসিক স্বরধ্বনিতে অর্ধঅনুনাসিকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যথাঃ চাঁদা>চান্দা, আঁধার>আন্ধার।
  4. মহাপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি হয়, যথাঃ দুধ>দুদ, ভাত>বাত।
  5. পদের আদ্যাক্ষর “শ” “ষ” “স” ধ্বনি “হ” ধবনিতে পরিবর্তিত হয়। যথা- শালিক>হালিক, শামুক>হামুক, সকাল>হকাল, শৌল>হৌল, শালা>হালা, শশুর>হউর, শাড়ী>হাড়ী ইত্যাদি।
  6. অন্ত “ক” ও “খ” ধ্বনি “হ” ধ্বনি হয়। যথা- টাকা>টাহা, দেখা>দেহা।
  7. অনেক সময় “র” ধ্বনি “ল” হয়। যথাঃ শরীর>শরীল।
  8. কখনাে কখনাে “ল” এর উচ্চারণ “ন” হয়। যথাঃ লাঙ্গল>নাঙ্গল।

রূপতাত্ত্বিক

[সম্পাদনা]
  1. কর্মসম্প্রদানের একবচনে “রে” বিভক্তি, যথাঃ হ্যারে কও = তাকে বল।
  2. কর্তৃকারকে এক বচনে “এ্যা” বিভক্তি। যথাঃ সফিজ্যা বাড়ী গেছে, করিম্যা একটু এদিগে আয় তো।
  3. করণকারকে “এ্যা” বিভক্তি। যথাঃ লাডি দিয়্যা পিডাও।
  4. কর্তৃকারক ছাড়া অন্য সব কারকের বহুবচনে “গো” ব্যবহৃত হয়। যেমন: মোগো (মোদের), তোমাগো (তোমাদের), তোগো (তোদের) ইত্যাদি।
  5. বাংলার সাধু এবং চলিত উভয় রূপের মতোই মধ্যম পুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎ কালের বিভক্তি হলো “ইবে” অথবা “বে”। যেমন: তুমি বাড়ি যাইবে?, করিম্যা কি নাচবে?
  6. ভবিষ্যতকালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়া পদে ‘উম' অথবা 'মু' বিভক্তি। যথাঃ করমু/করুম, খামু, যামু, মারমু/মারুম ইত্যাদি।

বাক্য তাত্ত্বিক

[সম্পাদনা]

তুমি কাজটা করে দাও = তুমি কামডা কইররা দেও, তুমি কি কাইল গেছিলা? = তুমি কি কাল গেছিলে?, আমনে কিন্তু খাইয়া যাইবেন = আপনি কিন্তু খেয়ে যাবেন, মোর মনে হয় এহন একটা বাজে = আমার মনে হয় এখন একটা বাজে, আইজ মোরা ঘোরতে যামু = আজ আমরা ঘুরতে যাবো, এহন কি করমু? = এখন কি করবো? ইত্যাদি।

শব্দ কোষ

[সম্পাদনা]

বাংলার প্রমিত উচ্চারণ থেকে ভিন্ন বরিশালি বাংলা উপভাষায় প্রচলিত কিছু শব্দ নিচে দেয়া হলো।

অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বাচক

থােরা = উরু, আঁডু = হাঁটু, ঘেডি = ঘেটি/ঘাড়, গুরমুইর‍্যা = পায়ের গােড়ালী, কেতকুলি = বগল, মাথার তাউল্লা = মাথার তালু, জিবরা/টাগরা = জিহ্বা, থোতমা = থুতনী, কুচকি = কুচকি, ফানা/কচুডি পানা = কচুরি পানা, কোলা/জমিন = খোলা মাঠ/জমি ইত্যাদি ।

জীবজন্ত বাচক

জেডি = টিকটিকি, তেলাচোরা = তেলাপোকা/আরশোলা, বরিছাগল = ছাগী, মুরহা/মুরহী= মুরগী, চাউম্যা= এক প্রকার চিংড়ি মাছ, পাতিহিয়াল= খেকশিয়াল, উটকল/লাডা মাছ = ল্যাঠা মাছ, চ্যাং মাছ/টাহি মাছ = টাকী মাছ, গাই = গাই/গাভী ইত্যাদি।

উদ্ভিদ বাচক

হিদলা = শেওলা, হউরা/সইষ্যা = সরিষা, নারহৈল = নারকেল, উশ্যি = শিম, কাহই = কাকরােল, শেরেজ গাছ/রেন্ডী গাছ = রেইন ট্রি, হডি গাছ = শটি গাছ , চাম্বল = চম্বল গাছ ইত্যাদি ।

বিবিধ শব্দ

প্যানাপােডা = প্যাঁচাল/অনর্থক কথাবার্তা, খ্যামা দেওয়া = থেমে যাওয়া, মানা করা = মানা করা/নিষেধ করা/বারন করা, হান্দাইয়া যাওয়া = সেঁধিয়ে যাওয়া, অদ = গর্ত, রান্দা = রান্না, ওশ্যা ঘর = রান্না ঘর, দাউর = লাকরী, বরক = কলাপাতা, হিলাই = সেলাই, জিল্লি মারা = বিদ্যুত চমকানাে, ড্যাবরা = বামহাতী, দেউরহা = চেরাগদানী, আউত্তা = মাটির পেয়ালাবিশেষ, ছিলা = ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পথ, কাইনাড়ী = ঘরের পিছন ইত্যাদি।

মাসের নাম
প্রমিত বাংলা বরিশালি বাংলা
বৈশাখ বৈশাক,
জ্যৈষ্ঠ জৈষ্ট,
আষাঢ় আষাঢ়,
শ্রাবণ ছেরাবন,
ভাদ্র ভাদ্দর,
আশ্বিন আশ্বিন
কার্তিক কাত্তিক
অগ্রহায়ণ/অঘ্রান অগ্রান,
পৌষ পৌষ
মাঘ মাগ,
ফাল্গুন/ফাগুন ফাগুন
চৈত্র চত্তির

রচিত বই

[সম্পাদনা]
  • ভাটিপু্ত্রের বরিশালি গদ্যসংগ্রহ - মিহির সেনগুপ্তের বরিশালি উপভাষায় রচিত বই।
  • বরিশালের উপভাষার অভিধান - কাগজ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত মুহাম্মাদ মহসিন রচিত অভিধান গ্রন্থ।[]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. হ্যামারস্ট্রোম, হারাল্ড; ফোরকেল, রবার্ট; হাস্পেলম্যাথ, মার্টিন, সম্পাদকগণ (২০১৭)। "Vanga বঙ্গ"গ্লোটোলগ ৩.০ (ইংরেজি ভাষায়)। জেনা, জার্মানি: মানব ইতিহাস বিজ্ঞানের জন্য ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট। 
  2. দেব, শুদ্ধব্রত। "পড়তেও কলজের ধক লাগে"anandabazar.com। ২০১৮-১২-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২২ 
  3. The Calcutta Review (English ভাষায়)। Thomas S. Smith, City Press। ১৮৭৫। পৃষ্ঠা 50। 
  4. "বরিশালের উপভাষার একটি অভিধান"ঢাকা ট্রিবিউন। ২০১৮-০৩-১৩। ২০১৮-০৩-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২২ 

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]
  • খান, শামসুজ্জামান (২০১৪), "লোকজ ভাষা", বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালাঃ বরগুনা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, আইএসবিএন 984-07-5349-5 
  • শহীদুল্লাহ্, ড. মুহাম্মাদ, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমি