কাশী বিশ্বনাথ মন্দির
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির হিন্দি: काशी विश्वनाथ मंदिर | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | বারাণসী |
অবস্থান | |
অবস্থান | বারাণসী |
রাজ্য | উত্তরপ্রদেশ |
দেশ | ভারত |
স্থাপত্য | |
ধরন | মন্দির |
সৃষ্টিকারী | মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার |
ওয়েবসাইট | |
shrikashivishwanath.org |
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভারতের একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসীতে অবস্থিত। মন্দিরটি গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির "জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির" নামে পরিচিত শিবের বারোটি পবিত্রতম মন্দিরের অন্যতম। মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব "বিশ্বনাথ" বা "বিশ্বেশ্বর" নামে পূজিত হন। বারাণসী শহরের অপর নাম "কাশী" এই কারণে মন্দিরটি "কাশী বিশ্বনাথ মন্দির" নামে পরিচিত। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে।[১]
হিন্দু পুরাণে এই মন্দিরটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরটি শৈবধর্মের প্রধান কেন্দ্রগুলির অন্যতম। অতীতে বহুবার এই মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের পাশে জ্ঞানবাপী মসজিদ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। আদি মন্দিরটি এই মসজিদের জায়গাটিতেই অবস্থিত ছিল।[২] বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার তৈরি করে দেন।[৩] ১৯৮৩ সাল থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার এই মন্দিরটি পরিচালনা করে আসছেন।
শৈবধর্ম |
---|
সংক্রান্ত একটি ধারাবাহিকের অংশ |
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]শিবপুরাণ অনুসারে, একবার সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ও রক্ষাকর্তা বিষ্ণু তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে বিবাদে রত হন।[৪] তাদের পরীক্ষা করার জন্য শিব ত্রিভুবনকে ভেদ করে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে এক বিশাল অন্তহীন আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন। বিষ্ণু ও ব্রহ্মা এই লিঙ্গের উৎস অনুসন্ধান করতে যান। ব্রহ্মা যান উপর দিকে এবং বিষ্ণু নামেন নিচের দিকে। কিন্তু তারা কেউই এই লিঙ্গের উৎস খুঁজে পাননা। ব্রহ্মা মিথ্যা বলেন যে তিনি উৎসটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণু তার পরাজয় স্বীকার করে নেন। শিব তখন একটি দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে মিথ্যা বলার জন্য ব্রহ্মাকে শাপ দেন যে অনুষ্ঠানে তার কোনো স্থান হবে না। অন্যদিকে সত্য কথা বলার জন্য তিনি বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করে বলেন যে সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত তিনি পূজিত হবেন। জ্যোতির্লিঙ্গ হল সেই অখণ্ড সর্বোচ্চ সত্যের প্রতীক, যার অংশ শিব নিজে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরগুলিতে শিব স্বয়ং অগ্নিময় আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।[৫][৬] শিবের ৬৪টি রূপভেদ রয়েছে। তবে এগুলির সঙ্গে জ্যোতির্লিঙ্গকে এক করা হয় না। প্রত্যেক জ্যোতির্লিঙ্গের নির্দিষ্ট নাম আছে – এগুলি শিবের এক এক রূপ।[৭] প্রতিটি মন্দিরেই শিবলিঙ্গ শিবের অনন্ত প্রকৃতির প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের প্রতিনিধিত্ব করে।[৭][৮][৯] বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল গুজরাতের সোমনাথ, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমের মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, মধ্যপ্রদেশের ওঙ্কারেশ্বর, হিমালয়ের কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের ভীমশংকর, উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর বিশ্বনাথ, মহারাষ্ট্রের ত্র্যম্বকেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ, গুজরাতের দ্বারকায় নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদের ঘৃষ্ণেরশ্বর।[৪][১০]
