মূসা
মুসা আলাইহিস সালাম - (عليه السلام) | |
---|---|
মুসা - موسى | |
![]() ইসলামী লিপিবিদ্যায় লেখা মুসার নাম | |
জন্ম | আনু. ২০৭৬ হিজরীর পূর্বে (আনু. ১৩৯২ বিসিই) |
মৃত্যু | আনু. ১৯৫২ হিজরীর পূর্বে (আনু. ১২৭২ বিসিই) |

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী ছয়জন বিশিষ্ট নবীদের বংশধারা | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ডটেড লাইন এর মাধ্যমে একাধিক প্রজন্মের নির্দেশ করা হয়েছে |
![]() |
ইসলাম |
---|
এর ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ: |
![]() |
মূসা (ইংরেজি: Moses, হিব্রু: מֹשֶׁה, আধুনিক Mošə তিবেরিয়ান Mōšeh; আরবি: موسى, Mūsa; Ge'ez: ሙሴ Musse) ইহুদি, খ্রিস্ট, এবং ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত রাসুল বা ঈশ্বরের বার্তাবাহক। তিনি মোজেস নামেও পরিচিত ছিলেন। কোরআনে মুসা (আলাইহিস সালাম) নাম অন্য নবীদের তুলনায় বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে মুসা (আলাইহিস সালাম) ১২০ বছর বেচে ছিলেন। হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর সম্প্রদায়ের নাম ছিল বনী-ইসরাঈল। বলা হয়, তার মুজিযাসমূহ বিগত অন্যান্য নবী-রসূলগণের তুলনায় সংখ্যায় বেশি, প্রকাশের বলিষ্ঠতার দিক দিয়েও অধিক।
শিশু মূসা[সম্পাদনা]
মুসার সময় যে ফেরাউন ছিল তিনি ১৮তম রাজবংশের, তার নাম কাবুস বলে উল্লেখ করা হয়।[১] সে যুগে ফেরাউন হতো মিসরের সম্রাটের খেতাব। ফেরাউন যখন স্বপ্নে দেখলেন যে, বনী-ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্র সন্তান কর্তৃক তিনি বিতাড়িত হবেন। তার রাজত্বের অবসান ঘটবে এবং তার প্রবর্তিত দ্বীনের পরিবর্তন হবে। তখন তিনি তার পরিষদবর্গকে এ বিষয় অবিহত করলেন এবং এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন।[২] হামান ছিলেন ফেরাউনের মন্ত্রী। তাদের স্বপ্নের ব্যাখার ভিত্তিতে ফেরাউন শঙ্কিত হয় এবং তার প্রতিকার হিসেবে তিনি ফরমান জারি করেন যে, বনী-ইসরাঈলের কোন নবজাতক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই যেন তাকে হত্যা করা হয়। প্রতিটি সন্তান-সম্ভবা মায়ের প্রতি যেন নজরদারী রাখা হয়। এভাবে কিছুকাল অতীবাহিত হওয়াতে বনী-ইসরাঈলের পুত্র সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে এবং এতে করে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের লোকজন আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, বনী-ইসরাঈল বংশের বিলুপ্ত ঘটলে তাদের দাস ও শ্রমিকের অভাব ঘটবে এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। তারা এ আশঙ্কার বিষয়টি ফেরাউনকে অবহিত করেন। অতঃপর তিনি নির্দেশ দেন যে, বছর অন্তর অন্তর যেন পুত্র সন্তান হত্যা করা হয়; তবে গোপনে গোপনে সার্বিক হত্যার ঘটনা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। বর্ণিত আছে যে, বছর হত্যার আদেশ রহিত ছিল সেই বছর হারুন জন্মগ্রহণ করেন। আর হত্যার আদেশ যখন বলবৎ ও কার্যকরী ছিল সেই বছর হযরত মূসা মায়ের পেটে আসেন। বিষয়টি তার স্বীয় কন্যা মরিয়ম ব্যতীত আর কেউ জানত না। কথিত আছে ‘কাবেলা’ নামক এক কিবতী স্ত্রী মূসার মাতার প্রতি প্রহরী রূপে নিযুক্ত ছিল। ভূমিষ্ট কালীন সময়ে সে হাজির হয় সদ্যোজাত মূসার রূপ লাবণ্য দর্শনে কাবেলা মুগ্ধ হয়ে পড়ে এবং শিশুর প্রতি তার স্নেহ-মায়া সৃষ্টি হয়। সে মূসার জননীকে অভয় দিয়ে বলে, ‘তুমি চিন্তা করিও না, আমি এ বিষয় প্রকাশ করিব না। এভাবে মূসা জননী শিশু মূসাকে তিন চার মাস পর্যন্ত বুকের দুধা খাইয়ে গোপনে বড় করতে থাকেন। শিশু মূসার জন্মের পর থেকেই উম্মে মূসা বিচলিত হয়ে পড়েন এই ভেবে না জানি এ সংবাদ ফিরআউনের দরবারে পৌঁছে যায়। নিষেধাজ্ঞার কালে গর্ভধারণ, পুত্র সন্তান প্রশব এ সমগ্র বিষয়টি উম্মে মূসাকে সার্বক্ষণিকভাবে চিন্তাক্লিষ্ট ও তটস্থ করে রাখে। ভয় ও শঙ্কায় তার দিন অতীবাহিত হতে থাকে। কিভাবে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এই ভেবে তিনি দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়েন। যখন আর মূসার উপস্থিতি গোপন রাখা সম্ভব ছিল না, তখন তার মা তাঁকে আল্লাহ্র হুকুমে শিশু মূসাকে স্থাপনপূর্বক চাদরে আবৃত করে একটি ঝুড়িতে রেখে নীল নদে ভাসিয়ে দেন।[৩] আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল কাসাসের ৭ নম্বর আয়াতে বলেনঃ
“ | আমি মূসা-জননীকে আদেশ পাঠালাম যে, তাকে স্তন্য দান করতে থাক। অতঃপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশঙ্কা কর, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে পয়গম্বরগণের একজন করব। | ” |
ঝুড়িটি ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে থেমে থাকে। ফেরাউনের লোকজন এটিকে উঠিয়ে নেয় এবং পরবর্তীতে ফেরাউনের স্ত্রী ‘আসিয়া’ এর নিকট নিয়ে এল। মূসা দেখতে ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর। ফেরাউনের কোনও পুত্র সন্তান ছিলো না, শুধু একটি কন্যা সন্তান ছিলো পরবর্তীতে যে ফেরাউনের সিংহাসনে বসেন। শিশু দর্শনে সবার মন স্নেহসিক্ত হয়ে উঠে। বিশেষ করে, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার কোমল অন্তর মাতৃস্নেহে বিগলিত হয়। বিষয়টি ফেরাউনকে অবহিত করা হলে তিনি শিশুটিকে মেরে ফেরার নির্দেশ দেন, কিন্তু এতে স্ত্রী আসিয়া বাধা দেন। আল্লাহ্ তাআলা কোরআনের সূরা আল কাসাসের ৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেনঃ
“ | ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। | ” |
সন্তানের থেকে বিচ্ছেদের ফলে, মূসার (আঃ) মায়ের অন্তর দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তিনি মূসার (আঃ) ভগিনীকে "মরিয়ম" বললেন তাকে অনুসরণ করার জন্য এবং সে তার কথামত অজ্ঞাতসারে অপরিচিতা হয়ে তাকে অনুসরণ করলো। ফেরাউনের স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এবার শিশু মূসা প্রতিপালিত হতে থাকে। তবে সমস্যা দেখা দেয় স্তনপান নিয়ে। শিশু মূসা কোন ধাত্রীরই স্তন পান করছে না। বিষয়টি ফেরাউন স্ত্রী আসিয়াকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলে। অবশেষে মূসার ভগিনী যে গোপনে সমস্ত ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল সে এসে আবেদন জানায় যে আমি এমন একজন মহিলার কথা জানি যার স্তন এই শিশু পান করতে পারে। সেই মহিলাটিকে হাজির করতে তাকে আদেশ দেয়া হয়। অতঃপর সে নিজ মাতা অর্থাৎ মূসার জননীকে সবার সামনে উপস্থিত করে। স্তন দেয়া হলপর মূসা নির্বিঘ্নে দুগ্ধ পান করতে থাকেন। এ ঘটনায় সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়। উম্মে মূসাকে রাজপরিবারের অবস্থান করার অনুমতি প্রদান করা হল। কিন্তু তিনি সেখানে থাকতে অস্বীকার করেন এবং বলেন যে তার স্বীয় স্বামী-পুত্র-কন্যা-পরিবার রয়েছে। অবশেষে কিছু শর্তসাপেক্ষে তাকে শিশুসহ নিজ গৃহে অবস্থান করার অনুমোদন দেয়া হয়। উম্মে মূসা অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে স্বীয় পুত্র শিশু মূসাকে নিয়ে নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল কাসাসের ১৩ নম্বর আয়াতে বলেনঃ
“ | অতঃপর আমি তাকে জননীর কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চক্ষু জুড়ায় এবং তিনি দুঃখ না করেন এবং যাতে তিনি জানেন যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না। | ” |
মিশর ত্যাগ[সম্পাদনা]
