বাংলার রোমানীকরণ
বাংলার রোমানীকরণ বা বাংলা ভাষার রোমানীকরণ হচ্ছে, বাংলা লিপিকে রোমান লিপিতে রূপান্তর এবং উপস্থাপন করা। বাংলা ভাষার রোমানীকরণ অবাঙালি পাঠকদেরকে বাংলা ভাষার উচ্চারণগুলি বুঝতে সাহায্য করে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ষোড়শ শতকে বাংলায় অবস্থানরত পর্তুগিজ মিশনারিরাই প্রথম বাংলা বই লেখার ক্ষেত্রে লাতিন বর্ণমালা ব্যবহার করেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত হল কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ (Crepar Xaxtrer Orthbhed) এবং ভোকাবুলারিও এঁ ইদিওমা বেঙ্গালা এ পোর্তুগেস্ (Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez), উভয়ই মানুয়েল দা আস্সুম্পসাঁউ লিখেছেন। তবে, পর্তুগিজ ভিত্তিক রোমানীকরণ স্থায়ী হতে পারেনি। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে, অগাস্টিন অসান্ট ফরাসি বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে একটি রোমানীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। একই সময়ে, ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালেড তার বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের জন্য ইংরেজি ভিত্তিক একটি রোমানীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। হ্যালহেডের পরে, ১৭৮৮ সালে বিখ্যাত ইংরেজ ফিলোলজিস্ট এবং প্রাচ্য পণ্ডিত উইলিয়াম জোনস বাংলা এবং সাধারণভাবে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার জন্য একটি রোমানীকরণ পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন; তিনি এটি ১৮০১ সালে এশিয়াটিক রিসার্চেস জার্নালে প্রকাশ করেন।[১] তার পরিকল্পনাটি রোমানীকরণের "জোনেসিয়ান সিস্টেম" হিসাবে পরিচিত হয় এবং পরবর্তী দেড় শতাব্দীর জন্য একটি মডেল হিসাবে কাজ করে। লাহোর সরকারি কলেজের অধ্যাপক লাইটনার এর বিরোধিতা করেন।[২]
তার ১০০ বছর পর অর্থাৎ ২০ শতকের শুরুতে, ইটন কলেজের সহকারী শিক্ষক ড্রু ভারতীয় ভাষাসমূহ রোমান হরফে লিখার সুপারিশ করেন ও এ লক্ষ্যে রোমান উর্দু নামক পত্রিকা চালু করা হয়।[২]
১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক আজাদে প্রকাশিত আবুল ফজল মুহাম্মদ আখতারু-দ্-দীন রচিত "বাংলা বর্ণমালার পরিবর্ত্তন" নামক প্রবন্ধে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় বাংলার জন্য রোমান হরফ সমর্থন করেছিলেন, এবং পরে তিনি এ মত পরিবর্তন করেন।[২]
এছাড়া ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও রোমান হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ করেছিলেন।[২] লাতিন লিপির সরলতা, স্বরবর্ণদের পৃথকভাবে লেখা, শিখন ও মুদ্রণে এর বিবিধ সুবিধা এবং সভ্য বিশ্বে এর বহুল ব্যবহারের জন্য তিনি লাতিন লিপিতে বাংলা ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষা লেখার সুপারিশ করেছিলেন।[৩]
বাংলা ভাষা আন্দোলন
[সম্পাদনা]১৯৪০-৫০ এর দশকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়, তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের বিষয়ে অন্যান্য প্রস্তাবের সাথে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু অন্যান্য প্রস্তাবগুলির মতো এটিও ব্যর্থ হয়েছিল, বাংলা ভাষার ঐতিহ্যগত বর্ণসমেত ভাষাটি তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।[৪][৫] ১৯৪৭ এর পর কুদরত-ই-খুদা ও নজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান সহ আরও অনেক পূর্ব পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ রোমান হরফে বাংলা লেখার মতকে সমর্থন করেন।[২] ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ ফেরদৌস খান তার The language problem of today নামক পুস্তিকায় এর বিরোধিতা করেন।[২]
১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক আজাদে প্রকাশিত আবুল ফজল মুহাম্মদ আখতারু-দ্-দীন তার রচিত "বাংলা বর্ণমালার পরিবর্ত্তন" নামক প্রবন্ধে রোমান হরফকে সমর্থন করেন।[২]
পূর্ব-বাংলা সরকারের ১৯৪৯ সালের ভাষা কমিটি শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চ সরকারি কর্মচারী, বিধান-পরিষদ সদস্যের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী, ৩০১ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৯৬ জন আরবি লিপি, ১৮ জন রোমান লিপি প্রবর্তনের পক্ষে এবং ১৮৭ জন বাংলা লিপি বজায় রাখার পক্ষে মত দেন। পাশাপাশি বহু ব্যক্তি কোনো উত্তর দেন নি।[২]
ভাষা আন্দোলনের পর
[সম্পাদনা]১৯৫৭ সালে পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষা কমিশন বয়স্কদের শিক্ষায় সংশোধিত রোমান হরফ ব্যবহারের সুপারিশ করেন।[২]
১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে পুনরায় রোমান হরফ প্রচলনের উল্লেখযোগ্য দাবি ওঠে। এসময় মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও মুহম্মদ এনামুল হক এর বিরোধিতা করেন।[২]
রোমানীকরণ পদ্ধতি
[সম্পাদনা]বাংলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার জন্য বিভিন্ন রোমানীকরণ পদ্ধতি প্রচলিত। হান্টারীয় প্রতিবর্ণীকরণ পদ্ধতি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় রোমানীকরণ পদ্ধতি। এছাড়া আইট্রান্স, হার্ভার্ড-কিয়োটো (হা.কি.), কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগার রোমানীকরণ (ক.জা.গ্র.) ও আইএসও ১৫৯১৯ রোমানীকরণ পদ্ধতিও প্রচলিত। নিচের সারণিতে হান্টারীয় প্রতিবর্ণীকরণ, হার্ভার্ড-কিয়োটো, ক.জা.গ্র. ও আইএসও ১৫৯১৯ রোমানীকরণ পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করা হয়েছে।
স্বরবর্ণ
[সম্পাদনা]
|
|
ব্যঞ্জনবর্ণ ও সংশোধক
[সম্পাদনা]
|
|
| |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
|
উদাহরণ
[সম্পাদনা]নিম্নলিখিত সারণিতে উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে রোমানীকরণ করা বাংলা শব্দের উদাহরণ রয়েছে। এখানে অনুচ্চারিত অকারদের অপসারণ করা হয়েছে।
বাংলা | হান্টারীয় | হা.কি. | ক.জা.গ্র. | আইএসও |
---|---|---|---|---|
মন | man | man | man | man |
শাপ | shap | zAp | śāp | śāp |
সাপ | sap | sAp | sāp | sāp |
ষাঁড় | shanr | SAMR | ṣām̐d̂ | ṣām̐ṛ |
মত ("অভিমত" বা "সম্মতি" অর্থে) |
mat | mat | mat | mat |
মত ("তুল্য" বা "সদৃশ" অর্থে) |
mata | mata | mata | mata |
মতো | mato | mato | matō | matō |
তেল | tel | tel | tēl | tēl |
গেল | gela | gela | gēla | gēla |
জ্বর | jbar | jbar | jbar | jbar |
ফল | phal | phal | phal | phal |
বাংলাদেশ | banladesh | bAMlAdez | bāṃlādēś | bāṁlādēś |
ভারত | bharat | bhArat | bhārat | bhārat |
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- মুরাদ টাকলা – বাংলার অপ্রমিত রোমানীকরণের ফল
- দোভাষী
- আরবি বর্ণে বাংলা লিখন
- হিংলিশ – হিন্দি ভাষার রোমানীকৃত রূপ
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Jones 1801
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ বশীর আল-হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫,পৃঃ ৬৮৫-৬৯২
- ↑ চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯২৬), দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।
- ↑ হোসেন, সেলিনা; বিশ্বাস, সুকুমার; চৌধুরী, শফিকুর রহমান, সম্পাদকগণ (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)। 1513. একুশের স্মারকগ্রন্থ’ ৮৬ - সম্পাদনায়। Bangladesh: Bangla Academy। পৃষ্ঠা 52–73। সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভেম্বর ২০২২।
- ↑ আল-হেলাল, বশীর (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (২য় সংস্করণ)। বাংলাবাজার, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৬৮৫–৬৯১। আইএসবিএন 984-401-523-5। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০২২।