প্রাচীন বাংলা
প্রাচীন বাংলা | |
---|---|
![]() চর্যাপদ-এর ৩৯ নং পৃষ্ঠা; প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন | |
অঞ্চল | বঙ্গ |
জাতি | বাঙালি |
যুগ | ১৪তম শতাব্দীর মধ্যে মধ্য বাংলায় বিকশিত হয়
|
ইন্দো-ইউরোপীয়
| |
পূর্বসূরী | প্রত্ন-গৌড়–কামরূপ
|
গৌড়ি লিপি | |
ভাষা কোডসমূহ | |
আইএসও ৬৩৯-৩ | – |
প্রাচীন বাংলা ছিল বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নথিভুক্ত রূপ, যেটি মধ্যযুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ অঞ্চলে কথ্য ছিল। এটি ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মগধী প্রাকৃত থেকে বিবর্তিত অপভ্রংশ থেকে বিকশিত হয়েছিল এবং প্রথম প্রাচীন বাংলা সাহিত্য রচনাগুলি ৮ম শতাব্দীর থেকে পাওয়া যায়। ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ কোন প্রকার বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য পাওয়া যায়না; এই সময়ে বাংলায় ইসলামিক বহিরাক্রমণ ঘটেছিল। এটিকে অনুর্বর যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, এবং প্রাচীন বাংলা যুগের সমাপ্তিকাল হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, যেহেতু পরবর্তী সময়ে মধ্য বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল।
প্রাচীন বাংলা হলো পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা যা মাগধী ভাষাগুলির মধ্যে একটি, এবং এর নিকটতম আত্মীয় হল প্রাচীন ওড়িয়া ও কামরূপী প্রাকৃত। অন্যান্য প্রাচীন পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষার মতো, এটি আধুনিক বাংলা থেকে আলাদা এবং আধুনিক বাংলাভাষীদের জন্য অধ্যয়ন ছাড়াই সম্পূর্ণ-রূপে বোধগম্য নয়। পুরানো বাংলা ব্যাকরণের মধ্যে ক্রিয়াপদের বিবর্তন ঘটেছিল এবং শব্দের যুক্তব্যঞ্জনসমূহের একটি লোপ পায়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রাচীন বাংলার উদ্ভবের সময়সীমা ধরা হয় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ, এবং এর উদ্ভব ঘটেছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী প্রত্ন-বাংলা থেকে। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এটি শেষ অপভ্রংশ পর্যায়কে ওভারল্যাপ করেছিল। তিনি এটিকে আধুনিক রোমান্স ও টিউটনিক ভাষার ‘সি ওল্ড’ সময়ের সাথে তুলনা করেছে; যেহেতু একটি ইতিমধ্যেই ক্ষয়প্রাপ্ত ক্রমটির শেষ পর্যায়, এতে বিবর্তন কম ঘটেছিল।
প্রাচীন বাংলা ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গ অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়েছিল যা পরবর্তীতে পাল সাম্রাজ্য ও সেন রাজ্যে পরিণত রূপ পেয়েছিল। এর ভাষাভাষী সীমানার মধ্যে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও এর পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা, বরাক উপত্যকা, এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ছিল।
চৈনিক কবি লি ইয়ে দ্বারা ৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সংকলিত একটি সংস্কৃত-চীনা অভিধানে বাংলা ভাষার উপস্থিতি দেখা যায়। কলকাতা ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান "ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ" থেকে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি চার খন্ডের গবেষনা পত্র ক্লাসিক্যাল বাংলা, অভিধানটিতে ৫১ টি বাংলা শব্দের উপস্থিতি উল্লেখ করে। চীনা ও সংস্কৃত ভাষার অভিধানে তৃতীয় একটি ভাষা হিসাবে বাংলা বা বাংলা শব্দকে অন্তর্ভুক্ত করা বা অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হওয়া এই সত্যের ইঙ্গিত দেয় যে—বাংলা ইতিমধ্যেই প্রমিত হয়েছে এবং এটি একটি প্রভাবশালী ভাষা ছিল যা ভৌগোলিক অঞ্চলের ভাষা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল যা বাংলা নামে পরিচিত ছিল।[১]
বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চর্যা রচনা। রচনার সময়কাল নিয়েও ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলির রচনা কাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে; কিন্তু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন। মানসোল্লোস বা অভিলষিতার্থচিন্তামণি গ্রন্থে সংকলিত প্রাচীন বাংলা গানগুলি দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থেটি রচনায় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বর। গানগুলি বাংলা অঞ্চলে রচিত হয়েছিল এবং মহারাষ্ট্র প্রান্ত পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল।
ধ্বনিবিদ্যা
[সম্পাদনা]প্রাচীন বাংলার প্রাক-ইতিহাস ও ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু প্রধান শব্দ পরিবর্তনগুলি নিম্নরূপ ছিল:
- প্রাচীন বাংলায় সমীভূত যুগ্ম-ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি লুপ্ত হয়েছিল, যেমন–পব্বত ⟩ পবত, জন্ম ⟩ জম এবং এই লোপের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পূর্ববর্তী স্বরধবনি দীর্ঘায়িত হয়, যেমন–পবত = প্ + অ + ব্ + অ + তৃ + অ ⟩ পাবত = প্ +আ+ব্+অ+তৃ+ অজম -্জ্ +অ +মৃ +অ জাম -জ + আ +মৃ + অ। এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায় অর্ধতৎসম শব্দে। সেখানে সমীভূত যুগ্ম ব্যঞ্নের একটি লোপ পেয়েছে কিন্তু পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়নি, যেমন–মিথ্যা ⟩ মিছা। নাসিক্য ব্যঞ্জনের সংযোগে গঠিত যুক্তব্যঞ্জনও অনেক সময় সমীভূত হয়নি; তা সত্তেও প্রাচীন বাংলায় এই ধরনের যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়েছে, যেমন-বন্ধ ⟩ বান্ধ।[২][৩]
- নাসিক্য ব্যঞ্জন অনেক ক্ষেত্রে লোপ পায়, এবং তার ফলে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি অনুনাসিক হয়ে গিয়েছিল। যেমন–শব্দেন ⟩ সাদেঁ।[২][৪]
- পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক স্বরধ্বনি বজায় ছিল, অর্থাৎ দু'টি মিলে একটি স্বরে পরিণত হয়নি, যেমন–উদাস ⟩ উআস। কিন্তু পদের অন্তে অবস্থিত একাধিক স্বর যৌগিক স্বরূপে উচ্চারিত হত এবং ক্রমে দুটি মিলে একক স্বরে পরিণত হয়েছিল। যেমন-ভণতি ⟩ ভণই।[২][৩]
ব্যাকরণ
[সম্পাদনা]প্রাচীন বাংলার ব্যাকরণে বিভিন্ন প্রকরণ- পদ, কারক-বিভক্তি, লিঙ্গ, বচন ইত্যাদিতে সংস্কৃত, প্রাকৃতে ও অবহট্ঠে লক্ষণ ও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রাচীন বাংলায় বিশেষণের লিঙ্গ হত, যা আধুনিক বাংলায় হ্রাস পেয়েছে। ক্রিয়া বিশেষণের ক্ষেত্রে ‘এ’ বা ‘এঁ’ বিভক্তি যোগ করা হত। আবার অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে ‘ই’ বা ‘ইয়া’ যোগ করে ক্রিয়া বিশেষণ করা হয়েছে।
সর্বনামের দুটি প্রকার ছিল—পুরুষবাচক ও নির্দেশক। পুরুষবাচক সর্বনাম দু’প্রকাররে ছিল— উত্তম ও মধ্যম, এবং নির্দেশক সর্বনাম পাঁচ প্রকারে ছিল— সাধারণ নিরদেশক, নিকট নির্দেশক, দূর নির্দেশক, সম্বন্ধ নির্দেশক ও অ নিশ্চয় সূচক বা অনির্দিষ্ট নির্দেশক। লিঙ্গ অনুসারে সর্বনামের কোন প্রকারভেদ ছিল না। আমি আমরা যে কোন লিঙ্গকে, স্ত্রী বা পুরুষ, বোঝাতে ব্যবহৃত হত।
