বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি হলো বাংলাদেশ সরকারের আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক দর্শন, কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এর প্রধান বিষয়বস্তু হলো সরকারি আয় যার অন্য পিঠে রয়েছে সরকারি ব্যয়। দেশে উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃজনে রাজস্ব নীতির নিরন্তর সংস্কার কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। সরকারের সকল দায়িত্বের মধ্যে সুষ্ঠু রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একটি অন্যতম প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব। সরকার কর্তৃক রাজস্ব নীতি প্রণয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সরকারের আয় ও ব্যয় কার্যক্রমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। ভারসাম্যপূর্ণ রাজস্ব নীতি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবদ্ধি অর্জনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[১]

সরকার বিভিন্নভাবে যে রাজস্ব আদায় করে তাই সরকারের আয় হিসেবে পরিগণিত। সরকারি প্রশাসন পরিচালনা এবং জনকল্যাণমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য সরকারের অর্থ সংগৃহীত হয় করকর-বহির্ভূত খাতের রাজস্ব আদায় থেকে।[২]

রাজস্ব নীতির আওতায় (ক) রাজস্ব সংগ্রহের প্রাক্কলন তৈরি, (খ) ব্যয় কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং (গ) সম্ভাব্য বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের উৎসসমূহ চিহ্নিত করা হয়। রাজস্ব নীতিতে মূলত সংগৃহীত সম্পদের সাথে খরচের সামঞ্জস্য বিধানের দ্বারা অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বান্ধব এবং কর্মসংস্থানমুখী প্রণোদনা সৃষ্টি করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকসমূহে ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য তথা সুষ্ঠু রাজস্ব নীতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত অপরাপর প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নির্ভরতা ও ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা প্রদান করে বিধায় সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি আয়[সম্পাদনা]

সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হলো [কর রাজস্ব] বাবদ সংগৃহীত অর্থ। মূলত [প্রত্যক্ষ কর]ও [পরোক্ষ কর]এই দুই ধরনের করের সমন্বয়ে কর রাজস্ব গঠিত এবং এ খাত থেকে সরকারের মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি সংগৃহীত হয়। অবশিষ্ট রাজস্ব সংগৃহীত হয় কর-বহির্ভূত বিভিন্ন খাতের রাজস্ব আদায় (ফি, মাসুল ইত্যাদি) থেকে। রাজস্ব সংগ্রহের হার একটি দেশের উন্নয়নের স্তর বা অবস্থান নির্ধারণের অন্যতম স্বীকৃত নির্ণায়ক। যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সেখানকার রাজস্ব সংগ্রহের হারও তত বেশি। আমাদের দেশে মোট 'রাজস্ব-দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাত' ১৯৯ ৯-২০০০ অর্থবছরের ৮.৪৭ শতাংশ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১১.৩ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ হার সামান্য হ্রাস পেয়ে ১১.২৫ শতাংশ হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ হার বৃদ্ধি পেয়ে ১১.৫ শতাংশে দাঁড়াবে মর্মে প্রাক্কলন করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের এ ধারা থেকে দেখা যায় যে, রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে বৃদ্ধির হার স্বল্প এবং গতি ধীর।

কর ব্যবস্থাপনা[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বের প্রধান তিনটি উৎস হলো দুই প্রকার পরোক্ষ কর যথা আমদানী শুল্কমূল্য সংযোজন কর এবং দুই প্রকার প্রত্যক্ষ কর যথা আয় কর এবং সম্পদ কর। এছাড়া কতিপয় পণ্যের দেশজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবগারী শুল্ক আদায় করা হয়। উপরন্তু প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে আমদানী পর্যায়ে এবং স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়ে থাকে। সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশে কর নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে। সরকার ঘোষিত উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিবৃত ও সামাজিক লক্ষ্যসমূহ স্বল্পতম সময়ে অর্জনের উদ্দেশ্য হিসেবে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রসার ও রপ্তানি বৃদ্ধি, দেশজ শিল্পের বিকাশ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দ্ধারা দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রের দুষ্ট চক্র থেকে মুক্তি দেয়া এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন ইত্যাদি সামনে রেখে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করপরোক্ষ করের বিষয়ে প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

