নাগেশ্বর মন্দির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ
নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাদ্বারকা
অবস্থান
দেশভারত

নাগেশ্বর মন্দির ভারতএর গুজরাত রাজ্যে অবস্থিত হিন্দুদের এক অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান। গুজরাতের জামনগরে অবস্থিত এই মন্দিরের শিবলিংগকে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দ্বাদশ জ্যোতির্লিংগের অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানে এই মন্দির ঐতিহাসিক কাল থেকে ভক্তদের জন্য আকর্ষণের স্থল হয়ে আসছে। শিব উপাসকরা নাগেশ্বর মন্দিরের জ্যোতির্লিংগ দর্শন পরম পবিত্র বলে গণ্য করে।

নাগেশ্বর জ্যোতির্লিংগ মন্দির, জামনগর, গুজরাত
নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ

পুরাণ বর্ণিত আখ্যান[সম্পাদনা]

শিব পুরাণ অনুসারে, এই অঞ্চলে পুরাকালে দারুক নামে এক রাক্ষস রাজত্ব করত। দারুকের উৎপাতে সব মানুষ পরিত্রাণের জন্য মধুসূদন সুঁবরিব লগাত পরিছিল। দারুকের পত্নী ছিল দারুকী। দারুকী দেবী পার্বতীর উপাসিকা ছিল। পার্বতী দারুকীর প্রতি সন্ত্তষ্ট হয়ে তাঁদের রাজত্ব করা অরণ্যটির নাম দারুকবন আখ্যা দেন। সঙ্গে এই আশীর্বাদ প্রদান করেন যে, দারুকী যেখান দিয়েই যাবে দারুকবনও সেই স্থান দিয়ে গমন করবে। পরবর্তী সময়ে দেবতারা দারুকের রাজ্য আক্রমণ করায় দারুক নিজ পত্নীকে পার্বতীর বরদান সুপ্রয়োগ করার জন্য আদেশ দেয়। সেই হিসাবে দারুকী সাগরতীর দিয়ে পলায়ন করে এবং দারুকবনও সেই জায়গা দিয়ে গমন করে। নিরাপদ স্থান থেকে দারুক পুনরায় সকলের উপর অত্যাচার আরম্ভ করার জন্য ধরে। এবার দারুক সুপ্রিয় নামে একজন লোক এবং তাঁর সহচরদের অপহরণ করে বন্দী করে রাখে। সুপ্রিয় ছিল মহাদেবএর পরম উপাসক। সুপ্রিয় বন্দীগৃহে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে শিবলিংগ স্থাপন করে মহাদেবের স্ত্ততি আরম্ভ করে। সুপ্রিয়র প্রার্থনােত সন্ত্তষ্ট হয়ে মহাদেব দর্শন দেন এবং দারুককে বধ করার জন্য সুপ্রিয়কে অস্ত্র প্রদান করেন। মহাদেবের বরদানে ধন্য হয়ে সুপ্রিয় দারুককে বধ করতে সক্ষম হয়। এর পর সুপ্রিয় মহাদেবকে সেই স্থানে বিরাজমান হয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করায় মহাদেব নিজ জ্যোতি দ্বারা জ্যোতির্লিংগ স্থাপন করে নিজ ভক্তের মনোকামনা পূরণ করেন। [১] এই মন্দিরে মহাদেবকে নাগেশ্বর অর্থাৎ নাগ (সাপ)এর ঈশ্বর রূপে পূজা করা হয়। দেবী পার্বতী এই স্থানে নাগেশ্বরী রূপে বিরাজিতা আছেন বলে ভক্তরা বিশ্বাস করে।

উত্তরাঞ্চলের আলমোরায় অবস্থিত যোগেশ্বর মন্দির। মন্দিরের কাছে অবস্থিত পবিত্র দেবদারু গাছের বনানি

মন্দিরের অবস্থিতি সম্পর্কে মতবিরোধ[সম্পাদনা]

