বিষয়বস্তুতে চলুন

শান্তিপুর

স্থানাঙ্ক: ২৩°১৫′ উত্তর ৮৮°২৬′ পূর্ব / ২৩.২৫° উত্তর ৮৮.৪৩° পূর্ব / 23.25; 88.43
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শান্তিপুর
নগর
শান্তিপুর পশ্চিমবঙ্গ-এ অবস্থিত
শান্তিপুর
শান্তিপুর
পশ্চিমবঙ্গে শান্তিপুরের অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩°১৫′ উত্তর ৮৮°২৬′ পূর্ব / ২৩.২৫° উত্তর ৮৮.৪৩° পূর্ব / 23.25; 88.43
দেশ ভারত
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
জেলানদিয়া
উচ্চতা১৫ মিটার (৪৯ ফুট)
জনসংখ্যা (২০১১)
 • মোট২,৮৮,৭১৮
ভাষা
 • দাপ্তরিকবাংলা, ইংরেজি
সময় অঞ্চলভাঃপ্রঃসঃ (ইউটিসি+5:30)
পিন৭৪১৪০৪
কলিং কোড০৩৪৭২
লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্ররানাঘাট
বিধানসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রশান্তিপুর
অদ্বৈত অঙ্গন, শান্তিপুর
পাঁচপোতা জামা মসজিদ, শান্তিপুর
সত্যচরণ স্মৃতি নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়, শান্তিপুর

শান্তিপুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। শান্তিপুর মূলত তাঁতশিল্প-তন্তুবায়, মেয়েদের রূপচর্চা-কেশবিন্যাস এবং বৈষ্ণবাচার্য অদ্বৈত মহাপ্রভু তথা সংস্কৃত বিদ্বদসমাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানেও শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান।[]

ইতিহাস ও সংস্কৃতি

[সম্পাদনা]

নদীয়ার শান্তিপুর একটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক গঙ্গা (সুরধনী) তীরবর্তী জনপদ। প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদ বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতির পীঠস্থান ও বিখ্যাত তাঁত শিল্পের সূতিকাগার। মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যর সাধনপীঠ শান্তিপুর স্টেশনের নিকটবর্তী বাবলা গ্রামে বলে কেউ কেউ মনে করেন ।যদিও অদ্বৈত মহাপ্রভুর আদি বাড়ি শান্তিপুর শহরের দক্ষিণে গঙ্গা গর্ভে বিলীন বলে গবেষকদের অভিমত।তার প্রকৃত পৈতৃক বাসভূমি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলা তে। চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ও অদ্বৈতাচার্যের মিলন ঘটেছিল এই শান্তিপুরে। সন্ন্যাস গ্রহণের পর এই শান্তিপুরেই চৈতন্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শচীমায়ের। অদ্বৈতাচার্যের বংশেই জন্ম আরেক বৈষ্ণবসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর। তাঁরও স্মৃতিমন্দির রয়েছে শান্তিপুরে। শান্তিপুরের কাছে হরিপুর গ্রামে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের পৈত্রিক বাসভূমি এবং শান্তিপুর মিউনিসিপাল স্কুলের পাশে কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ফুলিয়ায় আদি কবি রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার জন্মস্থান। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিগানের একজন বাধনদার সাতু রায় ও পণ্ডিত হরিমোহন প্রামাণিক এর বাড়িও শান্তিপুর। এছাড়া শান্তিপুরের রাসযাত্রা জগৎ বিখ্যাত এবং দোলযাত্রা, সূত্রাগড় জগদ্ধাত্রী পূজা, হরিপুরের রামনবমী ও অদ্বৈত প্রভুর জন্মতিথি মাঘি সপ্তমী বা মাকড়ি সপ্তমী, বৈশাখ মাসের শেষে রবিবার মুসলিম সম্প্রদায়ের গাজী মিয়ার বিয়ে এখানকার উল্লেখযোগ্য উৎসব ও পরব।[] বড়গোস্বামী বাড়ি সহ বিভিন্ন গোস্বামী বাড়ি ও গোকুলচাঁদের আটচালা মন্দির এবং অদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত বড় গোস্বামী বাড়িতে হাজার বছরের প্রাচীন কষ্টি পাথরের রাধারমণ বিগ্রহ (শান্তিপুরের বিখ্যাত রাস উৎসব এই রাধারমন বিগ্রহকে কেন্দ্র করেই সূচনা হয়) এবং অদ্বৈত মহাপ্রভু আনীত নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে প্রাপ্ত নারায়ণ শিলা এবং শান্তিপুরের একমাত্র চৈতন্যদেবের ষড়ভূজ মূর্তি বর্তমান।

তন্ত্রসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বংশধর শান্তিপুরে দক্ষিণাকালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন; যা একটি দালান-মন্দিরে দেবী আগমেশ্বরী নামে অধিষ্ঠিত। পটেশ্বরীতলায় আছেন দেবী পটেশ্বরী (চার-পাঁচশো বছর আগে তান্ত্রিক সাধকরা রাসপূর্ণিমাতে পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে তার উপর বৃহৎ বৃহৎ পটে আঁকা দক্ষিণাকালীমূর্তি 'পটেশ্বরী'র পূজা করতেন; পরে বারোয়ারি পূজা প্রবর্তিত হলে রাসোৎসবে পটেশ্বরী কালীমূর্তির শোভাযাত্রা শুরু হয়)। এছাড়া এখানে মহিষখাগী, শ্যামাচাঁদুনী, ঘাটচাঁদুনী, বিল্বেশ্বরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রভৃতি লোকায়ত কালীমূর্তি অধিষ্ঠিতা আছেন।

মতিগঞ্জ-বেজপাড়ায় অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত নিপুণ হাতের পোড়ামাটির কারুকাজযুক্ত জলেশ্বর শিবমন্দির বিদ্যমান। বউবাজার পাড়ায় আছে দক্ষিণাকালীর পঞ্চরত্ন মন্দির

শ্যামচাঁদ পাড়ায় ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের রামগোপাল খাঁ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত কোষ্ঠীপাথরের কৃষ্ণমূর্তি শ্যামচাঁদের আটচালা মন্দির আছে। মন্দিরটি তৈরী করতে সেসময় ২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল।

এছাড়া, শান্তিপুরে ১৭০৩-০৪ খ্রিষ্টাব্দে (১১১৫ হিজরী) তখনকার স্থানীয় ফৌজদার গাজী মহম্মদ ইয়ার খাঁ নির্মিত 'তোপখানা মসজিদ' বিখ্যাত। এর গম্বুজ ও মিনার এখনো অক্ষত আছে।

দানবীর বলে খ্যাত শরিয়ৎসাহেব নতুনহাট এলাকায় ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি মসজিদ ও একটি অতিথিশালা নির্মাণ করেন। ডাকঘর-পাড়ায় দুশো বছরেরও প্রাচীন একটি মসজিদ এবং তার পাশে ফকির তোপসেনিয়ার সমাধি আছে।[]

শান্তিপুরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু প্রাচীন দুর্গাপুজো।

শান্তিপুরের রাজবাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। দেবী দুর্গা এখানে ‘কুলোপতি’ নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, একদম শুরুর দিকে কুলোর মধ্যে অঙ্কিত দেবীর পুজো হতো। এখানে দেবী একা পুজো পান।[]

প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো শান্তিপুরের জজ পণ্ডিত বাড়ির দুর্গাপুজো। চৈতল মাহেশের বংশধর এই চট্টোপাধ্যায় পরিবার। গয়ার যদুয়া গ্রামে এক সময় এঁদের জমিদারি ছিল। এই পরিবারের ত্রয়োদশ পুরুষ পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ আমলে তর্কবাগীশ উপাধি পান। গয়ায় জমিদারির সময় প্রজাদের নানা সমস্যার বিচারের ভার ছিল এই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত পীতাম্বর তর্কবাগীশের ওপরে। সংস্কৃত সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের কারণে থেকে জজ পণ্ডিত উপাধি দেওয়া হয়। পরে পরিবার চলে আসে শান্তিপুরে। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে এখনও এই পুজোতে নবমীর পান্তা করে রাখা হয়। দশমীতে সেই পান্তা দেবীর ভোগে দেওয়া হয়। অষ্টমীর ভোগে থাকে ইলিশ মাছ।[] এই জজ পণ্ডিত পরিবারের দৌহিত্র বংশের পুত্রবধূ শিবানী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই পরিবারের কন্যা নির্মলা দেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু, শোক কাব্য 'অশ্রু'-র কবি ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রেই এই বাড়ির দুর্গাপুজোতে এসেছিলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময়ে দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা হয়। যার বয়স প্রায় সাড়ে তিনশো বছর। এই বড় গোস্বামী পরিবার অদ্বৈতাচার্যের বংশধর। তাঁদের কুলদেবতা রাধারমণ জিউ। এই কৃষ্ণমূর্তি এক সময়ে পূজিত হত পুরীতে ‘দোলগোবিন্দ’ নামে। সেই মূর্তিই পরে বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম বসন্ত রায় নিজের সঙ্গে নিয়ে যান যশোরে। মানসিংহের বাংলা আক্রমণের সময়ে বসন্ত রায় এই বিগ্রহ অর্পণ করেন অদ্বৈতাচার্যের প্রপৌত্র তথা বড় গোস্বামী বাড়ির পূর্বপুরুষ মথুরেশ গোস্বামীকে। তিনি সেটি আনেন শান্তিপুরের বাড়িতে। সেখানেই পূজিত হতে থাকেন বিগ্রহ। একদিন হঠাৎই দেখা যায় মন্দির থেকে উধাও বিগ্রহ। বিগ্রহ ফিরে পাওয়ার আশায় বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যেরা দেবী কাত্যায়নীর ব্রত উদযাপন শুরু করেন। পরে শান্তিপুরের অদূরে দিগনগরে একটি দিঘি থেকে বিগ্রহ উদ্ধার হয়। বিগ্রহ ফিরে পাওয়ার পরে কাত্যায়নীর পুজো শুরু করেন বড় গোস্বামী পরিবার। সেই থেকে কাত্যায়নীর পুজো হয়ে আসছে।[]

শান্তিপুরের বড় মৈত্র বাড়ির দুর্গা পুজোর বয়স ২৩০-২৩৫ বছর। অদ্বৈতাচার্যের বংশধর রাধামোহন গোস্বামী ভট্টাচার্য ছিলেন নাটোরের রাজগুরু। তাঁর কন্যা রামমণি বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন ফরিদপুরের রামরতন মৈত্রের সঙ্গে। এই রামমণি স্বপ্নে দেবী দশভুজার দর্শন পান। সেই থেকে শুরু এ পুজো। এই বাড়ির দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় দশ দিন ধরে। পুজোর সূচনা হয় মহালয়ার পরে প্রতিপদ থেকে।[]

নদীয়ার শান্তিপুরে কালীপুজো বয়ে এনেছিল শাক্ত - বৈষ্ণবের সম্প্রীতির বার্তা :

"শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী শাক্ত-বৈষ্ণব বিরোধ মেটাতে কৃষ্ণানন্দের প্রপৌত্র সর্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এতে নবদ্বীপের তৎকালীন শাক্ত সমাজ সর্বভৌমকে একঘরে করে সমাজচ্যূত করায় মথুরেশ তাঁর মেয়ে জামাইকে শান্তিপুরে নিয়ে আসেন। এর পর সর্বভৌম বড়গোস্বামীবাড়ির অদূরে মঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সেখানে কালীপুজোর প্রচলন করেন।"

[]

শান্তিপুরের প্রাচীন কালীপুজোরগুলোর মধ্যে অন্যতম চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজো। এই পুজোর সূচনা করেন গোপীনাথ সার্বভৌম।[] এই নিয়ে প্রচলিত রয়েছে ভক্তি ও বিশ্বাসের একটি মেলবন্ধনের কাহিনি :