রাজস্ব আদায় কার্যক্রম[সম্পাদনা]

সরকারি ব্যয়ের ধারা/খাতসমূহ : ১.প্রতিরক্ষা ২.অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখা ৩.বিচার বিভাগ ৪.নগরায়ণ খাত ৫.প্রশাসন ৬.শিক্ষা ইত্যাদি

বাজেট ভারসাম্য ও অর্থায়ন[সম্পাদনা]

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র হ্রাস এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত সুনিদিষ্ট জাতীয় কৌশলের পটভূমিতে জাতীয় বাজেট প্রণীত হয়। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাজেটের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান হলে বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শাতাংশ যেখানে দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে সেখানে সরকারকে বর্ধিত হারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিকট সম্পদ ও আয় হস্তান্তরের অধিকতর ব্যবস্থা নিতে হয়। এতে করে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও তা অর্থনীতিতে একদিকে একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম জনগণের ক্রয় ক্ষমতা তৈরীর মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করে প্রবৃদ্ধির ধারা সচল রাখতে সক্ষম হচ্ছে। অপরদিকে এটি বিশাল অক্ষম জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম জীবন ধারণে সহায়তা করছে। তবে বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতির ধারা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাকৃতিক দূর্যোগময় কয়েকটি বছর ব্যতীত বাজেট ঘাটতি জিডিপি-এর ৫ শতাংশ বা তার নিচে রয়েছে। এটি দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ। নিম্নের সারণিতে গত দশকের বাজেট ভারসাম্য ও অর্থায়নের উপাত্ত উপস্থাপন করা হ’ল। এই ধারাবাহিক চিত্র ২০১১-‌১২ অর্থবছরে বদলে যায় কারণ এ সময়ে রাজস্ব আহরণের তুলনায় সরকারি ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ[সম্পাদনা]

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের অবদানের ধারা থেকে দেখা যায় যে, গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশের মত সম্পদ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৯-০০ অর্থবছর থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কেবল ২০০৭-০৮ অর্থ বছরের ৪০ শতাংশের চেয়েও কম সম্পদ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উপর্যুপরি বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ায় উক্ত বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক সাহায্যের অবদান বৃদ্ধি পাওয়ায় তুলনামূলকভাবে অভ্যন্তরীণ উৎসের অবদান হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রায় ৫৮ শতাংশ সম্পদের যোগান এসেছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বছরসমূহের তুলনায় উল্লেখযোগ্য আকারে বড় হওয়া সত্ত্বেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ যোগানের হার ও মোট বরাদ্দের পরিমাণ পূর্বের বছরসমূহের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি হওয়ায় এটিকে নিজস্ব উৎসের উপর অধিক নির্ভরতার ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নত করা হয়।ন নিম্নের সারণিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদের অবদানের একটি চিত্র পাওয়া যাবে।

সরকারের ঋণ[সম্পাদনা]

বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় দুই যুগ একটি বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত সম্পদের সাম্প্রতিক ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশকে প্রদত্ত অনুদানের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে বৈদেশিক উৎসের তুলনায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে প্রতি বছর বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের দায় বা ডেট সার্ভিসিং লায়াবিলিটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে করে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত নীট সম্পদের প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগময় বছরগুলোতে বর্ধিত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ায় ঐ সময়ে নীট সম্পদের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক উৎস থেকে বাড়তি সাহায্য পাওয়ায় নীট প্রবাহ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ কর্তৃক বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের বিবরণ নিচের সারণীতে দেখানো হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি ঋণ-দায় এখনও সহনীয় সীমার মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে বৈদেশিক উৎস হতে ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে; তাই বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহের জন্য নানামুখী সংস্কার ও প্রমোশনাল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সারণিঃ বৈদেশিক উৎস থেকে গৃহীত সরকারের ঋণ ও অনুদান গ্রহণ এবং আসল ও সুদ পরিশোধ পরিস্থিতি

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "fiscal policy | Definition, Examples, Importance, & Facts"Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-২৬ 
  2. "সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯ | ২।সংজ্ঞা"bdlaws.minlaw.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-২৬ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]