সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস
জন্মআনুমানিক ৫৯৫
মক্কা, আরব
মৃত্যুআনুমানিক ৬৭৪
মদিনা, আরব
আনুগত্য রাশিদুন খিলাফত
সেবা/শাখা রাশিদুন সেনাবাহিনী
কার্যকাল৬৩৬-৬৪৪
পদমর্যাদাকমান্ডার
তিসফুনের গভর্নর (৬৩৭-৬৩৮)
বুসরার গভর্নর (৬৩৮-৬৪৪), (৬৪৫-৬৪৬)
নেতৃত্বসমূহমুসলিমদের পারস্য বিজয়
শাহনামার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কিত কাদিসিয়ার যুদ্ধের চিত্র। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাশিদুন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. (আরবি: سعد بن أبي وقاص) ছিলেন মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান সাহাবী[১] ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি ১৭ তম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি ছিলেন।[১] ৬৩৬ সালে পারস্য বিজয়ে তার নেতৃত্ব প্রদান ও তার শাসক হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। ৬৪৬ ও ৬৫১ সালে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীন পাঠানো হয়। ধারণা করা হয় যে, নৌ রুটে চীন যাওয়ার পথে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছেন এরং বাংলাকে ইসলামের সাথে পরিচয় করানোয় তার অবদান রয়েছে। ধারণা করা হয়, তিনি ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা স্থানীয়ভাবে আবু আক্কাস মসজিদ নামে পরিচিত।[২][৩] চীনা মুসলিমদের মতে, চীনের ক্যান্টন বন্দরে তার কবর আছে। অবশ্য আরবদের মতে তার কবর আরবে অবস্থিত।[১]

পরিচয়[সম্পাদনা]

তাঁর পুরো নাম আবু ইসহাক সা’দ এবং পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক। ইতিহাসে তিনি সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস নামে খ্যাত। তিনি কুরাইশ বংশের বনু যুহরা শাখার সন্তান। তার মাতার নাম ‘হামনা’। পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন কুরাইশ বংশের। হযরত সা’দের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ‘আশারায়ে মুবাশ্‌শারাহ’ অর্থাৎ জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম এবং তিনি তাদের সবার শেষে দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেছেন

স্বভাব[সম্পাদনা]

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে চারজন ছিলেন সর্বাধিক কঠোরঃ উমার, আলী যুবাইর, সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

হযরত সা’দের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। প্রাচীন সূত্রগুলিতে তার কিছু কবিতা সংকলিত হয়েছে। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেছেন।

মদিনায় হিজরত[সম্পাদনা]

হযরত মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুমের মক্‌কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর যে চার ব্যক্তি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন আবী ওয়াক্‌কাস। সহীহ বুখারীতে বারা ইবন আযিব থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ ‘সর্বপ্রথম আমাদের নিকট আগমণ করেন মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম। এ দু’ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতঃপর বিলাল, সা’দ ও আম্মার বিন ইয়াসির আগমন করেন। ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, সা’দ ও তার ভাই উমাইর মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় এসে তাদের অন্য এক ভাই ’উতবা ইবন আবী ওয়াক্‌কাসের নিকট অবস্থান করেন। তার কয়েক বছর পূর্বেই ’উতবা এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্‌কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয়।

ইসলাম গ্রহণ[সম্পাদনা]

হযরত সা’দের ভাই উমাইর রা. রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির কিছুদিন পরই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। ইবন খালদুন তার ‘তারীখে’ উমাইরের পর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের ইসলাম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।

হযরত আবু বকর ছিলেন সা’দের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইমাম বুখারী তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আল-মানাকিব’ অধ্যায়ে সা’দের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সা’দ বলেনঃ ইসলাম গ্রহণের পর আমি নিজেকে তৃতীয় মুসলমান হিসেবে দেখতে পেলাম। আসলে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে; কিন্তু অনেকের মতই তখন তিনি ঘোষণা দেননি। আর একথার সমর্থন পাওয়া যায় তার মা’র ঘটনা এবং সূরা আনকাবুতের আয়াতটি নাযিলের মাধ্যমে। কারণ, এ আয়াতটি নবুওয়াতের চতুর্থ বছর নাযিল হয়। সম্ভবতঃ এ সময়ই তিনি তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মায়ের নিকট প্রকাশ করেন।

সা’দের পিতা আবু ওয়াক্‌কাস ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তার অন্তিম রোগশয্যায় রাসূল সা. তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। মাতা হামনাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলৈন। তবে প্রথমত তার পুত্র সা’দের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে হৈ চৈ ও বিলাপ শুরু করে লেকজন জড়ো করে ফেললেন। মায়ের কাণ্ড দেখে ক্ষোভে দুঃখে হতভম্ব হয়ে সা’দ ঘরের এক কোণে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ বিলাপ ও হৈ চৈ করার পর মা পরিষ্কার বলে দিলেনঃ ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মাদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না দেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসব না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্কও থাকবেন।’


হযরত সা’দ বড় অস্থির হয়ে পড়লেন। রাসূললের সা. খিদমতে হাজির হয়ে সব ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূললের সা. নিকট থেকে জবাব পাওয়ার পূর্বেই সূরা আল আনকবুতের অষ্টম আয়াতটি নাযিল হলঃ

‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের মেনো না।’