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছে মণিকর্ণিকা ঘাট শাক্তদের পবিত্র তীর্থ অন্যতম শক্তিপীঠ। শৈব সাহিত্যে দক্ষযজ্ঞের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা শক্তিপীঠের উৎস-সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক আখ্যান।[১১] কথিত আছে, সতীর দেহত্যাগের পর শিব মণিকর্ণিকা ঘাট দিয়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে এসেছিলেন।[১২][১৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]স্কন্দ পুরাণের কাশীখণ্ডে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দীতে হরি চন্দ্র মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন।
মধ্যযুগ ও ধ্বংস
[সম্পাদনা]আদি বিশ্বনাথ মন্দির, প্রাথমিকভাবে আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত, ১১৯৪ সালে ঘুরি সুলতান মুহাম্মাদ ঘুরি বারাণসীর অন্যান্য মন্দিরগুলির সঙ্গে এই মন্দিরটিও ধ্বংস করে দেন , যখন তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং চন্দওয়ারের যুদ্ধে কনৌজের (বর্তমান ফিরোজাবাদ) গহদাবালা রাজবংশের জয়চন্দ্রকে পরাজিত করেন এবং পরে কাশী শহরটি ধ্বংস করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তার জায়গায় রাজিয়া মসজিদ নির্মিত হয়। ১২৩০ সালে, দিল্লির মামুলুক সুলতান ইলতুৎমিশের (১২১১-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে একজন গুজরাটি বণিক মূল স্থান থেকে দূরে আভিমুক্তেশ্বরা মন্দিরের কাছে মন্দিরটি পুনর্নির্মিত করেন। ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক এর শাসনামলে অনুগত জৌনপুর সুলতান হোসেন শাহ শর্কী মন্দিরটি আবার ধ্বংস করেন (মতান্তরে কেউ বলেন লোদি সুলতান সিকান্দার লোদি করেছিলেন। )।[২]
মুঘল আমল
[সম্পাদনা]১৫৮৫ সালে আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল আবার মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।[১৪] এরপর ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করান। এই মসজিদটি আজও মন্দিরের পাশে অবস্থিত।[১৫] মসজিদের পিছনে পুরনো মন্দিরের কিছু ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়।
মারাঠা ও ব্রিটিশ আমল
[সম্পাদনা]১৭৪২ সালে, মারাঠা শাসক প্রথম শাহু ভোসলের অধীনে পেশোয়া বালাজী বাজী রাও এর অনুগত মালহার রাও হোলকার মসজিদটি ভেঙে ফেলার এবং সেই স্থানে বিশ্বেশ্বর মন্দির পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন।
১৭৫০ সালের দিকে, জয়পুরের মহারাজা কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য জমি কেনার লক্ষ্যে জায়গাটির চারপাশের জমির জরিপ পরিচালনা করেন।
বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে মালহার রাও হোলকার এর পুত্রবধূ তথা হোল্কার রাজ্যের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার তৈরি করে দিয়েছিলেন।[৩] ১৮৩৫ সালে পাঞ্জাবের শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।[১৬]
স্বাধীনতা পরবর্তী
[সম্পাদনা]বিতর্কিত জ্ঞানবাপী মসজিদের পশ্চিম দিকে মা শ্রিংগার গৌরী মন্দিরের পূজা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর মসজিদ ধ্বংসের পর পরবর্তী মারাত্মক দাঙ্গার কারণে সীমাবদ্ধ ছিল।
২০১৯ সালে, কাশী বিশ্বনাথ করিডোর প্রকল্পটি মন্দির এবং গঙ্গা নদীর মধ্যে অ্যাক্সেস সহজ করার জন্য নরেন্দ্র মোদি দ্বারা চালু করা হয়েছিল, যাতে ভিড় রোধ করার জন্য একটি বিস্তৃত স্থান তৈরি করা হয়।
২০২১ সালের আগস্টে, পাঁচজন হিন্দু মহিলা মা শ্রিংগার গৌরী মন্দিরে প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়ার জন্য বারাণসীর একটি স্থানীয় আদালতে আবেদন করেছিলেন।
