খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ
খাদিজা | |
---|---|
خديجة | |
![]() | |
জন্ম | খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ৫৫৫[১] খ্রিঃ অথবা ৫৬৭ খ্রিঃ |
মৃত্যু | ১০ রমজান (প্রাচীন আরবি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী)[২] ২২ নভেম্বর[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ৬১৯ (বয়স ৬৩–৬৪) অথবা ৬১৯ (বয়স ৫১–৫২) মক্কা |
সমাধি | জান্নাতুল মুয়াল্লা, মক্কা |
অন্যান্য নাম | খাদিজাতুল কুবরা |
পরিচিতির কারণ | ইসলামের নবী মুহাম্মাদের প্রথম স্ত্রী, মুমিনদের মাতা |
উপাধি | উম্মাহাতুল মুমিনীন, আমিরাত-কুরাইশ, আল-তাহিরা |
দাম্পত্য সঙ্গী |
|
সন্তান | পুত্রগণ: ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আতিক, হালাহ ইবনে আবি হালাহ, হিন্দ ইবনে আবি হালাহ, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ, আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ কন্যাগণ: হিন্দা বিনতে ‘আতিক, জয়নব বিনতে আবি হালাহ, জয়নব বিনতে মুহাম্মাদ, রুকাইয়াহ বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মে কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ |
পিতা-মাতা |
|
আত্মীয় | নাতিঃ হাসান ইবনে আলী, হোসাইন ইবনে আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে উসমান নাতনিঃ উমামা বিনতে আবিল আস, জয়নব বিনতে আলী, উম্মে কুলসুম বিনতে আলী আসাদ বিন আল-উজ্জা (দাদা) হালা বিনতে খুওয়াইলিদ (বোন) ওয়ারাকা ইবনে নওফল (চাচাতো ভাই) |
পরিবার | আহল আল-বাইত (বিবাহের পর) |
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (আরবি: خَدِيجَة بِنْت خُوَيْلِد, প্রতিবর্ণী. খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ; আনু. ৫৫৫ – ৬২০[৩]), যিনি সাধারণত খাদিজা নামে পরিচিত, ছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদের প্রথম স্ত্রী[৪] এবং প্রথম অনুসারী। খাদিজা ছিলেন মক্কার কুরাইশ উপজাতির নেতা খুওয়ালিদ ইবনে আসাদের কন্যা এবং নিজ প্রচেষ্টায় একজন সফল ব্যবসায়ী মহিলা।
খাদিজা কে মুসলমানরা প্রায়শই "বিশ্বাসীগণের মা" বলে উল্লেখ করে থাকেন। তিনি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ব্যক্তিত্ব। তিনি তার মেয়ে ফাতিমা, আসিয়া এবং মরিয়ম সহ ইসলামের চার "স্বর্গের মহিলা" দের মধ্যে একজন।[৫] মুহাম্মাদ ২৫ বছর ধরে তার সাথে একগামীভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
মুহাম্মাদকে বিবাহ করার পূর্বে[সম্পাদনা]
জন্ম ও বংশ[সম্পাদনা]
খাদিজার পিতা খুওয়ালিদ ইবনে আসাদ ছিলেন একজন বণিক[৬][৭] ও নেতা। অনেক সূত্র অনুসারে, তিনি ফিজার যুদ্ধে প্রায় ৫৮৫ মারা যান, কিন্তু অন্যদের মতে, খাদিজা যখন ৫৯৫ সালে মুহাম্মাদকে বিয়ে করেন তখনও তিনি জীবিত ছিলেন।[৮][৯] খুওয়েলিদের উম্মে হাবিব বিনতে আসাদ নামে এক বোনও ছিল।[১০]
খাদিজার মা ফাতিমা বিনতে জাইদাহ, যিনি প্রায় ৫৭৫ সালে মারা যান,[১১] তিনি কুরাইশের আমির ইবনে লুয়াই গোত্রের সদস্য[১২] এবং মুহাম্মাদ (সা) এর মায়ের তৃতীয় চাচাতো বোন ছিলেন।
পেশা[সম্পাদনা]