কুরআনের এ আয়াতটি হযরত সা’দের মানসিক অস্থিরতা দূর করে দিল। তার মা তিনদিন পর্যন্ত কিছু মুখে দিলেন না, কারো সাথে কথা বললেন না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। তার অবস্থা বড় শোচনীয় হয়ে পড়ল। বার বার তিনি মার কাছে এসে তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তার একই কথা, তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। অবশেষে তিনি মার মুখের ওপর বলে দিতে বাধ্য হলেঃ ‘মা, আপনার মতো হাজারটি মাও যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার ব্যাপারে জিদ করে পানাহারে ছেড়ে দেয় এবং প্রাণ বিসর্জন দেয়, তবুও সত্য দ্বীন পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ হযরত সা’দের এ চরম সত্য কথাটি তার মার অন্তরে দাগ কাটে। অবশেষে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম মুসিলম তার সহীহ গ্রন্থে ‘আল-ফাদায়িল’ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইন্তেকাল[সম্পাদনা]

হযরত সা’দ মদীনা থেকে দশ মাইল দূরে আকীক উপত্যকায় কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ইনতিকাল করেন। জীবনীকারদের মধ্যে তার মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। তবে হিজরী ৫৫ সনে ৮৫ বছর বয়সে তার ইনতিকাল হয় বলে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি আছে। ইবন হাজার তার ‘তাহজীব’ গ্রন্থে এ মতই সমর্থন করেছেন। গোসল ও কাফনের পর লাশ মদীনায় আনা হয়। মদীনার তৎকালীন গভর্ণর মারওয়ান জানাযার ইমামতি করেন। সহীহ মুসলিমের একাধিক বর্ণনার মাধ্যমে তার জানাযার বিষয়টি বিস্তারিত জানা যায়।

হযরত সা’দের ইনতিকালের পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত ’আয়িশা ও অন্যান্য আযওয়াজে মুতাহ্‌হারাহ্‌ বলে পাঠালেন, তার লাশ মসজিদে আনা হোক, যাতে আমরা জানাযার শরীক হতে পারি। কিন্তু লোকেরা লাশ মসজিদে নেয়া যেতে পারে কিনা এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। হযরত আয়িশা রা. একথা জানতে পেরে বললেনঃ ‘তোমরা এত তাড়াতাড়িই ভুলে যাও? রাসূল সা. তো সুহাইল ইবন বায়দার জানাযা এই মসজিদে আদায় করেছেন।’ অতঃপর লাশ উম্মুহাতুল মু’মিনীনের হুজরার নিকট আনা হল এবং তারা নামায আদায় করলেন।

মরণকালে হযরত সা’দ রা. বহু অর্থ-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি একটি অতি পুরাতন পশমী জুববা চেয়ে নিয়ে বলেনঃ ‘এ দিয়েই তোমরা আমাকে কাফন দেবে। এ জুব্বা পরেই আমি বদর যুদ্ধে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমার ইচ্ছা, এটা নিয়েই আমি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হই।’

হযরত সা’দের ছেলে মুসয়াব বলেনঃ আমার পিতার অন্তিম সময়ে তার মাথাটি আমার কোলের ওপর ছিল। তার মুমূর্ষ অবস্থা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ বেটা কাঁদছ কেন? বললামঃ আপনার এ অবস্থা দেখে। বললেনঃ ‘আমার জন্য কেঁদোনা। আল্লাহ কক্ষণো আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমি জান্নাতবাসী। আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেবেন এবং কাফিরদের সৎকাজের বিনিময়ে তাদের শাস্তি লাঘব করবেন।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪)

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

পরিবার[সম্পাদনা]

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় ৫৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে উহাইব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে জুহরাহ ছিলেন কুরাইশ গোত্রের বনু জুহরাহ গোত্রের।[৪][৫] উহাইব ইবনে আবদ মানাফ ছিলেন মুহাম্মদ (সা.) এর মা আমিনাহ বিনতে ওয়াহাবের চাচা।[৬]  সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মা হলেন হমনা বিনতে সুফিয়ান ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদ শামস ইবনে আব্দে মানফ।[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Hughes, Thomas Patrick (১৮৯৫)। A dictionary of Islam; being a cyclopaedia of the doctrines, rites, ceremonies, and customs, together with the technical and theological terms, of the Muhammadan religion। Harold B. Lee Library। London, W. H. Allen & co.। 
  2. Mahmood, Kajal Iftikhar Rashid (২০১২-১০-১৯)। সাড়ে তেরো শ বছর আগের মসজিদ [1350 Year-old Mosque]। Prothom Alo। ২০১৮-০৬-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৫-৩০ 
  3. "History and archaeology: Bangladesh's most undervalued assets?"deutschenews24.de। bdnews24.com। ২০১২-১২-২১। ২০১৪-০৩-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৫-৩০ 
  4. "Sa'ad Ibn Abi Waqqas (radhi allahu anhu)"web.archive.org। ২০০৫-০৯-১০। Archived from the original on ২০০৫-০৯-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৮ 
  5. Jabir; Tabari (১৯৯২-০১-০১)। The History of al-Tabari Vol. 12: The Battle of al-Qadisiyyah and the Conquest of Syria and Palestine A.D. 635-637/A.H. 14-15 (ইংরেজি ভাষায়)। SUNY Press। আইএসবিএন 978-0-7914-0733-2 
  6. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৮ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ এপ্রিল ২০২০ 
  7. Jammāʻīlī, ʻAbd al-Ghanī ibn ʻAbd al-Wāḥid (২০০৪)। Short Biographies of the Prophet and His Ten Companions who Were Given the Tidings of Paradise (ইংরেজি ভাষায়)। Darussalam। আইএসবিএন 978-9960-899-12-1 

www.waytojannah.net/blog/2015/08/21/biography-of-sad-bin-abi-waqqas/

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Nafziger, George F. (২০০৩), Islam at war, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 278, আইএসবিএন 0-275-98101-0, সংগ্রহের তারিখ ২৫ জুলাই ২০১০  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]