উসামা ইবনে যায়িদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
উসামা ইবনে যায়িদاسامة بن زيد

ইবনুল হিব্ব

জন্ম৬১৫খ্রিস্টাব্দ
মক্কা, আরব উপদ্বীপ
মৃত্যু৬৭৪ খ্রিস্টাব্দ
মদিনা
বংশধর
পুত্র
পিতাযায়িদ ইবনে হারিসা
মাতাউম্মে আইমান
ধর্মইসলাম

উসামা ইবনে যায়িদ হিজরতের ৭ বছর পূর্বে (৬১৫ খ্রিস্টাব্দে) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কারো কারো মতে তিনি হিজরতের ১০ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দত্তক পুত্র এবং তার মাতার ঘনিষ্টতা রাসুল এর মায়ের মতো হওয়ার কারণে তাকে রাসুল এর নাতি হিসেব বিবেচনা করা হতো।রাসুল তাকে তার নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। তার মাতা ছিলেন রাসুল এর জননী হজরত আমিনার দাসি।যদিও তার পিতা ছিলেন সাদা ও খাটো, উসামা ছিলেন কালো,লম্বা ও পাতলা।উসামার যৌবনকালে মুহাম্মাদ সা. এর একটি দামী চাদর ছিল। তিনি মাত্র একটি জুমার তা ব্যবহার করে উসামাকে উপহার দিয়ে দেন।দশ বছর বয়সে উসামা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন কিন্তু ছোট হওয়ার কারণে তিনি অনুমতি পান নি।সতের বছর বয়সে তিনি প্রথম খন্দকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী অতর্কিত আক্রমনের শিকার হয়,উসামা ছিলেন সেই ছয় জনের মধ্যে একজন যারা রাসুল সা. এর সাথে যুক্ত হয়ে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং পরাজয়কে বিজয়ের রূপদান করেন।

জীবনীক্রম[সম্পাদনা]

হিজরাতের পূর্বে মক্কায় নবুওয়াতের সপ্তম বছর চলছে। রাসূলুল্লাহ সা. ও তার সাহাবীরা তখন কুরাইশদের চরম বাড়াবাড়ির শিকার। ইসলামী দাওয়াতের কঠিন দায়িত্ব ও বোঝা পালন করতে গিয়ে পদে পদে তিনি নানা রকম দুঃখ বেদনা ও মুসীবতের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন সময় তার জীবনে একটু খুশির আলোক আভা দেখা দিল। সুসংবাদ দানকারী খুশীর বার্তা নিয়ে এলো, ‘উম্মু আয়মন’ একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সেই সৌভাগ্যবান নবজাতক, যার ধরাপৃষ্ঠে আগমণ সংবাদে আল্লাহর রাসূল সা. এত উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তিনি উসামা ইবন যায়িদ।

শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে রাসূলুল্লাহর সা. এত উৎফুল্ল হওয়াতে সাহাবীরা কিন্তু বিস্মিত হননি। কারণ, রাসূলুল্লাহর সা. নিকট শিশুটির মাতা-পিতার স্থান সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। শিশুটির মা ‘বারাকা আল হাবাশিয়্য’- যিনি ‘উম্মু আয়মন’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার দাসী। তার জীবনকালে এবং ওয়াফাতের পরও এ মহিলা রাসূলুল্লাহকে সা. প্রতিপালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. দুনিয়াতে চোখ মেলে তাঁকেই মা বলে বুঝতে শেখেন। অত্যন্ত গভীর ও অকৃত্রিমভাবে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ভালোবাসতেন। প্রায়ই তিনি বলতেনঃ ‘আমার মায়ের পর ইনিই আমার মা এবং আমার আহলদের অবশিষ্ট ব্যক্তি। এ সম্মানিত মহিলাই হচ্ছেন এ নবজাতকের গৌরবান্বিত মা।

শিশুটির পিতা হলেন রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহভাজন, ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্মপুত্র, বিশ্বস্ত সংগী, ইসলামের পর রাসূলুল্লাহর সা. সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি- যায়িদ ইবন হারিসা রা.।