খাদিজা খুব সফল বণিক ছিলেন। কথিত আছে যে, কুরাইশের বাণিজ্য কাফেলা ভ্রমণকারীরা যখন গ্রীষ্মকালীন সিরিয়া যাত্রা বা ইয়েমেনে শীতকালীন যাত্রা শুরু করতে জড়ো হয়েছিল, তখন খাদিজা কাফেলা কুরাইশের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাফেলাকে একত্রিত করেছিল।[১৩] খাদিজা সাথে যুক্ত সম্মানসূচক উপাধির মধ্যে ছিল, "আমিরাত-কুরাইশ" ("কুরাইশের রাজকুমারী"), "ধার্মিক", এবং "খাদিজা আল-কুবরা ("খাদিজা মহান")।[১৪] কথিত আছে যে তিনি দরিদ্রদের খাওয়াতেন এবং বস্ত্র বিতরনও করতেন, তার আত্মীয়দের আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন এবং দুর্বল সম্পর্কের জন্য বিবাহের অংশ সরবরাহ করেছিলেন।[১৪] খাদিজাকে বলা হত যে তারা প্রতিমাতে বিশ্বাস করত না বা পূজা করত না, যা প্রাক-ইসলামি আরব সংস্কৃতির জন্য সাধারণ ছিল।[১৫]
খাদিজা তার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে ভ্রমণ করেনি; তিনি অন্যদের একটি কমিশনের জন্য তার পক্ষে বাণিজ্য করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। ৫৯৫ সালে খাদিজার সিরিয়ায় লেনদেনের জন্য একজন সহকর্মীর প্রয়োজন ছিল। তিনি সিরিয়ার বাণিজ্যের জন্য মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহকে বেছে নিয়েছিলেন। তার চাচা আবু তালিব ইবনে মুত্তালিবের অনুমতি ক্রমে তাকে খাদিজার এক বান্দার সাথে সিরিয়ায় পাঠানো হয়। এই কাফেলা অভিজ্ঞতা মুহাম্মাদকে "আল-সাদিক" ("সত্যবাদী") এবং "আল-আমিন" ("বিশ্বাসযোগ্য" বা "সৎ") সম্মানজনক উপাধি অর্জন করে।[১৬] খাদিজা মুহাম্মাদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যার বয়স তখন ২৫ বছর, তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন যে তিনি তার স্বাভাবিক কমিশন দ্বিগুণ প্রদান করবেন।[১৭]
তিনি তার এক চাকর মায়সারাকে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর, মায়সারাহ মুহাম্মাদ তার ব্যবসা পরিচালনা করার সম্মানজনক উপায়ের বিবরণ দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি খাদিজার প্রত্যাশার দ্বিগুণ মুনাফা ফিরিয়ে এনেছিলেন।[১৮]
পূর্ববর্তী বিবাহ সম্পর্কে ভিন্ন মতামত[সম্পাদনা]
সুন্নিদের মতামত[সম্পাদনা]
খাদিজা তিনবার বিবাহ করেছিলেন এবং তার সমস্ত বিবাহ থেকে সন্তান ছিল। যদিও তার বিয়ের আদেশ নিয়ে বিতর্ক হয়, সাধারণত মনে করা হয় যে তিনি প্রথম আতিক ইবনে 'আ'ইধ ইবনে' আবদুল্লাহ আল-মাখজুমি এবং দ্বিতীয় মালিক ইবনে নাবাশ ইবনে জারগারি ইবনে আত-তামিমিকে বিয়ে করেন।[১৯] তার দ্বিতীয় স্বামীর কাছে তিনি দুই পুত্র সন্তান বহন করেন, যাদের নাম ছিল হালা এবং হিন্দ।[২০] ব্যবসা সফল হওয়ার আগেই তিনি মারা যান।[২১] স্বামী আতিকের কাছে খাদিজা হিন্দা নামে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। এই বিয়ে খাদিজাকে বিধবা হিসাবেও ছেড়ে দিয়েছিল।[২২]
খাদিজা মুহাম্মাদকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যখন মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫ বছর এবং তার বয়স ছিল ৪০ বছর। খাদিজা তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফল ইবনে আসাদ ইবনে আব্দু'ল উজ্জার সাথে পরামর্শ করেন।[২৩]
শিয়াদের মতামত[সম্পাদনা]
ইবনে শাহরাশুব আল-শাফিতে আল-সাইয়্যেদ আল-মুর্তাদা এবং আল-তালকিসে আল-শাইখ আল-তুসি থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে খাদিজা মুহাম্মদকে বিয়ে করার সময় কুমারী ছিলেন।[২৪] উপরন্তু, হিজাজের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য মানুষের মধ্যে খাদিজার উচ্চ অবস্থান ও মর্যাদা বিবেচনা করে, এটি অত্যন্ত অসম্ভব হবে যে তিনি বানু তামিম এবং বানু মাখজুম (দুটি "নিম্ন" উপজাতি) থেকে পুরুষদের বিয়ে করেন।[২৫]