একদিন মূসা(আঃ) যখন নগরীতে প্রবেশ করলো, সম্ভবতঃ তা ছিল মধ্যাহ্ন কাল, যখন মিশরের ব্যবসা বাণিজ্য কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। অথবা সময় কালটি ছিল রাত্রিকাল - যখন শহরের আধিবাসীরা সুপ্তির কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে। সূরা আল কাসাসের ১৮ নম্বর আয়াতের বর্ণনা অনুসারে শেষের বর্ণনাটিই অধিক প্রযোজ্য মনে হয়। নগরীতে প্রবেশ করে তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াই করতে দেখলেন। এদের একজন ছিল তাঁর নিজ (ইহুদি) দলের এবং অন্য জন তাঁর শত্রু (মিশরবাসী) দলের। মূসার (আঃ) উদ্দেশ্য ছিল মিশরবাসীকে আঘাত করে ইহুদীকে মুক্ত করার। কিন্তু ঘটনা চক্রে মিশরবাসীটি মূসার এক ঘুষিতেই মৃত্যুবরণ করে। তিনি এতে দুঃখিত ও অনুতপ্ত হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি ভবিষ্যতে কখনও অপরাধীদের সাহায্য করবেন না। পরের দিন মূসা (আঃ) যখন ভীত-শঙ্কিত অবস্থায় সে নগরীতে প্রবেশ করেন। সূরা আল কাসাসের ১৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেনঃ
“ | অতঃপর তিনি প্রভাতে উঠলেন সে শহরে ভীত-শঙ্কিত অবস্থায়। হঠাৎ তিনি দেখলেন, গতকল্য যে ব্যক্তি তাঁর সাহায্য চেয়েছিল, সে চিৎকার করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করছে। মূসা(আঃ) তাকে বললেন, তুমি তো একজন প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট ব্যক্তি। | ” |
তিনি দেখতে পারলেন যে, গতকাল যে ব্যক্তি তাঁর সাহায্য চেয়েছিল, সে চিৎকার করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করছে। কিন্তু মূসা(আঃ) তাকে সাহায্যের জন্য আগ্রহ বোধ করলেন না কারণ তিনি আল্লাহ্র নিকট প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি ভবিষ্যতে কখনও অপরাধীদের সাহায্য করবেন না। মূসা(আঃ) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ বোধ করেন। তিনি আবার ধারণা করলেন যে মিশরবাসীটিই অন্যায়ভাবে ইহুদিটিকে মারধর করছে, তিনি ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করতে পুণরায় মনস্ত করলেন। "উভয়ের শত্রু" অর্থাৎ মূসা(আঃ) এবং ইহুদিটির শত্রু মিশরবাসীটি। মিশরবাসীটি পূর্বের সম্পূর্ণ ঘটনাটি অবগত ছিল। তখন সে বলল, গতকাল তুমি যেভাবে এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, সে রকম আমাকেও কি হত্যা করতে চাও? তুমি তো একজন স্বেচ্ছাচারী ছাড়া আর কিছু নও। আর তুমি সর্বদা ন্যায়ের ও শান্তির কথা বল। যদি তুমি সত্যবাদী হও তবে পৃথিবীতে শান্তি পাওয়া স্থাপন করবে। মিশরবাসীকে হত্যার গুজব চর্তুদ্দিকে রটনা হয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত রাজপ্রাসাদেও পৌছে যায়। সেখানে ফেরাউনের সভাসদেশ্যবর্গের সভাতে মূসার জন্য মৃত্যুদন্ডের আদেশ ধার্য করা হয়। [৪] মূসা উপলব্ধি করতে পারলেন যে, রাজপ্রাসাদ বা নগরী এমনকি ফেরাউনের রাজত্বের সীমানার মধ্যে তাঁর জীবন নিরাপদ নয়। সুতরাং তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসনের মনস্ত করলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন জানেন না। প্রচন্ড মানসিক উদ্বেগ ও উত্তেজনা তাঁকে অস্থির করে তোলে। তিনি একান্তভাবে সেই পরম করুণাময়ের নিকট প্রার্থনা করেন, যার ফলে তিনি শান্তি লাভ করেন, এবং উদ্বেগ থেকে মুক্ত হন। অতঃপর তিনি মাদইয়ান দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং যাত্রার পূর্বে আল্লাহ্র নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। তফসীরকারগণ বর্ণনা করেন, এই সফরে মূসা -এর সাথে খাদ্য ছিল বৃক্ষপত্র। হযরত ইবনে-আব্বাস বলেন, এটা ছিল মূসা -এর সর্বপ্রথম পরীক্ষা। তাঁর পরীক্ষাসমহের বিবরণ কোরআনের ২০ নম্বর সূরা আত ত্বোয়া-হা -তে বর্ণিত হয়েছে।[২]
মাদইয়ান[সম্পাদনা]