সাহিত্য
[সম্পাদনা]প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সংগ্রহ ছোট কিন্তু এখনও তাৎপর্যপূর্ণ, কিছুটি টিকে থাকা পাণ্ডুলিপি রয়েছে। বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়া রচনা প্রাচীন বাংলাতে মিশে যায়, যা মাগধী থেকে উদ্ভূত প্রাথমিক পুর্বী ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সংরক্ষিত সাহিত্যের সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্থাগুলির মধ্যে একটি।[৫]
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল চর্যাপদ, এক প্রকার সাধন সঙ্গীতের সংকলন; যা প্রাচীন বাংলা ভাষায় সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে বিবেচিত।[৬] তিব্বতি সূত্রর অনুসারে, মূল পুঁথির নাম চর্যাগীতিকোষ এবং এতে ১০০টি পদ ছিল। তবে এখনও পর্যন্ত পুঁথির ৫১ টি পদের আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও কিছু সাহিত্য কর্ম রয়েছে, যেমন-সেকশুভোদয়ায় সঙ্কলিত দু-চারটি বাংলা গান, বিদগ্ধ মুখমণ্ডল-এর কিছু ছড়া ও কবিতা।[৭] অমর সিংহ রচিত সংস্কৃত অভিধান-কল্প গ্রন্থ অমরকোষ-এর টীকা রচনা করেছিলেন বন্দ্যঘটীয় সর্বান্দ, যেখানে যে প্রায় চার'শ বাংলা শব্দ আছে সেগুলিকে প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে ধরা হয়।[৬]
প্রাচীন বাংলায় রচিত কিছু গান মানসোল্লো বা অভিলষিতার্থচিন্তামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থটির গীতবিনোদ অংশে বাংলা গানগুলি স্থান পেয়েছিল। গানগুলির বিষয়বস্তু ছিল গোপীদের সহিত কৃষ্ণের লীলা ও বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারে কাহিনী বর্ণনা।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ মিত্র, অত্রি (৮ অক্টোবর ২০২৪)। "Behind Bengali's classical language tag, a Kolkata institute's 2,000-page research document"। The Indian Express। কলকাতা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ শ ১৯৮৪, পৃ. ৬০১।
- ↑ ক খ ভট্টাচার্য ২০১২, পৃ. ১৪৭।
- ↑ ভট্টাচার্য ২০১২, পৃ. ১৪৮।
- ↑ শ ১৯৮৪, পৃ. ৬০০–৬০১।
- ↑ ক খ শ ১৯৮৪, পৃ. ৬০০।
- ↑ শ ১৯৮৪।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- শ, ডঃ রামেম্ব (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪)। সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। কলকাতা: পুস্তক বিপণী। আইএসবিএন 81-85471-12-6। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০২৪।
- ভট্টাচার্য, সুভাষ (২০১২)। ভাষার তত্ত্ব ও বাংলা ভাষা। কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ। আইএসবিএন 978-93-82012-12-2। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০২৪।
- Chatterji, Suniti Kumar (১৯২৬a)। The Origin and Development of the Bengali Language (English ভাষায়)। 1। Kolkata: Calcutta University Press। সংগ্রহের তারিখ ৮ অক্টোবর ২০২৪।
- Chatterji, Suniti Kumar (১৯২৬a)। The Origin and Development of the Bengali Language (English ভাষায়)। 2। Kolkata: Calcutta University Press। সংগ্রহের তারিখ ৮ অক্টোবর ২০২৪।
- Shahidullah, Dr. Muhammad (১৯৯৮)। Bangla Vasar Itibritto। Dhaka: Mowla Brothers। সংগ্রহের তারিখ ৮ অক্টোবর ২০২৪।