তেভাগা আন্দোলন
বাংলাদেশে সাম্যবাদ |
---|
সিরিজের অংশ |
সাম্যবাদ প্রবেশদ্বার |
তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর -এ শুরু হয়ে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলে। বর্গা বা ভাগ-চাষীরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত।[১] এই আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ। আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ-চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দু'টোই কৃষক দিত। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।
প্রধান দাবিঃ- ক) তেভাগা আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল উৎপন্ন ফসলের ২/৩ ভাগ তাদের দিতে হবে। খ) জমিতে ভাগ চাষীদের দখলিসত্ব দিতে হবে। গ) ভাগচাষির খামারে ধান তুলতে হবে। ঘ) ভাগ চাষের ধান বুঝে নিয়ে জমির মালিকরা রসিদ দেবে।
পটভূমি
[সম্পাদনা]তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষিরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী ব্রিটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উত্পাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো 'আধিয়ারী'। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় 'সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি'। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় 'ফ্লাউড কমিশন'। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের 'তোলা' ও 'লেখাই' সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়।
তেভাগা আন্দোলনের একজন অগ্রদূতি মহিলা ছিলেন নাচোল উপজেলার ইলা মিত্র।
দুই বাংলায় তেভাগা
[সম্পাদনা]ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে পরিহার করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। নিখিল ভারত কৃষক সভার নীতি ছিল কৃষক ঐক্য যার ভিত্তিতে তেভাগা আন্দোলন জেলায় জেলায় সমস্ত ভ্রাতৃঘাতী বিবাদকে ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে। সমিতি গঠন, মহিলা কর্মী গড়ে তোলা, সংগ্রামী তহবিল এবং রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ক্লাস ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাতে কৃষক সংগ্রামীরা একজোট হন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গ বিভিন্ন জায়গায় কৃষকেরা তেভাগার দাবী তুলেছিলেন।
তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ ছিলেন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার তালপুকুর গ্রামের সমির উদ্দিন ও শিবরাম মাঝি। সমির উদ্দিন ছিলেন মুসলমান এবং শিবরাম মাঝি ছিলেন আদিবাসী হাসদা সম্প্রদায়ের।
এছাড়াও বালুরঘাট মহকুমায় তেভাগা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পুলিশ ও জোতদারদের মিলিত আক্রমণ চরমে উঠে খাঁপুর গ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ তারিখে উক্ত গ্রামের কৃষক নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ উক্ত গ্রামে যায়। কৃষকগণ, যাদের ভেতরে অনেকেই ছিলেন সাঁওতাল, তীর, ধনুক, দা ও টাঙ্গি নিয়ে প্রতিরোধ করেন। তারপর পুলিশের গুলিতে ২২ জন শহীদ হন। শহিদদের নামগুলো হচ্ছে যশোদারানি সরকার, চিয়ারসাই শেখ, কৌশল্যা কামারনী, গুরুচরণ বর্মণ, কমরেড হোপন মার্ডি, মাঝি সরেন, দুখনা কোলকামার, পুরণা কোলকামার, ফাগুয়া কোলকামার, ভোলানাথ কোলকামার, কৈলাশ ভুঁইমালী, থোতো হেমরম, ভাদু বর্মণ, আশু বর্মণ, মঙ্গল বর্মণ, শ্যামাচরণ বর্মণ, নগেন বর্মণ, ভুবন বর্মণ, ভবানী বর্মণ, জ্ঞান বর্মণ, নারায়ণ মুর্মু এবং গহুনিয়া মাহাতো।