"আজ থেকে প্রায় ২২ পুরুষ আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ গোপীনাথ সার্বভৌম এক দিন বাড়ির নারায়ণ শিলা পুজোয় আয়োজনে ব্যস্ত। এমন সময় একটি ছোট মেয়ে এসে তাঁর কাছে প্রসাদ চাইলো। গোপীনাথ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আগে পুজো হোক তার পরে সে প্রসাদ পাবে। কিন্তু মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। তখনই তার প্রসাদ চাই। এতে বিরক্ত হয়ে গোপীনাথ মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেন। পুজো শেষে গোপীনাথ প্রসাদ নিয়ে মেয়েটির অনেক খোঁজ করলেও তার আর সন্ধান পাননি। সেই রাতেই গোপীনাথ স্বপ্নে দেখা পান সেই মেয়েটির। তিনি আর কেউ নন দেবী কালী। গোপীনাথ তাঁর কাছেই আদেশ পান বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে ‘মা চাঁদুনী’ নামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে কার্তিকী অমাবস্যার রাতে পুজো করার।


পর দিন গোপীনাথ সেই স্বপ্নের কথা তাঁর মাকে জানিয়ে বায়না ধরেন স্বপ্নে দেখা সেই মূর্তি তৈরি করে দেওয়ার জন্য। তাঁর মা ধীরে ধীরে সেই মূর্তি নির্মাণ করে দেন। বাড়ির কাছেই বেল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তন্ত্রমতে পূজা করেন গোপীনাথ। পরবর্তীকালে এই গোপীনাথ হয়ে ওঠেন পণ্ডিত এবং তন্ত্রসাধক। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গোপীনাথের ভাই কাশীনাথ সার্বভৌম ছিলেন শ্রীচৈতন্যের গৃহশিক্ষক। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শান্তিপুরে আসেন কাশীনাথের সঙ্গে দেখা করতে।"

[]

শান্তিপুরের, চৈতল মাহেশের বংশধর[১০] জজ পণ্ডিত বাড়িতে আবার পূজো হয় সম্পূর্ণ তন্ত্র মতে।[১১] শান্তিপুরের এই প্রাচীন পুজো পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায় শুরু করেন। ইনি ইংরেজ সরকারের কাছে জজ-পণ্ডিত উপাধি পান। গয়ায় জমিদারির সময় প্রজাদের নানা সমস্যার বিচারের ভার ছিল এই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত পীতাম্বর তর্কবাগীশের ওপরে। সংস্কৃত সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের কারণে থেকে জজ পণ্ডিত উপাধি দেওয়া হয়।[১২]এই দেবীর নাম পক্কানেশ্বরী কালী।[১৩]এই জজ পণ্ডিত পরিবারের দৌহিত্র বংশের পুত্রবধূ শিবানী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই পরিবারের কন্যা নির্মলা দেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু, শোক কাব্য 'অশ্রু'-র কবি ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রেই এই বাড়ির পুজোতে এসেছিলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শান্তিপুরের অন্যান্য পুজোগুলির মধ্যে মহিষখাগী উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন এই পুজোতে আগে মহিষ বলি হত।[১৪]


শান্তিপুরের ভাঙা রাস বিখ্যাত। মনে করা হয় - এই ভাঙা রাস আসলে শান্তিপুরের বৈষ্ণব রাসকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টার ফসল।[১৫]

প্রচলিত বিশ্বাস - শান্তিপুর অদ্বৈতাচার্য তাঁর কৃষ্ণের রাসপূজা করতেন। প্রায় ৩৫০ বছর আগে বড় গোস্বামীবাড়ির গৃহদেবতা রাধারমণ জিউর বিগ্রহ এক বার চুরি হয়ে যায়। পরে সেই মূর্তি উদ্ধার হলে বাড়ির সকলে ঠিক করেন কৃষ্ণ বিগ্রহের পাশে রাধিকা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই অনুসারে এক রাস পূর্ণিমায় সাড়ম্বরে শ্রীমতী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বলা হয়, রাধারমণ ও রাধিকার বিগ্রহের মিলন উৎসবের মাধ্যমেই শান্তিপুরের রাস উৎসবের সূচনা হয়েছিল।[১৬]

শান্তিপুরের অন্যতম প্রাচীন শ্যামচাঁদ মন্দিরের রাস উৎসব। এখানে শ্যামচাঁদ ও রাধিকাকে ভাঙা রাসের শোভাযাত্রায় বের করা হয় না। মন্দিরের সামনে বিশেষ মঞ্চে তাঁরা অধিষ্ঠান করেন। দীনদয়াল বাড়ির রাস উৎসবের সূচনা করেছিলেন রামচন্দ্র প্রামাণিক। এ বাড়ির প্রতিমাও শোভাযাত্রায় বের হয় না।

এই রাস উৎসবের বিস্তার শান্তিপুর জুড়ে। আজও সেখানে কথা বলে পুরনো রীতি - রেওয়াজ, ঐতিহ্য :

"বর্তমানে একাধিক বিগ্রহ বাড়িতে রাস হয়। তার মধ্যে অদ্বৈতাচার্যের বংশের বিভিন্ন শাখার একাধিক বাড়ির রাস এখনও সমান জনপ্রিয়। বিশেষ করে বড় গোস্বামী বাড়ির রাস শান্তিপুরের রাসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই বাড়ির পাশাপাশি মধ্যম গোস্বামী বাড়ি, ছোট গোস্বামী বাড়ি-সহ মদনগোপাল গোস্বামী বাড়ি, পাগলা গোস্বামী বাড়ি, আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ি, বাঁশবুনিয়া গোস্বামী বাড়ি। গোস্বামী বাড়িগুলি ছাড়াও খাঁ চৌধুরী বাড়ি, সাহা বাড়ি, বংশীধারী ঠাকুর বাড়ি, মঠ বাড়ি, আশানন্দ বাড়ি, রায় বাড়ি, কালাচাঁদ বাড়ি, প্রামানিক বাড়ি, গোস্বামী-ভট্টাচার্য বাড়ি, গোপীনাথ জিউ ঠাকুর বাড়ি, মুখোপাধ্যায় বাড়ির রাস বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এর বাইরেও একাধিক বিগ্রহ বাড়িতে এখনও যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে রাস হয়।"

[১৭]

এর সঙ্গে সঙ্গেই আজ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে শান্তিপুরের বারোয়ারি রাসও :

"শান্তিপুরের বেশ কিছু বারোয়ারি রাসের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। বড় গোস্বামীপাড়া বারোয়ারি, লক্ষ্মীতলাপাড়া বারোয়ারি, তিলিপাড়া স্বেত সংঘ, বাইগাছিপাড়া নব মিলন সংঘ, শান্তিপুর রামকৃষ্ণ কলোনী, ভদ্রকালী, বাইগাছি পাড়া সত্যনারায়ন, ঘোষপাড়া, শ্যামচাঁদ মোড়, শান্তিপুর কামারপাড়া, তামাচিকে পড়া, শাম্তিপুর শ্যামবাজার, শান্তিপুর লিডার্স ক্লাব, শান্তিপুর বউবাজার পাড়া, ঠাকুর পাড়া লেন আ্যমোচার ক্লাব এবং প্যরাডাইস ক্লাব, শান্তিপুর গোডাউন মাঠের ত্রিপদ নারায়ণ।"

[১৮]

ভৌগোলিক অবস্থান

[সম্পাদনা]

শহরটির অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২৩°১৫′ উত্তর ৮৮°২৬′ পূর্ব / ২৩.২৫° উত্তর ৮৮.৪৩° পূর্ব / 23.25; 88.43[১৯] সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ১৫ মিটার (৪৯ ফুট)।

জনসংখ্যা

[সম্পাদনা]
শান্তিপুর রেল স্টেশন

ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে শান্তিপুর শহরের জনসংখ্যা হল ১৩৮,১৯৫ জন।[২০] এর মধ্যে পুরুষ ৫১% এবং নারী ৪৯%।

এখানে সাক্ষরতার হার ৬৪%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৬৯% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৫৮%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে শান্তিপুর এর সাক্ষরতার হার বেশি।

এই শহরের জনসংখ্যার ১২% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।

ধর্মবিশ্বাস

[সম্পাদনা]