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মক্কার সমগ্র মুসলিম সমাজ শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে উৎফুল্ল হয়েছিল। শিশুর পিতাকে যেমন তারা উপাধি দিয়েছিল ‘হিববু রাসুলিল্লাহ’, তেমনি তারা তাকে উপাধি দিল ‘ইবনুল হিব্‌ব’ বা রাসূলুল্লাহর সা. প্রীতিভাজনের পুত্র। তাদের এ উপাধি দান কিন্তু যথার্থই হয়েছিল। রাসূল সা. তাকে এত অধিক ভালোবেসেছিলেন যে, তা দেখে বিশ্ববাসীর ঈর্ষা হয়। উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. দৌহিত্র হাসান ইবন ফাতিমার সমবয়সী। হাসান ছিলেন তার নানা রাসূলুল্লাহর সা. মত দারুণ সুন্দর। আর উসামা ছিলেন তার হাবশী মা’র হাবশী মা’র মত কালো ও খাঁদা নাক বিশিষ্ট। কিন্তু রাসূল সা. তাদের দু’জনকে স্নেহ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে মোটেই কম বেশি করতেন না। তিনি উসামাকে বসাতেন এক উরুর ওপর এবং হাসানকে অন্য উরুর ওপর। তারপর দু’জনকে একসাথে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলতেনঃ ‘হে আল্লাহ, আমি তাদের দু’জনকে ভালোবাসি, তুমিও তাদের উভয়কে ভালোবাস।’

শিশু উসামার প্রতি রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা কত গভীর ও প্রবল ছিল তা বুঝা যায় একটি ঘটনা দ্বারা। শিশু উসামা একবার দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তার কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। রাসুল সা. প্রথমে হযরত আয়িশাকে রা. রক্ত মুছে দিতে বললেন। কিন্তু তাতে স্বস্তি পেলেন না। তিনি নিজেই উঠে গিয়ে রক্ত মুছে ক্ষতস্থানে চুমু দিতে লাগলেন এবং মিষ্টি মধুর ও দরদ মিশ্রিত কথা বলে তাকে শান্ত করতে লাগলেন।

শৈশবের মত যৌবনেও উসামা রাসূলুল্লাহর সা. ভালোবাসা লাভ করেন। একবার কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকীম ইবন হিযাম ইয়ামনের ‘যী ইয়াযিন’ বাদশার একখানা মূল্যবান চাদর ইয়ামন থেকে পঞ্চাশ দীনার দিয়ে খরীদ করেন। চাদরখানি তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. উপহার দিতে চাইলে তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, হাকীম তখনও মুশরিক ছিলেন। তবে রাসূল সা. তার নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে চাদরখানি খরিদ করেন। এক জুমআর দিন একবার মাত্র সে চাদরখানি রাসূল সা. পরেন। তারপর তিনি তা উসামার গায়ে পরিয়ে দেন। উসামা সে চাদরখানি প’রে তার সমবয়সী মুহাজির ও আনসার যুবকদের সাথে সকাল সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতেন।

যৌবনে উসামার মধ্যে এমন সব চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলী বিকশিত হলো যা সহজেই রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তীক্ষ্ণ মেধা, দুঃসাহস, বিচক্ষণতা, পূতঃপবিত্র চরিত্র এবং তাকওয়া ও পরহিযগারী ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

উহুদ যুদ্ধের দিন উসামা তার সমবয়সী আরো কতিপয় কিশোর সাহাবীর সাথে উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে। তাদের সবার ইচ্ছা জিহাদে অংশগ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে নির্বাচন করলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে অন্যদের ফিরিয়ে দিলেন। উসামা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাড়ীতে ফিরছেন। চোখ দু’টি তার পানিতে টলমল। তার ব্যথা, রাসূলুল্লাহর সা. পতাকাতলে জিহাদের সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন।

খন্দকের যুদ্ধ সমুপস্থিত। উসামাও হাজির। তার সাথে আরো কয়েকজন কিশোর সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সা. সৈনিক বাছাই করছেন। উহুদের মত এবারো তাঁকে ছোট বলে বাদ দেওয়া না হয়, এজন্য পায়ের আাঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালেন। তার আগ্রহ দেখে রাসূলুল্লাহর সা. অন্তর নরম হলো। তাকে নির্বাচন করলেন। তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে উসামা চললেন জিহাদে। তিনি তখন ১২/১৩ বছরের এক কিশোর।

কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে প্রথম পর্যায়ের অভিযান সমূহে তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। ‘হারকা’ অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। সাত অথবা আট হিজরীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। তখন তার বয়স চৌদ্দ। কিন্ত তার সীমাহীন যোগ্যতার কারণে রাসূল সা. তাঁকে অভিযানের নেতৃত্ব দান করেন। এ অভিযানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ ‘রাসূল সা. আমাদেরকে ‘হারকা’র দিকে পাঠালেন। শত্রুরা পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করলো। আমি এক আনসারী সিপাহীর সাথে পলায়নরত এক সৈনিকের পিছু ধাওয়া করলাম। যখন সে আমাদের নাগালের মধ্যে এসে গেল, জোরে জোরে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে উঠলো। তার এ ঘোষণায় আনসারী হাত গুটিয়ে নিল; কিন্তু আমি বর্শা ছুড়ে তাকে গেঁথে ফেললাম। সে মারা গেল। অভিযান থেকে ফেরার পর বিষয়টি রাসূলুল্লাহর সা. কর্ণগোচর হলো। তিনি আমাকে বললেনঃ উসামা, কালিমা তাইয়্যেবা পড়ার পর তুমি একটি লোককে হত্যা করেছ। আমি বললাম, প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে এমনটি করেছে। তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। একই কথা বার বার আওড়াতে লাগলেন। আমি তখন এত অনুতপ্ত হলাম যে, মনে মনে বললাম, ‘হায়! আজকের পূর্বে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা. তাঁকে বলেনঃ ‘তুমি তার অন্তর ফেঁড়ে দেখলে না কেন?’

হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে লাগলো। উসামা তখন রাসূলুল্লাহর সা. চাচা আব্বাস, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিসসহ মাত্র ছ’জন সাহাবীর সাথে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে অটল হয়ে রুখে দাঁড়ালেন। বীর বিশ্বাসীদের ক্ষুদ্র এই দলটির সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সা. সেদিন নিশ্চিত পরাজয়কে বিজয়ের রূপদান করেন এবং পলায়নরত মুসলিম বাহিনীকে মুশরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেন।

মক্কা নিজয়েও উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সংগী। রাসূলুল্লাহর সা সাথে একই বাহনে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে উসামা, বিলাল ও উসমান ইবন তালহা এ তিন ব্যক্তিই সেদিন কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এ চারজনের পরই কা’বার দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

উসামা তার পিতা সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসার সাথে মুতা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন তার বয়স আঠারো বছরেরও কম। এ যুদ্ধে তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন পিতার শাহাদাত। তবে তিনি মুষড়ে পড়েননি। পিতার শাহাদাত বরণের পর যথাক্রমে জা’ফর ইবন আবী তালিব ও আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নেতৃত্বে বাহাদুরের মত লড়াই করেন। যায়িদের মত এ সেনাপতিও শাহাদাত বরণ করলে তিনি সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে রোমান বাহিনীর পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করেন। মূতার প্রান্তরে পিতা যায়িদের মরদেহ আল্লাহর হাওয়ালা করে যে ঘোড়ার ওপর তিনি শহীদ হয়েছিলেন, তার ওপর সওয়াব হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।

একাদশ হিজরীতে রাসূল সা. রোমান বাহিনীর সাতে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বকর, ‘উমার, সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবী এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল সা. উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন। তখন তার বয়স বিশের কাছাকাছি। রাসূল সা. গাযা উপত্যকার নিকটবর্তী ‘বালকা’ ও ‘দারুম আল কিলয়ার’ আশে পাশে সীমান্তে ছাউনি ফেলার নির্দেশ দিলেন।

বাহিনী যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। এদিকে রাসূল সা. পীড়িত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাহিনীসহ তিনি যাত্রাবিরতি করে মদীনার উপকণ্ঠে ‘জুরুফ’ নামক স্থানে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখতে আসতেন। উসামা বলেন ‘রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পেলে আমি দেখতে গেলাম। আরো অনেকে আমার সংগে ছিলেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, রাসূল সা. চুপ করে আছেন। রোগের প্রচণ্ডতায় তিনি কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি আসমানের দিকে হাত উঠালেন, তারপর আমার শরীরের ওপর হাত রাখলেন। আমি বুঝলাম, তিনি আমার জন্য দু’আ করছেন।’

রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকাল হলো। খবর পেয়ে তিনি মদীনায় ছুটে এলেন এবং কাফন দাফনে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মরদেহ কবরে নামানোর সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন।

হযরত আবু বকর রা. খলিফা নির্বাচিত হলেন। তিনি উসামাকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আনসারদের ছোট্ট একটি দল মনে করলেন এ মুহূর্তে বাহিনীর যাত্রা একটু বিলম্ব করা উচিত। এ ব্যাপারে খলিফার সাথে কথা বরার জন্য তারা হযরত উমারকে রা. অনুরোধ করলেন। তারা উমারকে এ কথাও বললেন, যদি তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে অন্ততঃ তাঁকে অনুরোধ করবেন, উসামা থেকে একজন অধিক বয়সের লোককে যেন আমাদের সেনাপতি নিয়োগ করে।

হযরত আবু বকর বসে ছিলেন। হযরত ’উমারের রা. মুখে আনসারদের বক্তব্য শোনার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফারুকে আযমের দাড়ি মুট করে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেনঃ ‘ওহে খাত্তাবের পুত্র! আপনার মা নিপাত যাক! আপনি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন রাসূলুল্লাহর সা. নিয়োগ করা ব্যক্তিকে অপসারণ করতে? আল্লাহর কসম, আমার দ্বারা কক্ষণো তা হবেনা।’

’উমার রা. ফিরে এলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, সমাচার কি? বললেনঃ তোমাদের সকলের মা নিপাত যাক! তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের খলিফার নিকট থেকে অনেক কিছুই আমাকে শুনতে হলো।

যুবক কমাণ্ডারের নেতৃত্বে বাহিনী মদীনা থেকে রওয়ানা হলো। খলিফা আবু বকর রা. চললেন কিছুদূর এগিয়ে দিতে। উসামা ঘোড়ার পিঠে, খলিফা পায়ে হেঁটে। উসামা বললেনঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ সা. খলিফা! আল্লাহর কসম, হয় আপনি ঘোড়ায় উঠুন, না হয় আমি নেমে পড়ি।’ খলিফা বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, তুমিও নামবে না, আমিও উঠবো না। কিছুক্ষণ আল্লাহর পথে আমার পদযুগল ধুলিমলিন হতে দোষ কি?’ তারপর উসামাকে বললেনঃ ‘তোমার দ্বীন, তোমার আমানতদারী এবং তোমার কাজের সমাপ্তি আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করলাম। রাসূলুল্লাহ সা. যে নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন, তা কার্যকর করা উপদেশ তোমাকে দিচ্ছি।’ তারপর উসামার দিকে একটু ঝুঁকে বললেনঃ ‘তুমি যদি ’উমারের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা ভালো মনে কর, তাকে আমার কাছে থেকে যাওয়ার অনুমতি দাও।’ উসামা আবু বকরের আবেদন মঞ্জুর করলেন। উমারকে মদীনায় খলিফার সংগে থাকার অনুমতি দিলেন।

উসামা রাসূলুল্লাহর সা. আদেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী ফিলিস্তিনের ‘বালকা’ ও ‘কিলায়াতুত দারুম’ সীমান্ত পদানত করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের জন্য রোমান ভীতি চিরতরে দূরীভূত হয় এবং গোটা সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিজয়দ্বার উন্মুক্ত হয়।

এ অভিযানে তিনি তার পিতার হত্যাকারীকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রাতিশোধ নেন। যে ঘোড়ার ওপর তার পিতা শহীদ হয়েছিলেন, তার পিঠে বিপুল পরিমাণ গণিমাতের ধন সম্পদ বোঝাই করে তিনি বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে এলেন। খলিফা আবু বকর রা. মুহাজির ও আনসারদের বিরাট একটি দল সহ মদীনার উপকণ্ঠে তাঁকে স্বগত জানান। উসামা মদীনায় পৌঁছে মসজিদে নববীতে দু’রাকায়াত নামায আদায় করে বাড়ি যান। ঐতিহাসিকরা তার এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ ‘উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও গণিমাত লাভকারী অন্য কোন বাহিনী আর দেখা যায়নি।’

রাসূলুল্লাহর সা. অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য উসামা মুসলিম সমাজের ব্যাপক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার রা. নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার অপেক্ষা উসামার ভাতা বেশি নির্ধারণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ক্ষব্ধ হয়ে অভিযোগ করেনঃ ‘আব্বা, উসামার ভাতা চার হাজার, আর আমার ভাতা তিন হাজার। আমার পিতা অপেক্ষা তার পিতা অধিক মর্যাদাবান ছিলেন না এবং আমার থেকেও তার মার্যাদা বেশি নয়।’ জবাবে হযরত উমার বলেনঃ ‘আফসোস! তোমার পিতার চেয়ে তার পিতা রাসূলুল্লাহর সা. অধিক প্রিয় ছিলেন এবং তোমার থেকেও সে রাসূলুল্লাহর সা. বেশি প্রিয় ছিল।’ হযরত আবদুল্লাহ রা. আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি।