গবেষকদের মতে, খাদিজার বোন হালির সন্তান খাদিজার জন্য দায়ী দুটি শিশু ছিল। হালার স্বামীর মৃত্যুর পর খাদিজা হালা এবং (হালার মৃত্যুর পর) হালার সন্তানদের দেখাশোনা করেন।
খাদিজার বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি মুহাম্মাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[২৬]
তবে কিছু সূত্র আরও দাবি করে যে, অন্যদের দ্বারা তার বয়স ছিল প্রায় ২৫-২৮ বা ৩০ বছর।[২৭]
প্রথম বিবাহ[সম্পাদনা]
খাদিজার পিতা আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইঞ্জিল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নওফলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। তবে কেন তা হয় নি তা সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি। পরিশেষে আবু হালা ইবন জারারাহ আত-তামিমির সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। আবু হালা ও খাদিজা দম্পতী হালা ও হিন্দ নামে দুইজন পুত্র সন্তান জন্ম। হিন্দ সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। হালার কথা জানা যায়নি । হিন্দ বদর যুদ্ধে মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে মুহাম্মদ এর সাথে যুদ্ধে যোগদান করেন। হযরত আলীর শাসনামলে উটের যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হযরত আলীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে হিন্দ মারা যায়।
তবে কেউ কেউ বলেন প্রথম স্বামীর ঘরে খাদিজা তিনজন সন্তানের জন্ম দেন। হিন্দ ও হারিস নামে দুইজন পুত্র এবং যয়নাব নামের এক কন্যা। হারিস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাকে কাবা ঘরের রুকনে ইয়ামনীর কাছে হত্যা করা হয়
দ্বিতীয় বিবাহ[সম্পাদনা]
প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আতিক বিন আবিদ আল-মাখযুমির সাথে খাদিজার দ্বিতীয় বিয়ে হয়[২৮]। তবে কা'তাদা এবং ইবন ইসহাকের মতে তার প্রথম স্বামী আতিক এবং দ্বিতীয় স্বামী আবু হালা। ইবন ইসহাকের এই মত ইউনুস ইবন বুকাইর-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়[২৯]। অবশ্য প্রথমোক্ত মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। ইবন হাজার-এর বর্ণনায় জানা যায় আবন আবদিল বার সহ আরো অনেক বিশেষজ্ঞই প্রথম মতটি ব্যক্ত করেছেন[৩০]।
দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে খাদিজা হিন্দা নামে একজন কন্যা সন্তান জন্ম দেন। তার কুনিয়াত ছিলো উম্মু মুহাম্মদ। হিন্দা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
খাদিজার দ্বিতীয় স্বামীও মারা যায়।
মুহাম্মদের সাথে পরিচয়[সম্পাদনা]
খাদিজা অন্যান্য কুরাইশদের মত একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ছিলেন অনেক সম্পদশালী এবং সম্মানিত। তিনি ব্যবসার জন্য সৎ ও যোগ্য লোকবল নিয়োগ দিতেন। সেই সময় মক্কায় সততা এবং আমানতদারীতার জন্য মুহাম্মদ বিখ্যাত হয়ে উঠেন। তিনি তার চাচা আবু তালিবের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন এবং অনেক ব্যবসায়ীক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। খাদিজা তার গুণের কথা জানতে পেরে তাকে নিজের নিয়োগপ্রদান করেন। মুহম্মাদকে তার বিশ্বস্ত দাসী মায়সারার সাথে ব্যবসার জন্য সিরিয়ায় প্রেরণ করেন। সিরিয়ায় ব্যবসা করে মুহাম্মাদ অনেক মুনাফা অর্জন করেন এবং ব্যবসার প্রতিটি হিসাব খাদিজাকে বুঝিয়ে দেন। এতে খাদিজা অনেক খুশি হন। এছাড়া খাদিজা তার ছোট ভাইয়ের বউ সাফিয়ার কাছ থেকে মুহাম্মদ সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিলেন।
মুহাম্মদের সাথে বিবাহ[সম্পাদনা]
খাদিজার বান্ধবী ইয়ালার স্ত্রী নাফিসা বিনতে মানিয়া বিবাহের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছেন। তিনি খাদিজার হয়ে মুহাম্মদ এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। এরপর দুই পক্ষের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়।
তাদের বিয়েতে আবু তালিব, হামযাহসহ অনেক বিশিষ্ট কুরাইশ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সকলের সামনে বিয়ের খুৎবা প্রদান করেন আবু তালিব। আরবী গদ্যসাহিত্যে এই খুৎবা এখনো বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিয়ের মোহরানা ছিলো ৫০০ স্বর্ন মুদ্রা। খাদিজা নিজেই দুই পক্ষের খরচাদি বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপা মুহাম্মদ কে দেন , যেন তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার (বৌভাত অনুষ্ঠান) আয়োজন করতে পারেন। বিয়ের সময় খাদিজার বয়স ছিলো ৪০ অথবা ২৮ বছর এবং মুহাম্মদ এর বয়স ছিলো ২৫ বছর। মুলত মুহাম্মদ এর চারিত্রিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে খাদিজা তাকে বিয়ে করেন।বিবাহের সময় খাদিজার বাবা বেঁচে ছিলেন না।
বিবাহ কালীন সময়ে খাদিজার বয়স[সম্পাদনা]
বিবাহ কালীন সময়ে মুহাম্মদ এর বয়স চন্দ্র মাস অর্থাৎ আরবি মাসের গণনা অনুযায়ী ২৫ বছর এবং সৌর মাস অর্থাৎ ইংরেজি মাসের গণনা অনুযায়ী ২৪ বছর ৩ মাস পরিপূর্ণ নিশ্চিত হলেও, খাদিজা এর বয়স নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতামত। এরমধ্যে চন্দ্র মাস অর্থাৎ আরবি মাসের গণনা অনুযায়ী বয়স ৪০ প্রচলিত থাকলেও অধিকাংশ ইসলামিক নথিপত্র, ইসলামিক ইতিহাস এবং ইসলামিক ঘটনাবলী একত্রিত করে খাদিজা এবং মুহাম্মদ এর বিবাহ কালীন সময়ে খাদিজা এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং সঠিক বয়স পাওয়া যায় চন্দ্র মাস অর্থাৎ আরবি মাসের গণনা অনুযায়ী ২৮ বছর এবং সৌর মাস অর্থাৎ ইংরেজি মাসের গণনা অনুযায়ী ২৭ বছর ২ মাস। অর্থাৎ খাদিজা এবং মুহাম্মদ এর বিবাহ কালীন সময়ে খাদিজা এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং সঠিক বয়স হলো ২৮ বছর।[৩১]
সন্তান[সম্পাদনা]
মুহাম্মদ এর ঘরে খাদিজা ৬ জন সন্তানের জন্ম দেন। তাদের প্রথম সন্তান কাসিম। অল্প বয়সে কাসিম মক্কায় মৃত্যুবরণ করে। এই সন্তানের নাম অনুযায়ী মুহাম্মদ এর নাম হয় আবুল কাসিম। এরপর জন্ম হয় যয়নবের। তৃতীয় সন্তান আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম আগমনের পর। তাই তার উপাধি হয় "তাইয়্যেব ও তাহির"। আব্দুল্লাহও অল্প বয়সে মারা যান। এরপর জন্মগ্রহণ করেন রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা। খাদিজা উকবার দাসী সালামাকে সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ[সম্পাদনা]
মুহাম্মদ তৎকালীন আরবের সামাজিক অবক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা, হানাহানি থেকে মানুষের মুক্তি কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তা করতেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তার স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাকে খাবার দিয়ে আসতেন। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী এমনি একদিন ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিবরাইল তার কাছে আল্লাহপ্রেরিত বাণী নিয়ে আসেন এবং তাকে কিছু পঙ্ক্তি দিয়ে পড়তে বলেন। উত্তরে মুহাম্মাদ জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিবরাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পঙ্ক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেওয়ার পর মুহাম্মাদ পঙ্ক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। মুসলিমদের ধারণা অনুযায়ী এটিই কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। বর্ণনায় আরও উল্লেখ আছে প্রথম বাণী লাভের পর মুহাম্মাদ এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, "আমাকে আবৃত কর"। খাদিজা নবীর সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাকে নবী হিসেবে মেনে নেন। ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মাদকে নিয়ে খাদিজা নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফলের কাছে যান। নওফল তাকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। এভাবে খাদিজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলাম প্রচারে অবদান[সম্পাদনা]
ইসলাম ধর্মের সূচনালগ্নে মুহাম্মদকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন খাদিজা। ধীরে ধীরে খাদিজার সমস্ত সম্পদ মুহাম্মদ দান করে দিতে থাকেন। এতে খাদিজা তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে প্রচন্ড অর্থকষ্ট শুরু হয়, অনাহারে খোলা মাঠে দিন কাটাতে হয়। নবুওয়তের সপ্তম বছরে মক্কার কুরাইশরা মুসলিমদের বয়কট করে। তারা সবাই মিলে "শিয়াবে আবু তালেব" নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। অন্যান্য মুসলিমদের সাথে খাদিজাও সেখানে ছিলেন। প্রায় ৩ বছর তিনি সেখানে ছিলেন। তখন গাছের পাতা খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছে তাদের। খাদিজা তখন কুরাইশদের ওপর নিজের প্রভাব খাটিয়ে খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিতেন মুসলিমদের। তার তিন ভাতিজা- হাকিম বিন হিযাম, আবুল বুখতারি ও যুময়া ইবনুল আসওয়াদ, তারা সবাই ছিলেন কুরাইশ নেতা। এই ৩ ভাতিজার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করতেন খাদিজা। এত কষ্ট সহ্য করেও ইসলাম ধর্ম প্রচারে খাদিজা সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে থাকেন। একটি বর্ণনা অনুযায়ী কাবা শরীফের কাছে ৩ জনকে নামায পড়তে দেখা গেলো। আব্বাস বলেন, তাদের একজন আমার ভাতিজা মুহাম্মদ, অন্যজন আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং তৃতীয়জন এক মহিলা, তার নাম খাদিজা।
মৃত্যু[সম্পাদনা]
মুহাম্মদের সাথে বিয়ে হওয়ার ২৫ বছর পর ৬৪ অথবা ৫২ বছর বয়সে রমজান মাসের ১০ তারিখে খাদিজা মক্কায় মারা যান। তখনও ইসলাম ধর্মে মৃত ব্যক্তির জন্য জানাযার নামায পড়ার বিধান ছিলো না। তাই তাকে জানাযা ছাড়াই মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। মুহাম্মদ নিজেই তার লাশ কবরে নামান।
ইসলাম ধর্মে খাদিজার মর্যাদা[সম্পাদনা]
ইসলাম ধর্মে খাদিজার মর্যাদা অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে অনেক উপরে। তিনি প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি। মুহাম্মদের সাথে প্রথম নামায তিনিই পড়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম অনুয়ায়ী বর্ণিত আছে যে, ফেরেশতা জিবরাইল মুহাম্মদকে বলেন, "আপনি তাকে (খাদিজা) আল্লাহ ও আমার পক্ষ থেকে দেওয়া সালাম পৌঁছিয়ে দিন।"বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছে, "পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহিলা হলো মরিয়ম বিনতে ইমরান ও খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ।" আরো বলা হয়েছে, " জান্নাতে তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি প্রাসাদের সুসংবাদ দিন।"খাদিজা সম্পর্কে মুহাম্মদ বলেন, "মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির (অবিশ্বাসী) ছিলো, তখন সে ছিলো মুসলিম। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে নি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে।"
আরও দেখুন[সম্পাদনা]
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
উদ্ধৃতি[সম্পাদনা]
- ↑ "Khadija's age at the Time of her Marriage with the Prophet: 40 or 28?"। icraa.org। ২০১৯-০৪-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৩।
- ↑ Sayyid Ali Ashgar Razwy। "The Birth of Muhammad and the Early Years of his Life"। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০১৭।
- ↑ Umair Mirza (১৯৯৮-০১-০১)। History of Tabari – Volume 39। পৃষ্ঠা ১৬১।
- ↑ "Wife of the Prophet Muhammad (SAWAS)"। www.ummah.net। ২০০৭-১০-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৩।
- ↑ "Encyclopaedia of the Qur'ān"। Brill (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৩।
- ↑ Koehler, Benedikt (২০১৪-০৬-১৭)। Early Islam and the Birth of Capitalism (ইংরেজি ভাষায়)। Lexington Books। আইএসবিএন 978-0-7391-8883-5।
- ↑ Campo, Juan Eduardo (২০০৯)। Encyclopedia of Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা ৪২৭। আইএসবিএন 978-1-4381-2696-8।
- ↑ Blachère, R. (১৯৫৮-০১-০১)। "A. GUILLAUME, The Life of Muhammad, a translation Ishāq's Sirat rasūl Allāh, I vol. petit in-8°, XLVII + 815 p., introduction, traduction critique, notes d'Ibn HiŠām, 3 indices, Oxford, 1955"। Arabica (ইংরেজি ভাষায়)। 5 (3): ৮৩। আইএসএসএন 1570-0585। ডিওআই:10.1163/157005858X00065।
- ↑ Saʻd, Muḥammad Ibn (১৯৬৭)। Kitab Al-tabaqat Al-kabir (ইংরেজি ভাষায়)। Pakistan Historical Society। পৃষ্ঠা ১৪৮–৪৯।
- ↑ Saʻd, Muḥammad Ibn (১৯৬৭)। Kitab Al-tabaqat Al-kabir (ইংরেজি ভাষায়)। Pakistan Historical Society। পৃষ্ঠা ৫৪।
- ↑ Hendrix, Scott E.; Okeja, Uchenna (২০১৮-০৩-০১)। The World's Greatest Religious Leaders: How Religious Figures Helped Shape World History [2 volumes] (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা ৪৫২। আইএসবিএন 978-1-4408-4138-5।
- ↑ "Khadija tul Kubra"। www.al-islam.org। ২০০২-০৫-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৩।
- ↑ Saʻd, Muḥammad Ibn (১৯৯৫)। The Women of Madina (ইংরেজি ভাষায়)। Ta-Ha। পৃষ্ঠা ১০। আইএসবিএন 978-1-897940-24-2।
- ↑ ক খ Gorder, A. Christian Van (২০১৪-০৫-২৯)। Islam, Peace and Social Justice: A Christian Perspective (ইংরেজি ভাষায়)। James Clarke & Company। পৃষ্ঠা ১৬২। আইএসবিএন 978-0-227-17422-7।
- ↑ "Khadijah, Daughter of Khuwaylid, Wife of Prophet Muhammad | Books on Islam and Muslims | Al-Islam.org"। www.al-islam.org। ২০১৭-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৫।