নাগেশ্বর জ্যোতির্লিংগের প্রকৃত অবস্থিতি নিয়ে ভক্তদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ দেখা যায়। পৌরাণিক আখ্যান বর্ণিত সেই দারুকবন আসলে কোন স্থান ছিল সেটি সঠিক ভাবে জানার উপায় নেই। একাংশ নাগেশ্বর মন্দিরের বর্তমান স্থান গুজরাতের বিরোধ করে বলে যে, মহাকাব্যে বর্ণিত দ্বারকাবনকে একাংশ দারুকবন আখ্যা দিয়ে নাগেশ্বর মন্দিরের স্থান গুজরাত বলে বিভ্রান্ত করছে। পৌরাণিক আখ্যান সমূহে দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণএর সোমনাথ মন্দিরএর উপাসনা করার কথা জানা যায়, যদিও নাগেশ্বর মন্দিরের দ্বারকা (বা গুজরাতে) অবস্থিতি সম্পর্কে কোনো বর্ণিত আখ্যান নেই। তারা বলেন যে, দারুকবন শব্দটি আসলে দারু-বন (বা দেবদারু গাছে পরিপূর্ণ বনানি) শব্দ থেকে এসেছে। সেই হিসাবে গুজরাতে দারুকবন ছিল বলে কেউ কেউ কল্পনা করতে অস্বীকার করেন । কারণ দেবদারু গাছের আধিক্য গুজরাত অঞ্চলে দেখা যায় না। দেবদারু গাছে পরিপূর্ণ দারুকবনের ভিত্তিতে তাঁরা নাগেশ্বর জ্যোতির্লিংগের প্রকৃত অবস্থান হিমালয়এর পাদদেশের উত্তরাঞ্চলে বলে মতপোষণ করেন। উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত যোগেশ্বর মন্দিরই প্রকৃত নাগেশ্বর জ্যোতির্লিংগ বলে একাংশ দাবী উত্থাপন করি আসছেন। [২]

গল্প[সম্পাদনা]

এই জ্যোতির্লিঙ্গ সম্বন্ধে পুরাণে এই কাহিনী বর্ণিত আছে-

সুপ্রিয়া নামে একজন অত্যন্ত ধার্মিক ও গুণী বৈশ্য ছিলেন। তিনি শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি নিরন্তর তাঁর উপাসনা, উপাসনা ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি শিবকে নিবেদন করে তাঁর সমস্ত কাজ করতেন। তিনি তাঁর মন, কথা ও কাজের মাধ্যমে শিবের আরাধনায় মগ্ন ছিলেন।শিবের প্রতি ভক্তির কারণে দারুক নামক এক রাক্ষস খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছিল। ডান|থাম্ব|নাগেশ্বর জ্যোতির্লিং মন্দির alt=नागेश्वर ज्योतिर्लिंग मंदिर|বাম|থাম্ব|300x300পিক্সেল|নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ভগবান শিবের এই পূজা তিনি কোনোভাবেই পছন্দ করেননি। প্রেয়সীর পূজায় প্রতিনিয়ত বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করতেন। একবার সুপ্রিয়া নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছিলেন। সেই দুষ্ট রাক্ষস দারুক, এই সুবিধাজনক মুহুর্তে, নৌকা আক্রমণ করে। তিনি নৌকায় আরোহী সকল যাত্রীকে ধরে তার রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে বন্দী করেন। এমনকি জেলে, সুপ্রিয়া তার প্রতিদিনের রুটিন অনুসারে ভগবান শিবের পূজা শুরু করেছিলেন।

তিনি অন্যান্য বন্দী যাত্রীদেরও শিবভক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। দারুক যখন তার চাকরদের কাছ থেকে সুপ্রিয়ার সম্পর্কে এই খবর শুনল, তখন সে খুব রেগে গেল এবং কারাগারে পৌঁছে গেল। সেই সময় সুপ্রিয়া দুই চোখ বন্ধ করে শিবের পায়ের কাছে ধ্যান করছিলেন। তার এই ভঙ্গি দেখে রাক্ষস তাকে খুব উগ্র স্বরে বকাঝকা করে বললো- 'ওহে দুষ্ট বৈশ্য! এই সময়ে চোখ বন্ধ করে কী ধরনের ঝামেলা ও ষড়যন্ত্রের কথা ভাবছেন?' একথা বলার পরও গুণী শিবভক্ত সুপ্রিয়ার সমাধি বিঘ্নিত হয়নি। এবার সেই রাক্ষস দারুক রাগে একেবারে পাগল হয়ে গেল। তিনি অবিলম্বে তার অনুগামীদের সুপ্রিয়া এবং অন্যান্য সমস্ত বন্দীদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। তার আদেশে সুপ্রিয়া মোটেও বিরক্ত বা ভীত হননি।