শান্তিপুরের প্রায় ৭৯.১৫ % মানুষ হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী। এখানে ইসলামে ২০.২৫ %, খ্রিস্ট ধর্মে ০.০৪ %, শিখধর্মে ০.০২ %, বৌদ্ধ ধর্মে ০.০১ %, জৈন ধর্মে ০.০১ % মানুষ বিশ্বাসী। এছাড়া অন্যান্য ধর্মে ০.৪২ % মানুষ বিশ্বাসী ও বিবৃতি নেই এমন মানুষ ০.১১ %।

শান্তিপুরের ধর্মবিশ্বাস (২০১১)[২১]
  1. হিন্দুধর্ম 79.15 (৭৯.১%)
  2. ইসলাম 20.25 (২০.২%)
  3. খ্রিস্ট ধর্ম 0.04 (০.০৪%)
  4. শিখধর্ম 0.02 (০.০২%)
  5. বৌদ্ধ ধর্ম 0.01 (০.০১%)
  6. জৈন ধর্ম 0.01 (০.০১%)
  7. অন্যান্য 0.42 (০.৪২%)
  8. বিবৃতি নেই 0.11 (০.১১%)

যোগাযোগ

[সম্পাদনা]

শান্তিপুর শহর বাস ও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে রাজ্য রাজধানী কলকাতা ও জেলা সদর কৃষ্ণনগরের সাথে যুক্ত। কলকাতা হতে শান্তিপুরের ওপর দিয়ে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক অতিক্রম করেছে। রেলপথে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন হতে সরাসরি শান্তিপুর বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের মাধ্যমে সংযুক্ত। অতীতে শান্তিপুর - কৃষ্ণনগর - নবদ্বীপ ঘাট ন্যারো গেজ রেলপথ ছিল। অধুনা তা ব্রড গেজে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাগীরথী নদীর অপর পাড়ে বর্ধমান জেলাকালনাহুগলী জেলাস্থিত গুপ্তিপাড়ার সাথে শান্তিপুর নৌকা পথে যুক্ত।[২২]

বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ

[সম্পাদনা]

অদ্বৈত আচার্য, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, স্যার আজিজুল হক,কবি মোজাম্মেল হক, সুধাময় প্রামানিক,কৃত্তিবাস ওঝা, কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত,কবি করুণা নিধান বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুণ চন্দ্র গুহ,নির্মলেন্দু লাহিড়ি, পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র, কৌশিক চ্যাটার্জি, শ্রীঞ্জয় মুখার্জি, অজয় দে,, কবি দামোদর মুখার্জি,কবি ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি রায়

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ১০৬-১০৯
  2. "শান্তিনগর"ভিকাসপেডিয়া। ২০১৮-০৬-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৫ 
  3. "শান্তিপুরের ৫০০ বছরের পুরোনো পুজোতে মা পূজিত হন একাই, থাকে না তার পুত্র-কন্যারা" 
  4. "দশমীর ভোগে পান্তা জজ পণ্ডিত বাড়িতে" 
  5. "কাত্যায়নী রূপে পুজো হয় দুর্গার" 
  6. "বৈষ্ণব-শাক্তের মিলনক্ষেত্রে দুর্গাপুজো, শান্তিপুরের বড় মৈত্রবাড়ির পুজো যেন চলমান ইতিহাস" 
  7. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  8. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  9. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  10. "দশমীর ভোগে পান্তা জজ পণ্ডিত বাড়িতে" 
  11. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  12. "দশমীর ভোগে পান্তা জজ পণ্ডিত বাড়িতে" 
  13. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  14. "বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো" 
  15. "ভিড়ে ভাসল শান্তিপুর" 
  16. "ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মেলবন্ধনে স্বতন্ত্র শান্তিপুরের রাস উৎসব" 
  17. "রাস যেন মিলন মেলা" 
  18. "রাস যেন মিলন মেলা" 
  19. "Santipur"Falling Rain Genomics, Inc (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১৫, ২০০৬ 
  20. "ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি" (ইংরেজি ভাষায়)। Archived from the original on ১৬ জুন ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১৫, ২০০৬ 
  21. "Santipur Religion 2011" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১৭ 
  22. "ভুটভুটিতে ফেরি ,পুরসভার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন"EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৪