- ↑ Lings, Martin (১৯৯১)। Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources (ইংরেজি ভাষায়)। Islamic Texts Society। পৃষ্ঠা ৩৩–৩৪। আইএসবিএন 978-0-946621-33-0।
- ↑ Ibn Sad, Muhammad (১৯৮১)। Ibn Sa'd's kitab al-Tabaqat al-Kabir। Kitab Bhavan,। পৃষ্ঠা ১৪৫–৪৬। আইএসবিএন 978-81-7151-127-3।
- ↑ Hishām, ʻAbd al-Malik Ibn; Isḥāq, Muḥammad Ibn (১৯৯৭)। The Life of Muhammad: A Translation of Isḥāq's Sīrat Rasūl Allāh (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। পৃষ্ঠা ৮২–৮৩। আইএসবিএন 978-0-19-577828-1।
- ↑ Ṭabarī, Muḥammad ibn Ğarīr Al-; Al-Tabari, Abu Ja'far Muhammad Bin Jarir; Ṭabarī, Muḥammad ibn Ǧarīr Abụ Ǧaʿfar al-; طبري; Ṭabarī; Ṭabarī, Muḥammad Ibn-Ǧarīr aṭ-; a?- ?abar?, Mu?ammad Ibn-?ar?r; Al- ?abar?, Mu?ammad ibn ?ar?r (১৯৯০)। The Last Years of the Prophet (ইংরেজি ভাষায়)। State University of New York Press। আইএসবিএন 978-0-88706-691-7।
- ↑ "K̲h̲adīd̲j̲a – Brill Reference"। Encyclopaedia of Islam। আইএসবিএন 978-90-04-16121-4। ২০১৮-০৬-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৫।
- ↑ "Islams Women – Khadijah bint Khuwaylid"। www.islamswomen.com। ২০১৯-০৩-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৫।
- ↑ "Welcome – Tree of Faith"। Tree of Faith। ২০১২-০৪-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৫।
- ↑ Hishām, ʻAbd al-Malik Ibn; Isḥāq, Muḥammad Ibn (১৯৯৭)। The Life of Muhammad: A Translation of Isḥāq's Sīrat Rasūl Allāh (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-577828-1।
- ↑ علي،, ابن شهرأشوب، محمد بن (২০০০)। مناقب آل أبي طالب (আরবি ভাষায়)। ১। انتشارات ذوي القربى،। পৃষ্ঠা ১৫৯। আইএসবিএন 978-964-6307-34-6।
- ↑ العاملي, جعفر مرتضى (১৯৯৩)। الصحيح من سيرة النبى الاعظم: [مدخل لدراسة السيرة و التاريخ] (আরবি ভাষায়)। ২। دار الهادى। পৃষ্ঠা ১২৩।
- ↑ الله, الحاكم النيسابوري/أبو عبد (২০০৯-০১-০১)। المستدرك على الصحيحين 1-5 مع الفهارس ج1 (আরবি ভাষায়)। Dar Al Kotob Al Ilmiyah دار الكتب العلمية। আইএসবিএন 978-2-7451-1385-6।
- ↑ الله, الحاكم النيسابوري/أبو عبد (২০০৯-০১-০১)। المستدرك على الصحيحين 1-5 مع الفهارس ج1 (আরবি ভাষায়)। ৩। Dar Al Kotob Al Ilmiyah دار الكتب العلمية। পৃষ্ঠা ২০০। আইএসবিএন 978-2-7451-1385-6।
- ↑ শারহুল মাওয়াহিব, আল-ইসতিয়াব
- ↑ আল-ইসাবা: ৪/২৮১
- ↑ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – মুহাম্মদ আবদুল মা'বুদ, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- ↑ ভিডিও সিরিজ " ৬৩ বছর: একজন নবীর জীবন " এর " পর্ব ০৫: সিরিয়া থেকে বিবাহ পর্যন্ত! " এর ২ ঘণ্টা ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড (অর্থাৎ ২:০১:৪০) থেকে ২ ঘণ্টা ৪২ মিনিট ০ সেকেন্ড (অর্থাৎ ২:৪২:০০) পর্যন্ত ভিডিও অংশে সকল তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে এবং প্রমাণ করা হয়েছে। ভিডিও এর লিংক:- https://www.facebook.com/istishon/videos/1832169376803761/
গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]
- হাবিবুর রহমান, মুহাম্মদ (৮ মে ২০২১)। "প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী বিবি খাদিজাতুল কুবরা (রা.)"। দৈনিক প্রথম আলো।
বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]
উম্মুল মুমিনিন |
---|
![]() |
|