বিষয়বস্তুতে চলুন

নীলুফার ইয়াসমিন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(নীলুফার ইয়াসমীন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
নীলুফার ইয়াসমিন
জন্ম১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮
মৃত্যু১০ মার্চ ২০০৩ (৫৫ বছর)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পরিচিতির কারণকণ্ঠশিল্পী
দাম্পত্য সঙ্গীখান আতাউর রহমান
সন্তানখান আসিফুর রহমান আগুন
আত্মীয়ফরিদা ইয়াসমিন (বোন)
সাবিনা ইয়াসমিন (বোন)
ফওজিয়া ইয়াসমিন (বোন)
পুরস্কারএকুশে পদক (২০০৪)

নীলুফার ইয়াসমিন (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ - ১০ মার্চ, ২০০৩) বাংলাদেশের একজন বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী। তিনি ২০০৪ সালে সঙ্গীতে অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন।[]

জন্ম ও পরিবার

[সম্পাদনা]

নীলুফার ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৪৮ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পাঁচ বোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন ও মেজো বোন ফওজিয়া ইয়াসমিন (ফওজিয়া খান) প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী। সেজো বোন শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী নাজমা ইয়াসমীন হক। তিনি ধানমন্ডি রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ (ইংলিশ মিডিয়াম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমিন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী।

নীলুফার ইয়াসমিনের পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সঙ্গীতের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতেন। আর নীলুফার ইয়াসমিনের মা হারমোনিয়াম বাজাতেন। তার পিতার বাড়ি সাতক্ষীরার মুকুন্দপুর গ্রামে। মুকুন্দপুরের 'পণ্ডিত বাড়ি' বললে ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারটিকে সবাই চেনেন। বহু আগে থেকেই এবাড়ির লোকজন শিক্ষাদীক্ষায় ছিল অগ্রগামী। নীলুফার ইয়াসমিনের মা মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বখশের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ভালো গান গাওয়া ছাড়াও ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন।

শৈশবকাল

[সম্পাদনা]

নীলুফার ইয়াসমিনের শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী এবং ঢাকায়। মায়ের কাছে নীলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি। বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ডপ্লেয়ার ছিল। পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সেসব রেকর্ডের গান বারবার বাজিয়ে শুনে শিখে ফেলতেন। আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলাঝরিয়া, হরিমতী, কে. মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীন দেববর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরো বিখ্যাত সব শিল্পীদের গাওয়া রেকর্ড থেকে তার মা গান তুলে গাইতেন এবং তার গাওয়া থেকেই নীলুফার ইয়াসমিন গান শিখে ফেলতেন। তার মা-ই তাকে বলতেন যে এসব গানের রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। তখন থেকেই নজরুল সঙ্গীতের প্রতি তার আকর্ষণ জন্মে।

শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

সঙ্গীতশিক্ষার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তার ছিলো সমান মনোযোগ। তিনি আদমজী কটন মিল্‌স স্কুল, বাংলাবাজার গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ ও সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পাশ করেন।

বিয়ে ও সন্তান

[সম্পাদনা]

প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর তার একমাত্র পুত্র কণ্ঠশিল্পী খান আসিফুর রহমান আগুনের জন্ম হয়।

সঙ্গীতের তালিম

[সম্পাদনা]

নীলুফার ইয়াসমিনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা শুরু হয় ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে ১৯৬৪ সালে। একাধারে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন। তারপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন। এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ও মুরশিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন। তিনি নজরুল-সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্বরলিপিগ্রন্থ থেকে। স্বরলিপি অনুসরণ করেই প্রথম দিকে বেতার-টেলিভিশনে নজরুল-সঙ্গীত গেয়েছেন। তিনি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, নজরুল-সঙ্গীতস্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুতফর রহমানসুধীন দাশের কাছে নজরুল-সঙ্গীত শিখেছেন৷

কর্ম ও সঙ্গীতজীবন

[সম্পাদনা]

নীলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরের মাধ্যমে শিল্পী জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকে আমৃত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। নীলুফার ইয়াসমিন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গানসহ গানের ভুবনের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ করেছেন। রাগ প্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও তিনি নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত।

নীলুফার ইয়াসমিন বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে কন্ঠ দিয়েছেন। যেমন- শুভদা, অরুণ-বরুন-কিরণমালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী , যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা , জলছবি ইত্যাদি।

১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের নজরুল সঙ্গীত বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন।

সন্মাননা,স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা

[সম্পাদনা]

শিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমিনের জনপ্রিয়তা শুধু দেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিদেশেও ছিল ব্যাপক। ১৯৮৪ সালে কলকাতার 'অগ্নিবীণা'-র আমন্ত্রণে ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমীর সাংস্কৃতিক দলের সংগে কলকাতা গমন করেন। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লি ও কলকাতায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ-ছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন। সুজন চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, শুভদা চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, সঙ্গীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক এবং নজরুল সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে নজরুল পদক সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন নীলুফার ইয়াসমিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে নজরুল সঙ্গীতে তার অবদানের কথা চিরস্বরণীয় করে রাখতে তার নামে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।

প্রকাশনা

[সম্পাদনা]

নীলুফার ইয়াসমিন শ্রোতার আসর প্রযোজিত ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত 'বেলা শেষের রাগিনী'-তে 'আবার ভালবাসার সাধ জাগে' শিরোনামের নজরুল-সঙ্গীতটি রেকর্ড করেন। বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম থেকে 'এ কোন সোনার গাঁয়' রেকর্ডে একটি ও নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত 'পাষাণের ভাঙালে ঘুম' ও 'বাজলো কি রে ভোরের সানাই' রেকর্ড দুটিতে দু'টি নজরুল-সঙ্গীত গেয়েছেন। এছাড়াও তার কন্ঠে নজরুল-সঙ্গীত, কীর্তন ও পুরনো দিনের গানের বেশ কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বেরিয়েছে। পুরনো দিনের গানের গীতিকাররা হলেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কাজী নজরুল ইসলাম

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই গুণী শিল্পীর কন্ঠে ধারণকৃত ৫টি সিডি ও ক্যাসেট প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৩টি নজরুল সঙ্গীতের, ১টি পুরনো দিনের গানের এবং অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান নিয়ে ১টি সিডি। এছাড়া ইমপ্রেসের ব্যানারে তার একটি একক অডিও এ্যালবাম ‘পথের শেষে’ প্রকাশিত হয়েছে। এই এ্যালবামে তার একমাত্র পুত্র আগুন তার পুরো জীবনী নিজ কন্ঠে উপস্থাপন করেছেন।

নীলুফার ইয়াসমিনের জনপ্রিয় কিছু গান

[সম্পাদনা]
  • আগুন জ্বলেরে,
  • জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু,
  • তোমাকে পাবার আগে,
  • এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে,
  • এতো সুখ সইবো কেমন করে,
  • পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি,
  • যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী,
  • এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার,
  • যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না,
  • প্রতিদিন সন্ধ্যায়,
  • মাগো আমার যে ভাই,
  • নীল পাখিওরে,
  • এখনো কেন কাঁদিস ও পাখি,
  • ফুলে মধু থাকবেই,
  • দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নীলুফার ইয়াসমিনের টিউমার ধরা পড়ে। অপারেশনের পর তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন সঙ্গীতভুবনে। কিন্তু ২০০৩ সালের ১০ই মার্চ বারডেম হাসপাতালে তিনি সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. সাইম রানা (২০১২)। "ইয়াসমীন, নীলুফার"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. "বরেণ্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের প্রয়াণ"। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০১৭