নেতৃবৃন্দ
[সম্পাদনা]এই আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মধ্যে হাজী দানেশ, দেবপ্রসাদ ঘোষ(পটল ঘোষ),অজিত বসু, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, কংসারী হালদার, সুশীল সেন, নুর জালাল, গণেশ দাস, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পান্ডা, রুপনারায়ণ রায়, ডা.গণেন্দ্রনাথ সরকার,বিমল দাশগুপ্ত, কালী সরকারের নাম উল্লেখ করা যায়। মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল তেভাগার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।[২]
ঠাকুরগাঁওয়ে আন্দোলন
[সম্পাদনা]১৯৪৬ সালে রানীশংকৈল উপজেলায় তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় কৃষক নারীরা লাঠি, ঝাঁটা, দা-বটি, কুড়াল যে যা হাতের কাছে পায় তাই দিয়ে পুলিশকে বাঁধা দেয়। একজন বন্দুকধারী পুলিশ নারী ভলান্টিয়ারদের প্রতি অসম্মানজনক উক্তি করে গালি দেয়। কৃষক নেতা ও রাজবংশী নারী ভাণ্ডনীর নেতৃত্বে কৃষক নারীরা পুলিসটিকে গ্রেপ্তার করে সারারাত আটক রাখে। ভাণ্ডনী সারারাত বন্দুক কাঁধে করে তাকে পাহারা দেয়।[৩]
সাহিত্য ও গানে
[সম্পাদনা]তেভাগা আন্দোলনে প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও শিল্পী রাও আলোড়িত হয়েছেন। সোমনাথ হোড়ের চিত্র এবং দিনপঞ্জি 'তেভাগার ডায়েরী' উল্লেখযোগ্য রচনা। গোলাম কুদ্দুস পূর্ণেন্দু পত্রী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা তেভাগা আন্দোলনের ওপর উপন্যাস কবিতা রচনা করেন। সলিল চৌধুরীর গান 'হেই সামালো ধান' ও কবিয়াল নিবারণ পন্ডিতের 'মোদের দুখের কথা কাহাকে জানাই' এর নাম করা যায়। এছাড়াও শওকত আলী রচনা করেন নাঢ়াই। চলচ্চিত্র: তেভাগা আন্দোলন নিয়ে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের কাহিনীতে ২০০০-২০০১ অর্থবছরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে 'আধিয়ার' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এটি পরিচালনা করেছেন সাইদুল আনাম টুটুল।
নেতৃবৃন্দ
[সম্পাদনা]- ইলা মিত্র
- কংসারী হালদার
- দেবপ্রসাদ ঘোষ (পটল ঘোষ)
- মণি সিংহ
- বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়
- এম এ রসুল
- মনি গুহ
- চারু মজুমদার
- অবনী লাহিড়ী
- গুরুদাস তালুকদার
- সমর গাঙ্গুলি
- বিমল দাশগুপ্ত
- গণেশ দাস
- বিমলা মণ্ডল
- সুধার মুখার্জি
- সুদীপ সেন
- মণিকৃষ্ণ সেন
- সুবোধ রায়
- বুড়ি মা
- হাজী মোহাম্মদ দানেশ
- ডাঃগণেন্দ্রনাথ সরকার
- নিয়ামত আলী
- ভবানী সেন
চিত্রশালা
[সম্পাদনা]-
খাঁপুরের শহীদ যশোদারাণী সরকার
-
খাঁপুরের শহীদ নারায়ণ মুর্মু
-
খাঁপুরের শহীদ ভবানী বর্মণ
-
আন্দোলনের নামে চালুকৃত ট্রেন তেভাগা এক্সপ্রেস
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Majumdar, Asok. (২০১১)। The Tebhaga movement : politics of peasant protest in Bengal, 1946-50। New Delhi: Aakar Books। পৃষ্ঠা ১৩। আইএসবিএন 9789350021590। ওসিএলসি 758245247।
- ↑ জয়ন্ত ভট্টাচার্য (১৯৯৬)। বাংলার তেভাগা, তেভাগার সংগ্রাম। কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা ৩৯,৭২,৯৮।
- ↑ রায়, সুপ্রকাশ (জানুয়ারি ২০১১)। "ঠাকুরগাঁওয়ে তেভাগা আন্দোলন"। তেভাগা সংগ্রাম (সংশোধিত দ্বিতীয় প্রকাশ সংস্করণ)। কলকাতা: র্যাডিক্যাল। পৃষ্ঠা ১১–১২।
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |