অনন্ত চতুর্দশী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অনন্ত চতুর্দশী
অনন্ত বিষ্ণুর প্রস্তরমূর্তি, পরশুরামেশ্বর মন্দির, ভুবনেশ্বর
পালনকারীহিন্দু
ধরনধর্মীয়, ভারতীয় উপমহাদেশ
পালনগণেশ মূর্তি বিসর্জন, যজ্ঞের সূতো পরিধান (যজ্ঞোপবীত), প্রার্থনা, ভারতীয় সংস্কৃতি (দেখুন পূজা, প্রসাদ)
তারিখভাদ্রপদ শুক্ল চতুর্দশী
সংঘটনবার্ষিক

অনন্ত চতুর্দশী ( সংস্কৃত: अनंतचतुर्दशी ) হলো বিষ্ণুকে উৎসর্গিত একটি উৎসব যা হিন্দুধর্মে পালন করা হয়। এটি হিন্দু ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষে চতুর্দশীতে (চৌদ্দতম দিনে) চিহ্নিত করা হয়। অগ্নি পুরাণ অনুসারে, পালনকারী কর্তৃক পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এই উপলক্ষে বিষ্ণুর অনন্ত (শেষ; ঐশ্বরিক সর্প) প্রকাশকে পূজা করা হয়। [১] [২]

অনন্ত [৩] চতুর্দশীকে দশ দিনব্যাপী গণেশ চতুর্থী উৎসবের শেষ দিন হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়। ভক্তগণ যখন গণেশের মূর্তি জলে বিসর্জন দিয়ে তাঁকে বিদায় জানায় তখন দিনটিকে গণেশ চৌদসও বলা হয় ।

কিংবদন্তি[সম্পাদনা]

অনন্ত চতুর্দশী সম্বন্ধে একটি কিংবদন্তি মহাভারতে পাওয়া যায়। এতে সুশীলা নামে এক নারীর গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যিনি একটি নদীর তীরে অনন্ত পূজারত একদল মহিলার মুখোমুখি হন। তারা ব্যাখ্যা করেন, যারা এই ব্রত সম্পাদন করে তারা মহৎ পূণ্য অর্জন করবে ও নিরাপত্তা প্রাপ্ত হতে পারবে। অনন্তের রূপটি দর্ভ (পবিত্র ঘাস) থেকে তৈরি করা হয়েছিল এবং একটি ঝুড়িতে রাখা হয়েছিল যেখানে এটি সুগন্ধি ফুল, তেলের প্রদীপ, ধূপকাঠি ও তাদের তৈরি খাবার দিয়ে পূজা করা হয়েছিল। সুশীলা এই আচার-অনুষ্ঠানে মহিলাদের সাথে যোগ দেন যার ফলে তার কব্জিতে একটি ১৪টি গিঁটযুক্ত-সংস্কারমূলক সুতো বাঁধা হয়। তারপর তিনি তার স্বামী ঋষি কৌন্ডিন্যের নিকট ফিরে আসেন। [৩]

দম্পতি অমরাবতী নামক একটি নগরে পৌঁছলো যার বাসিন্দারা তাদের ধার্মিকতার জন্য স্বাগত জানিয়ে তাদের একটি প্রশস্ত বাড়ি অর্পণ করেছিল। কৌণ্ডিন্য উন্নতি লাভ করতে লাগলেন এবং অত্যন্ত ধনী হয়ে উঠলেন। একদিন কৌন্ডিল্য সুশীলার কব্জিতে সুতোটি লক্ষ্য করলেন। যখন তিনি তার কাছ থেকে শুনলেন যে তার সম্পদ লাভের পিছনে তার ব্রত পালনের কারণ ছিল তখন তিনি অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন, সম্পদপ্রাপ্তি অনন্ত ব্রতের কারণে নয়, তার নিজের প্রচেষ্টার কারণে হয়েছে। এই বলে, কৌন্ডিন্য সুশীলার হাত থেকে সুতাটা নিয়ে তার অনুরোধ সত্ত্বেও আগুনে নিক্ষেপ করলেন।

এর পর, তাদের উপর দুর্ভাগ্য নেমে আসে: তারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে , প্রতিবেশীরা তাদের থেকে দূরে সরে যায় এবং ঘরে আগুন লেগে যায়। অনুতপ্ত কৌণ্ডিন্য বুঝতে পারলেন, অনন্তকে অসম্মান করার জন্য এটি তার শাস্তি। তিনি জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণী ও হ্রদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তারা কি তাকে বলতে পারে যে তিনি অনন্তকে কোথায় খুঁজে পেতে পারেন। ভ্রমণকালে তিনি অনেক অস্বাভাবিক দৃশ্য অবলোকন করেন। অবশেষে, অনন্তদেব একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করেন ও তার সামনে উপস্থিত হন। পরে কৌন্ডিন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কৌন্ডিন্য তার বিচরণকালে যে অস্বাভাবিক দর্শনীয় স্থানগুলি অবলোকন করেছিল তার তাৎপর্য ব্যাখ্যার পর অনন্ত কৌন্ডিন্যকে ক্ষমা করে দেন। তিনি তাকে চৌদ্দ বছর ধরে অনন্ত চতুর্দশী ব্রত পালন করতে বলেন, এবং আশ্বাস দেন যে এর ফলে তিনি জীবদ্দশায় শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন হবেন তথা মৃত্যুর পর নক্ষত্রলোক লাভ করবেন। এইভাবে, কৌন্ডিন্য ও সুশীলা ব্রত পালন করে সুখী জীবনযাপন করতে থাকেন। [১]

জৈনধর্মীয় তাৎপর্য[সম্পাদনা]

উৎসবটি জৈন ক্যালেন্ডারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। শ্বেতাম্বর জৈনরা ভাদো মাসের শেষ ১০ দিন পর্ব পর্যূষণ পালন করে- দিগম্বর জৈনরা দশলক্ষণ পর্বের দশ দিন পালন করে। চতুর্দশী (অনন্ত চৌদাস) দশলক্ষণ পর্বের শেষ দিন। ক্ষমাবণী দিন জৈনরা ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যা অনন্ত চতুর্দশীর একদিন পরে পালন করা হয়। এই দিন বর্তমান মহাজাগতিক চক্রের ১২ তম তীর্থঙ্কর বাসুপুজ্য নির্বাণ লাভ করেছিলেন।[ উদ্ধৃতি প্রয়োজন ]

হিন্দুধর্মীয় তাৎপর্য[সম্পাদনা]

নেপাল, বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশের কিছু অংশে, উৎসববটি ক্ষীর সাগর (দুধের মহাসাগর) ও বিষ্ণুর অনন্তরূপের (অনন্তের রূপ) সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কুমকুম বা সিঁদুরের (হিঙ্গুলের গুড়ো) চৌদ্দটি তিলক একটি কাঠের তক্তায় তৈরি করা হয়। চৌদ্দটি পুরি (ভাজা গমের রুটি) ও ১৪ টি পুয়া (ঘন ভাজা মিষ্টি গমের রুটি) সিঁদুরের তিলকের উপর রাখা হয়। এই কাঠের তক্তাটিতে ক্ষীর সাগরের প্রতীক পঞ্চামৃত (দুধ, দই, গুড় বা চিনি, মধুঘি দিয়ে তৈরি) বাটি রাখা হয়। ১৪টি গিঁট বিশিষ্ট একটি সুতো( বিষ্ণুর অনন্তরূপের প্রতীক) একটি শসার উপর মোড়ানো হয় ও পঞ্চামৃতে পাঁচবার ঘূর্ণিত করা হয়। পরবর্তীতে, এই অনন্ত সুতোটি পুরুষরা কনুইয়ের উপরে ডান হাতে ও নারীরা বাম হাতে ধারণ করে। এই অনন্ত সুতো ১৪ দিন পর সরানো হয়। বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ভক্তরা এ দিন উপবাস করেন। [৪]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Saxena, Monika (২০১৮-০৯-০৩)। Women and the Puranic Tradition in India (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। পৃষ্ঠা 198। আইএসবিএন 978-0-429-82639-9 
  2. Dalal, Roshen (২০১০)। Hinduism: An Alphabetical Guide (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 245। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6 
  3. Melton, J. Gordon (২০১১-০৯-১৩)। Religious Celebrations: An Encyclopedia of Holidays, Festivals, Solemn Observances, and Spiritual Commemorations (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 32–33। আইএসবিএন 978-1-59884-205-0 
  4. Lochtefeld, James G. (২০০২)। The Illustrated Encyclopedia of Hinduism: A-M (ইংরেজি ভাষায়)। Rosen। পৃষ্ঠা 37। আইএসবিএন 978-0-8239-3179-8