১৩ ডিসেম্বর ২০২১-এ, মোদী একটি পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করিডোরটি উদ্বোধন করেছিলেন। সরকারের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে করিডোর এলাকার মধ্যে প্রায় ১,৪০০ জন বাসিন্দা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এটি আরও বলে যে গঙ্গেশ্বর মহাদেব মন্দির, মনোকমেশ্বর মহাদেব মন্দির, জৌবিনায়ক মন্দির এবং শ্রী কুম্ভ মহাদেব মন্দির সহ 40 টিরও বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত, শতাব্দী প্রাচীন মন্দির পাওয়া গেছে এবং পুনর্নির্মিত হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দক্ষিণ ভারতের একজন বেনামী দাতা মন্দিরে ৬০ কেজি সোনা দান করার পরে মন্দিরের গর্ভগৃহটি সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল।
মন্দির
[সম্পাদনা]মন্দির চত্বরটি অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দির নিয়ে গঠিত। এই মন্দিরগুলি গঙ্গার তীরে "বিশ্বনাথ গলি" নামে একটি গলিতে অবস্থিত। প্রধান মন্দিরের মধ্যে একটি ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু ও ৯০ সেন্টিমিটার পরিধির শিবলিঙ্গ রুপোর বেদির উপর স্থাপিত।[১] ছোটো মন্দিরগুলির নাম কালভৈরব, দণ্ডপাণি, অবিমুক্তেশ্বর, বিষ্ণু, বিনায়ক, শনীশ্বর, বিরূপাক্ষ ও বিরূপাক্ষ গৌরী মন্দির। মন্দিরের মধ্যে জ্ঞানবাপী নামে একটি ছোটো কুয়ো আছে। কথিত আছে, মুসলমান আক্রমণের সময় প্রধান পুরোহিত স্বয়ং জ্যোতির্লিঙ্গটি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেটি নিয়ে এই কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
মন্দিরের কাঠামো তিনটি অংশে গঠিত। প্রথমটি মন্দিরের উপর একটি স্পায়ার আপস করে। দ্বিতীয়টি হল সোনার গম্বুজ এবং তৃতীয়টি হল একটি পতাকা এবং একটি ত্রিশূল বহনকারী গর্ভগৃহের উপরে সোনার চূড়া ।
গুরুত্ব
[সম্পাদনা]কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্রতম মন্দিরগুলির অন্যতম। আদি শঙ্করাচার্য, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, গোস্বামী তুলসীদাস, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, গুরু নানক প্রমুখ ধর্মনেতারা এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন।[১৫] হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, গঙ্গায় একটি ডুব দিয়ে এই মন্দির দর্শন করলে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "Cultural holidays - Kashi Vishwanath temple"। ৮ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১১।
- ↑ ক খ Koenraad Elst (১৯৯০)। Ram Janmabhoomi vs. Babri Masjid, A Case Study in Hindu-Muslim Conflict। উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "ramjanma" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে - ↑ ক খ "Shri Kashi Vishwanath Temple - A Brief history"। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১১।
- ↑ ক খ R. 2003, pp. 92-95
- ↑ Eck 1999, p. 107
- ↑ See: Gwynne 2008, Section on Char Dham
- ↑ ক খ Lochtefeld 2002, pp. 324-325
- ↑ Harding 1998, pp. 158-158
- ↑ Vivekananda Vol. 4
- ↑ Chaturvedi 2006, pp. 58-72
- ↑ (Translator), F. Max Muller (জুন ১, ২০০৪)। The Upanishads, Vol I। Kessinger Publishing, LLC। আইএসবিএন 1419186418।
- ↑ (Translator), F. Max Muller (জুলাই ২৬, ২০০৪)। The Upanishads Part II: The Sacred Books of the East Part Fifteen। Kessinger Publishing, LLC। আইএসবিএন 1417930160।
- ↑ "Kottiyoor Devaswam Temple Administration Portal"। http://kottiyoordevaswom.com/। Kottiyoor Devaswam। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুলাই ২০১৩।
|কর্ম=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ "The Temple of Vishwanath"।
- ↑ ক খ "History!Kashi Vishwanath temple"। ১৯ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১১।
- ↑ "The Kashi Vishwanath Temple"। ৭ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১১।