প্রাচীন কালে, যারা মরুভূমি অতিক্রম করতো, তদের যাত্রাপথে একমাত্র উদ্দেশ্য থাকতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য পথের মরূদ্যান বা কূপের নিকট পৌছানো। কারণ তা হলে গাছের ছায়াতে সূর্যের প্রচন্ড তাপ থেকে শরীরকে সুশীতল করা কূপের পানি প্রচন্ড তৃষ্ণাকে নিবারণ করা যায়, সর্বোপারি মরুভূমির জনশূন্যতা থেকে রক্ষা পেয়ে মানুষের সঙ্গ লাভ করা যায়।
মূসা(আঃ) শেষ পর্যন্ত মাদইয়ানের একটি মরূদ্যানে পৌছাতে সক্ষম হলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন পথশ্রমে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্থ, সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তিনি পানি পান করার জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কুপে তখন একদল রাখাল তাদের জন্তুদের পানি পান করাচ্ছিল। এ সময়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে দুজন রমণীদ্বয় তাদের পশুপালকে আগলিয়ে রেখেছে, তাদের পশুদের পানি পান করানোর জন্য। তখন মূসা রমণীদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি ব্যাপার? তোমরা তোমাদের পশুপালকে আগলিয়ে দাড়িয়ে আছ কেন? অন্যদের ন্যায় কূপের কাছে এনে পানি পান করাও না কেন? তারা জওয়াব দিল, আমাদের অভ্যাস এই যে, আমরা পুরুষের সাথে মেলামেশা থেকে আত্মরক্ষার জন্য পশুপালগুলোকে পানি পান করাই না, যে পর্যন্ত তারা কূপের কাছে থাকে। তারা চলে গেলে আমরা পশুপালগুলোকে পানি পান করাই। রমণীদ্বয় এটাও বলল যে, আমাদের পিতা অতিশয় বৃদ্ধ। তিনি একাজ করতে পারেন না। তাই আমরা করতে বাধ্য হয়েছি। অতঃপর মূসা রমণীদ্বয়ের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কূপ থেকে পানি তুলে তাদের পশুপালগুলোকে পান করিয়েছিলেন। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে, রাখালদের অভ্যাস ছিল যে, তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর পরে একটি ভারী পাথর দ্বারা কূপের মুখ বন্ধ করে দিত। ফলে রমণীদ্বয় তাদের উচ্ছিত পানি পান করাত। এই ভারী পাথরটি দশ জনে মিলে স্থানান্তরিত করত। কিন্তু মূসা (আঃ) একাকী পাথরটি সরিয়ে দেন এবং কূপ থেকে পানি উত্তোলন করেন। সম্ভবতঃ এ কারণেই রমণীদ্বয়ের একজন মূসা সম্পর্কে পিতার কাছে বলেছিল, সে শক্তিশালী।[১] মূসা(আঃ) সাত দিন থেকে কোনকিছু আহার করেননি। তখন এক বৃক্ষের ছায়ায় এসে আল্লাহ্ তাআলার সামনে নিজের অবস্থা ও অভাব পেশ করলেন। এটা দোয়া করার একটা সূক্ষ পদ্ধতি। রমণীদ্বয় নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বাড়ি পৌছে গেলে বৃদ্ধ পিতা এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কন্যাদ্বয় ঘটনা খুলে বলল। পিতা দেখলেন, লোকটি অনুগ্রহ করেছেন; তাকে এর প্রতিদান দেয়া উচিত। তাই তিনি কন্যাদ্বয়ের একজনকে তাকে ডেকে আনার জন্যে প্রেয়ণ করলেন। মূসা(আঃ) যখন সবেমাত্র বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সে সময় বালিকাটি লজ্জাজড়িত পদক্ষেপে সেখানে পৌছল। এতেও ইঙ্গিত আছে যে, পর্দার নিয়মিত বিধানাবলী অবতীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও সর্তী রমণীগণ পুরুষের সাথে বিনাদ্বিধায় কথাবার্তা বলত না। প্রয়োজনবশতঃ সেখানে পৌছে বালিকাটি লজ্জা সহকারে কথা বলেছে। বালিকাটি বণীতভাবে বললেনঃ "আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমার পিতা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এবং পারিশ্রমিক দেবার জন্য ডেকেছেন।" তাফসীরে আরোও বলা হয়েছে যে, মূসা (আঃ) তার সাথে পথ চলার সময় বললেন, তুমি আমার পশ্চাতে চল এবং রাস্তা বলে দাও। বলাবাহুল্য, বালিকাটি প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকাই ছিল এর লক্ষ্য। সম্ভবতঃ এ কারণেই বালিকাটি তাঁর সম্পর্কে পিতার কাছে বিশ্বস্ততার সাক্ষ্য দিয়েছিল। এই বালিকাদ্বয়ের পিতা কে ছিলেন, এ সম্পর্কে তফসীরকারকগণ মতভেদ করেছেন। কিন্তু কোরআনের আয়াতসমূহ থেকে বাহ্যতঃ এ কথাই বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন হযরত শোয়ায়ব।
বৃদ্ধ পিতা ও মূসা(আঃ) দেখা মাত্র বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। মূসা(আঃ) তাঁকে তাঁর জীবন কাহিনী বিবৃত করেন - তিনি কে ছিলেন, কিভাবে তিনি এখানে এলেন, কি পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি মিশর ত্যাগে বাধ্য হন - তার সকল ঘটনা পূর্ণ বিবরণ তিনি রমণীদ্বয়ের বৃদ্ধ পিতা বর্ণনা করেন। সম্ভবতঃ তাদের সাথে রমণীদ্বয়রাও এই কাহিনী শ্রবণের অংশগ্রহণ করে। রমণীদ্বয়ের এক জন্য তার পিতার নিকট আরয় করল, গৃহের কাজের জন্য আপনার একজন চাকরের প্রয়োজন আছে। আপনি তাকে নিযুক্ত করুন। বালিকাদ্বয়ের পিতা হযরত শোয়ায়ব নিজেই নিজের পক্ষ থেকে কন্যাকে হযরত মূসার (আঃ) বিবাহে দান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। তার প্রস্তাব ছিল মূসা(আঃ) তার যে কোন একটি কন্যাকে বিবাহ করতে পারে, বিনিময়ে, তাঁকে কমপক্ষে আট বছর তাঁর পশুচারণের কাজ করতে হবে। অবশ্য তুমি ইচ্ছা করলে দশ বছরও থাকতে পার। সূরা আল কাসাসের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা উল্লেখ করেনঃ
“ | মূসা বললেন, আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যে কোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, তাতে আল্লাহর উপর ভরসা। | ” |
মাদইয়ান ত্যাগ[সম্পাদনা]
যখন হযরত মূসা(আঃ) দশ বছর পূর্ণ করলেন, তখন হযরত শোয়ায়ব -এর কাছে আরয় করলেনঃ এখন আমি জননী ও ভগ্নির সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে মিসর যেতে চাই। ফেরাউনের সিপাহীরা তাঁকে গ্রেফতার ও হত্যার জন্যে খোঁজ করছিল। এ আশঙ্কার কারণেই তিনি মিসর ত্যাগ করেছিলেন। দীর্ঘদিন অতীবাহিত হওয়ার ফলে এখন সে আশঙ্কা অবশিষ্ট নেই। শোয়ায়ব তাঁকে স্ত্রী অর্থাৎ, নিজের কন্যাসহ কিছু অর্থকড়ি ও আসবাবপত্র দিয়ে বিদায় দিলেন। পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে বিপদাশঙ্কা ছিল, তাই তিনি পরিচিত পথ ছেড়ে অখ্যাত পথ অবলম্বন করলেন। তখন ছিল শীতকাল। স্ত্রী ছিলেন অস্তঃসত্তা এবং তাঁর প্রসবকাল ছিল নিকটবর্তী। সকাল-বিকাল যে কোন সময় প্রসবের সম্ভাবনা ছিল। রাস্তা ছিল অপরিচিত। তাই তিনি মরু অঞ্চলে পথ হারিয়ে তূর পর্বতের পশ্চিমে ও ডান দিকে চলে গেলেন। গভীর অন্ধকার। কনকনে শীত। বরফসিক্ত মাটি। এ দুর্যোগ-মুহূর্তে স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেল। মূসা শীতের কবল থেকে আত্মরক্ষার্থে আগুন জ্বালাতে চাইলেন। কিন্তু তিনি আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, তূর পর্বতে আগুলে দেখতে পেলেন। সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে নূর। তিনি পরিবারবর্গকে বললেনঃ তোমরা এখানেই অবস্থান কর। আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আগুনের কাছে কোন পথপ্রদর্শক ব্যক্তিও পেতে পারি, যার কাছ থেকে পথের সন্ধান জানতে পারব। পরিবারবর্গের মধ্যে স্ত্রী যে ছিলেন, তা তো সুনিশ্চিত। কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, কোন খাদেমও সাথে ছিল। তাকে উদ্দেশ করেও সম্বোধন করা হয়েছে। আবার কোন কোন রেওয়ায়েত আছে যে, কিছুসংখ্যক লোক সফর সঙ্গীও ছিল, কিন্তু পথ ভুলে তিনি তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।[৫]
নবুওয়ত লাভ[সম্পাদনা]
মূসা পাহাড়ের পাদদেশে এই ঘটনার সম্মুখীন হন। পাহাড়টি ছিল তাঁর ডানদিকে। এই উপত্যকার নাম ছিল 'তুয়া'। যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছালেন; মুসনাদে-আহ্মদে ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ্ বর্ণনা করন যে, মূসা আগুনের কাছে পৌঁছে একটি বিস্ময়কর দৃশ্য দখতে পেলেন। তিনি দেখলেন যে, এটি একটি বিরাট আগুন, যা একটি সতেজ ও সবুজ বৃক্ষের উপর দাউ দাউ করে জ্বলছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এর কারণে বৃক্ষের কোন ডাল অথবা পাতা পুড়ছে না; বরং আগুনের কারণে বৃক্ষের সৌন্দর্য, সজীবতা ও উজ্জ্বল্য আরও বেড়ে গেছে। মূসা এই বিস্ময়কর দৃশ্য কিছুক্ষণ পর্যন্ত দেখতে থাকলেন এবং অপেক্ষা করলেন যে, আগুনের কোন স্ফুলিঙ্গ মাটিতে পড়লে তিনি তা তুলে নেবেন। অনেকক্ষণ অতীবাহিত হওয়ার পরও যখন এমন হল না, তখন তিনি কিছু ঘাস ও খড়কুটা একত্রিত করে আগুনের কাছে ধরলেন। বলাবাহুল্য, এতে আগুন লেগে গেলেও তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। কিন্তু এগুলো আগুনের কাছে নিতেই আগুন পেছনে সরে গেল। কোন কোন রেওয়ায়েত আছে, আগুন তাঁর দিকে অগ্রসর হল। তিনি অস্থির হয়ে পেছনে সরে গেলেন। মোটকথা, আগুন লাভ করার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। তিনি এই অত্যাশ্চর্য আগুনের প্রভাবে বিস্ময়াভিভূত ছিলেন, ইতিমধ্যে একটি গায়বী আওয়াজ হল।[৬]
বাহ্রে-মুহীত, রূহুল-মা'আনী ইত্যাদি গ্রন্থে আছে, হযরত মূসা এই গায়বী আওয়াজ চতুর্দিক থেকে সমভাবে শ্রবণ করেন। তার কোন দিক নির্দিষ্ট ছিল না। শুনেছেনও অপরূপ ভঙ্গিতে; শুধু কানে নয়, সমস্ত অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ দ্বারা শুনেছেন। এটা ছিল একটা মু'জেযার মতই। আওয়াজের সারমর্ম ছিল এই যে, যে বস্তুকে তুমি আগুন মনে করছ, তা আগুন নয়- আল্লাহ্ তাআলার জ্যোতি। এতে বলা হয়, আমিই তোমার পালনকর্তা। রূহুল-মা'আনী মুসনাদে বরাতে ওয়াহাবের রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে যে, মূসাকে যখন 'ইয়া মূসা' শব্দ প্রয়োগে আওয়াজ দেয়া হয়, তখন তিনি 'লাব্বায়েক' (হাজির আছি) বলে জওয়াব দেন এবং বলেন যে, আমি আওয়াজ শুনছি। কিন্তু কোথা থেকে আওয়াজ দিচ্ছেন, তা জানি না। আপনি কোথায় আছেন? উত্তরে বলা হলঃ আমি তোমার উপরে, সামনে, পশ্চাতে ও তোমার সাথে আছি। অতঃপর মূসা আরয করলেনঃ আমি স্বয়ং আপনার কালাম শুনেছি, না আপনার প্রেরিত কোন ফেরেশতার কথা শুনেছি? জওয়াব হলঃ আমি নিজেই তোমার সাথে কথা বলছি। সূরা আত ত্বোয়া-হা -এর ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা উল্লেখ করেনঃ
“ | আমিই তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপত্যকা তুয়ায় রয়েছ। | ” |
জুতা খোলার নির্দেশ দেয়ার এক কারণ এই যে, স্থানটি ছিল সম্ভ্রম প্রদর্শনের এবং জুতা খুলে ফেলা তার অন্যতম আদব। দ্বিতীয় কারণ এই যে, কোন কোন রেওয়ায়তে থেকে জানা যায়, মূসা -এর পাদুকাদ্বয় ছিল মৃত জন্তুর চর্মনির্মিত। হযরত আলি, হাসান বসরী ও ইবনে জুরায়জ থেকে প্রথমোক্ত কারণই বর্ণিত আছে। তাদের মতে মূসার পদদ্বয় এই পবিত্র উপত্যকার মাটি স্পর্শ করে বরকত হাসিল করুক এটাই ছিল জুতা খুলে রাখার উপকারিতা। হাদীসে রয়েছে, রসূলুল্লাহ্ বশীর ইবনে খাসাসিয়াকে কবরস্থানে জুতা পায়ে হাঁটতে দেখে বলেছিলেনঃ
“ | তুমি যখন এ জাতীয় সম্মানযোগ্য স্থানে অতিক্রম কর, তখন জুতা খুলে নাও। | ” |
সূরা আত ত্বোয়া-হা -এর ১৪ থেকে ১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা হযরত মূসাকে ধর্মের সমুদয় মূলনীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে; আর্থাৎ তাওহিদ, রেসালাত ও পরকাল; এবং তিনি বলেছেনঃ
“ | আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। কেয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকেই তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি কেয়ামতে বিশ্বাস রাখে না এবং নিজ খাহেশের অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে তা থেকে নিবৃত্ত না করে। নিবৃত্ত হলে তুমি ধবংস হয়ে যাবে। | ” |
এখানে নামাযের নির্দেশে করা হয়েছে। কিন্তু নামাযকে পৃথকভবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, নামায সমস্ত এবাদতের সেরা এবাদত। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী নামায ধর্মের স্তম্ভ, ঈমানের নূর এবং নাময বর্জন কাফেরদের আলামত। কেয়ামতের ব্যাপারটি আল্লাহ্ তাআলা সব সৃষ্টজীবের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন; এমনকি পয়গম্বর ও ফেরেশ্তাতাদের কাছ থেকেও। হযরত মূসাকে লক্ষ্য করে সতর্ক করা হয়েছে যে, তুমি কাফের ও বেঈমানদের কথায় কেয়ামত সম্পর্কে অসাবধানতার পথ বেছে নিয়ো না তাহলে তা তোমার ধ্বংসের কারণ হয়ে যাবে।
মু'জেযা[সম্পাদনা]
অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা বললেনঃ তোমার ডান হাতে ওটা কি? মূসা বললেনঃ এটা আমার লাঠি। আমি এর উপর ভর দেই। এর দ্বারা আঘাত করে আমার ছাগপালের জন্যে বৃক্ষপত্র ঝেড়ে ফেলি এবং এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও উদ্ধার হয়। আল্লাহ্ তাআলা বললেনঃ একে মাটিতে নিক্ষেপ কর। মূসা আল্লাহ্ তাআলা নির্দেশে তা মাটিতে নিক্ষেপ করার পর তা সাপে পরিনত হলো এবং নড়াচড়া করতে লাগলো। এই সাপ সম্পর্কে কোরআন পাকের এক জায়গায় ছোট ও সরু সাপ বলা হয়েছে। অন্য জায়গায় একে অজগর ও বৃহৎ মোটা সাপ বলা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটি যেখানে যে রূপ আকৃতি ধারণের প্রয়োজন হতো সে রূপ ধারণের আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম ছিল। ইমাম কুরতুবীর বর্ণনা অনুযায়ী এটি চিকন সাপের ন্যায় দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিল বলে 'জান্নুন' বলা হতো। লোকেরা দেখে ভীষণভাবে ভীত হতো বলে 'ছওবানুন' বলা হতো। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা বললেনঃ এখন তোমার লাঠিটি হতে নেয়, ভয় করনো না। আমি একে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেব। হযরত মূসা কে দেওয়া আল্লাহ্ তাআলার দ্বিতীয় মু'জেযা হল তার উজ্জ্বল হাত। ইবনে-আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে আল্লাহ্ তাআলা বললেনঃ তোমার হাত বগলের নীচ রেখে যখন বের করবে, তখন তা সূর্যের ন্যায় ঝলমল করতে থাকবে।[৭] স্বীয় রসূলকে দু'টি বিরাট মু'জেযার অস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত করার পর আদেশ করা হয়েছে যে, এখন উদ্ধত ফেরাউনকে ঈমানের দাওয়াত দেয়ার জন্যে চলে যাও।
পাঁচটি বিষয়ে দোয়া[সম্পাদনা]
হযরত মূসা যখন খোদায়ী কালামের গৌরব অর্জন করলেন এবং নবুওয়ত ও রেসালাতের দায়িত্ব লাভ করলেন, তখন নিজ সত্তা ও শক্তির উপর ভরসা ত্যাগ করে স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলারই দারস্থ হলেন। তাই তিনি আল্লাহ্ তাআলার দরবারে পাঁচটি বিষয়ে দোয়া করলেন।
প্রথম দোয়া[সম্পাদনা]
হে পরওয়ারদেগার, আমার বক্ষ উম্মোচন করে দিন এবং এতে এমন প্রশস্ততা দান করুন যেন নবুওয়তের জ্ঞান বহন করার উপযোগী হয়ে যায়। ঈমানের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌছানোর ক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে যে কটু কথা শুনতে হয়, তা সহ্য করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় দোয়া[সম্পাদনা]
"আমার কাজ সহজ করে দিন।" আল্লাহ্ তাআলা যদি ইচ্ছা করেন, তবে কারও জন্যে কঠিনতর ও গুরুতর কাজ সহজ করে দেন এবং তিনি ইচ্ছা করলে সহজতর কাজ কঠিন হয়ে যায়। একারণেই হাদীসে মুসলমানদেরকে এই দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তারা নিজেদের কাজের জন্য আল্লাহ্র কাছে এভাবে দোয়া করবেঃ "হে আমার আল্লাহ্, প্রত্যেক কঠিন কাজ সহজ করার ব্যাপারে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। কেননা, প্রত্যেক কঠিন কাজ সহজ করে দেয়া আপনার পক্ষে সহজ।"
তৃতীয় দোয়া[সম্পাদনা]
"আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন, যাতে লোকেরা আমার কথা বোঝতে পারে।" এ জড়তার কাহিনী এই যে, হযরত মূসা দুগ্ধ পান করার যমানায় তাঁর জননীর কাছেই ছিলেন এবং জননী ফেরাউনের দরবার থেকে দুধ পান করানোর ভাতা পেতে থাকেন। শিশু মুসা দুধ ছেড়ে দিলে ফেরাউন ও তার স্ত্রী আছিয়া তাঁকে পালক পুত্ররূপে নিজেদের কাছে নিয়ে যায়। এ সময়েই একদিন শিশু মূসা ফেরাউনের দাড়ি ধরে তার গালে একটি চপেটাঘাত করেন। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে, তিনি একটি ছড়ি হাতে নিয়ে খেলা করছিলেন। এক সময় ছড়ি দ্বারা তিনি ফেরাউনের মাথায় আঘাত করে বসেন। ফেরাউন রাগান্বিত হয়ে তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করে। স্ত্রী আছিয়া বললেনঃ রাজাধিরাজ ! আপনি অবুঝ শিশুর অপরাধ ধরবেন না। সে তো এখনও ভাল-মন্দের পার্থক্যও বোঝে না। আপনি ইচ্ছা করলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ফেরাউনকে পরীক্ষা করানোর জন্যে আছিয়া একটি পাত্রে জলন্ত অঙ্গার ও অপর পাত্রে মণিমুক্তা এনে মূসা -এর সামনে রেখে দিলেন। উদ্দেশ্য এই যে, সে অবুঝ শিশু। শিশুসুলভ অভ্যাস অনুযায়ী সে জলন্ত অঙ্গারটির উজ্জ্বল ও সুন্দর মনে করে তা ধারার জন্যে হাত বাড়াবে। মণিমুক্তার চাকচিক্য শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত হয় না। এতে ফেরাউন বোঝতে পারবে যে, সে যা করেছে, অজ্ঞতাবশতঃ করেছে। কিন্তু এখানে কোন সাধারণ শিশু ছিল না; ছিলেন আল্লাহ্র ভাবী রসূল যাঁর স্বভাব-প্রকৃতি জন্মলগ্ন থেকেই অনন্যসাধারণ হয়ে থাকে। মূসা আগুনের পরিবর্তে মণিমুক্তাকে ধরার জন্য হাত বাড়াতে চাইলেন, কিন্তু জিবরাঈল তাঁর হাত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের পাত্রে রেখে দিলেন এবং মূসা তথক্ষণাৎ আগুনের স্ফুলিঙ্গ তুলে মুখে দিলেন। ফলে তাঁর জিব্বা পুড়ে গেল। এতে ফেরাউন বিশ্বাস করল যে, মূসা এর এই কর্ম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়; এটা ছিল নিতান্তই বালকসুলভ অজ্ঞতাবশতঃ। এই ঘটনা থেকেই মূসা -এর জিহবায় এক প্রকার জড়তা সৃষ্টি হয়ে যায়। এটা দূর করার জন্যেই মূসা দোয়া করেন।[৮]
চতুর্থ দোয়া[সম্পাদনা]
"আমার পরিবারবর্গ থেকেই আমার জন্যে একজন উযীর করুন।" এই চতুর্থ দোয়া রেসালাতের করণীয় কাজ আনজম দোয়ার জন্যে উপায়াদি সংগ্রহ করার সাথে সম্পর্ক রাখে।
পঞ্চম দোয়া[সম্পাদনা]
হযরত মূসা তাঁর প্রথম দোয়ায় প্রথমে অনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, আমার পরিবারবর্গ থেকেই আমার জন্যে একজন উযীর করুন। অতঃপর নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে, আমি যাকে উযীর করতে চাই, তিনি আমার ভাই হারূন -যাতে রেসালাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে আমি তার কাছ থেকে শক্তি অর্জন করতে পারি। হযরত হারূন হযরত মূসা থেকে তিন অথবা চার বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। মূসা যখন এই দোয়া করেন, তখন মিসরে অবস্থান করছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা মূসা এর দোয়ার ফলে তাঁকেও পয়গম্বর করে দেন। ফেরেশতার মাধ্যমে তিনি মিসেরই এ সংবাদ প্রাপ্ত হন। মূসা -কে যখন মিসরে ফেরাউনকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে প্রেরণ করা হয়, তখন হারূন -কে মিসরের বাইরে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্যে আদেশ দেয়া হয়। তিনি তাই করেন।[১]