একাগ্র চিত্তে তিনি নিজের এবং অন্যান্য বন্দীদের মুক্তির জন্য ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে আমার প্রিয় ভগবান শিব অবশ্যই আমাকে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবেন। তাঁর প্রার্থনা শুনে ভগবান শঙ্করজী তৎক্ষণাৎ জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হলেন, সেই কারাগারের একটি উঁচু স্থানে একটি উজ্জ্বল সিংহাসনে উপবিষ্ট হলেন।

এভাবে সুপ্রিয়াকে দর্শন দেওয়ার পর তার পাশুপত অস্ত্রও তাকে দিয়ে দেন। এই অস্ত্র দিয়ে রাক্ষস দারুক ও তার সহকারীকে বধ করার পর তিনি চলে যান প্রিয় শিবধামে। ভগবান শিবের আদেশ অনুসারে এই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম হয় নাগেশ্বর।

পরে এই স্থানে একটি বড় আড়দক সরোবর নির্মিত হয়।

আর জ্যোতির্লিঙ্গ সেই হ্রদে বিলীন হয়ে গেল।

পাণ্ডব যুগের ইতিহাস ,

যুগ পেরিয়ে দ্বাপর যুগ এলো, শ্রী কৃষ্ণের জন্ম যুগ।

পাঁচ পাণ্ডব যখন জুয়ার খেলায় কৌরবদের কাছে পরাজিত হন, তখন জুয়ার শর্তানুযায়ী, পাণ্ডবদের 12 বছরের বনবাস এবং এক বছরের বনবাসের শাস্তি হয়।ইতিমধ্যে পাণ্ডবরা ভারতবর্ষে ভ্রমণ করেন।ঘোরাঘুরি করতে করতে তিনি এই দারুকভানে আসেন এবং এই স্থানে তার সাথে একটি গরু ছিল, সেই গাভী প্রতিদিন হ্রদে নেমে দুধ দিত।একবার ভীম এটা দেখে পরের দিন গরুটিকে অনুসরণ করে হ্রদে নেমে গেলেন এবং মহাদেবকে দেখে দেখলেন যে গরুটি প্রতিদিন শিবলিঙ্গে দুধ দিচ্ছে।তখন পাঁচ পাণ্ডব সেই হ্রদ ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন।এবং সাহসী ভীম তার গদা দিয়ে সেই হ্রদের চারিদিকে আঘাত করলেন এবং সবাই মহাদেবের এই শিবলিঙ্গটি দেখতে পেলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সেই শিবলিঙ্গের কথা বললেন এবং বললেন যে এই শিবলিঙ্গটি সাধারণ শিবলিঙ্গ নয়, এটি নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ।তারপর পাঁচ পাণ্ডব সেই জায়গায় নিচতলায় অবস্থিত জ্যোতির্লিঙ্গের একটি বিশাল একশিলা পাথরের মন্দির তৈরি করেছিলেন


যাদব আমলের ইতিহাস ,

এবং আবার সময়ের সাথে সাথে বর্তমান মন্দিরটি সেউনা ( যাদব ) রাজবংশ দ্বারা হেমাদপন্থী শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল এবং বলা হয় যে এটি 13 শতকের, একটি সাত তলা পাথরের ভবন।


1600 শতাব্দীর পরের ইতিহাস ,

পরে আওরঙ্গজেব ছত্রপতি সম্ভাজি মহারাজের রাজত্বকালে এই মন্দিরের ভবনগুলি ধ্বংস করেন, আওরঙ্গজেবের বিজয়ের সময় এই মন্দিরটি ধ্বংস হয় ।মন্দিরের বর্তমান স্থায়ী চূড়াটি অহিল্যাবাই হোলকার দ্বারা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।

এবং আমরা আজও তা দেখতে পাই।


প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এই মন্দিরে আসেন। মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে সবচেয়ে বড় মেলা বসে এবং রথোৎসব পালিত হয়। মহাশিবরাত্রির ঠিক 5 দিন পর রথোৎসব পালিত করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Chaturvedi, B. K. (2006), Shiv Purana (First ed.), New Delhi: Diamond Pocket Books (P) Ltd, আইএসবিএন ৮১-৭১৮২-৭২১-৭
  2. Lochtefeld, James G. (2002), The Illustrated Encyclopedia of Hinduism: A-M, Rosen Publishing Group, p. 122, আইএসবিএন ০-৮২৩৯-৩১৭৯-X

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]