উসামার সাথে খলিফা ’উমারের দেখা হলেই বলতেনঃ ‘স্বাগতম, আমার আমীর।’ এমন সম্বোধনে কেউ বিস্মিত হলে তিনি বলতেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ সা. তাকে আমার আমীর বা নেতা বানিয়েছিলেন।

উসমানের খিলাফতকালে ফিতনা-ফাসাদের আশংকায় রাষ্ট্রীয় কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে হিতাকাংখী মুসলিম হিসাবে সর্বদা খলিফাকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং গোপনে গণ-অসন্তোষের বিষয়ে খলিফার সাথে আলোচনা করতেন।

উসমানের মৃত্যুর পর যখন বিশৃংখলা দেখা দিল, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলেন। আলী ও মুয়াবিয়ার বিরোধ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেন। এ সময় আলীকে একবার তিনি বলে পাঠালেন, ‘আপনি যদি বাঘের চোয়ালের মধ্যে ঢুকতেন, আমিও সন্তুষ্টচিত্তে ঢুকে যেতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে অংশগ্রহণের আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’ মুসলমানদের রক্তপাতের ভয়ে যদিও তিনি এ দ্বন্দ্বে জড়াতে চাননি, তবে তিনি আলীকে সত্যপন্থী বলে মনে করতেন। এ কারণে, আলীকে সাহায্য না করার জন্য শেষ জীবনে তাওবাহ করেছেন।

উসামা প্রতিপালিত হয়েছিলেন নবীগৃহে। এ কারণে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া তার উচিত ছিল। নবী মুহাম্মাদের ওয়াফাতের সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র আঠারো বছর। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর মুহাম্মাদের দীর্ঘ সাহচর্য লাভের সুযোগ তিনি পাননি। এ কারণে, এ ক্ষেত্রে তিনি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন উমার প্রমুখ সাহাবীদের মত আশানুরূপ সাফল্য লাভ করেননি। তিনি নবীর বহু বাণী স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবীরাও মাঝে মাঝে শরীয়াতের নির্দেশ জানার জন্য তার শরণাপন্ন হতেন। সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে শরীয়াতের কোন নির্দেশ না পেয়ে উসামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর নিকট থেকে কিছু শুনেছেন কি? তিনি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর একটি বাণী সা’দের নিকট বর্ণনা করেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট একশ’ আটাশটি। তন্মধ্যে পনেরটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। হাসান, মুহাম্মাদ ইবন আব্বাস, আবু হুরাইরা, কুরাইব, আবু উসমান নাহদী, ’আমর ইবন উসমান, আবু ওয়ায়িল, আমের ইবন সা’দ, হাসান বসরী প্রমুখ সাহাবী ও তাবঈ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যেহেতু নবীগৃতে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং নবী মুহাম্মাদের নিকট তার যাতায়াত ছিল অবাধ, এ কারণে নবীর শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব তার ওপর পড়েছিল। অধিকাংশ সফরে মুহাম্মাদের সাথে একই বাহনে আরোহী হতেন। এ কারণে মুহাম্মাদের সেবার সুযোগও বেশি পরিমাণে লাভ করেন। অজু ও পবিত্রতার পানি তিনিই অধিকাংশ সময় এগিয়ে দিতেন।

অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করতেন। ইফ্‌ক বা হযরত আয়িশার রা. প্রতি মুনাফিকদের বানোয়াট ও অশালীন উক্তি ছড়িয়ে পড়লে রাসূল সা. ঘনিষ্ঠ যে দু’ব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন, তারা ছিলেন হযরত আলী ও উসামা রা.।

এ মহান সেনানায়ক হযরত মুয়াবিয়ার খিলাফত কালের শেষ দিকে হিজরী ৫৪ সনে ৬০ বছর বয়সে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।

মুহাম্মাদের যুগ[সম্পাদনা]

তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মাদ কর্তৃক নিযুক্ত সবচেয়ে কনিষ্ঠ সেনাপতি।

পিতা[সম্পাদনা]

তার বাবা যায়িদ ইবনে হারিসা ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মুতার যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

উসামা ইবনে যায়িদ মুয়াবিয়ার খেলাফতকালের শেষ দিকে হিজরী ৫৪ সালে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন।

বংশধর[সম্পাদনা]

মুহাম্মাদ ইবনে উসামা নামে তার একজন পুত্র ছিল।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Who are ahl al-bayt"। ২৭ অক্টোবর ২০০৯। ২৭ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।