বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ "মৌলিক অধিকার" অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক।[১][২] তৃতীয় ভাগ "মৌলিক অধিকার"-এর শুরুতেই ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না।[১][২] আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ।[২] মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে।[২] স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ।[২] সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে।[২] বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার ১৮টি।[৩]
জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ
[সম্পাদনা]আইনের দৃষ্টিতে সমতা
[সম্পাদনা]সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য করা যাবে না
[সম্পাদনা]২৮(১)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।
নারী পুরুষের সমান অধিকার:
[সম্পাদনা]২৮(২)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।
সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা
[সম্পাদনা]২৯নং অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে
আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার
[সম্পাদনা]৩১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক যে কোন স্থানে অবস্থানরত অবস্থায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রাখে।
জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
[সম্পাদনা]৩২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।" এই অধিকার জাতিসংঘের মানবাধিকার-ঘোষণাপত্রে রয়েছে এবং এই অধিকারের ভিত্তিতে বিশ্বের বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ও আটকে রক্ষাকবচ
[সম্পাদনা]৩৩ নং অনুচ্ছেদে ঘোষিত হয়েছে যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব দ্রুত গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া তাকে এর চেয়ে বেশি সময় প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।
জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ
[সম্পাদনা]৩৪ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, "সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে তাহা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।"
বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ
[সম্পাদনা]সংবিধানের ৩৫ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে,
(১) অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করবার অপরাধ ছাড়া কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যেত, তাকে তার অধিক বা তা হতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাবে না।
(২) এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাবে না।
(৩) ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।
(৪) কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না।
(৫) কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।
(৬) প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোন দণ্ড বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোন বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোন কিছুই প্রভাবিত করবে না।
চলাফেরার স্বাধীনতা
[সম্পাদনা]৩৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন মোতাবেক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
সমাবেশের স্বাধীনতা
[সম্পাদনা]৩৭নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক, আইনসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
সংগঠনের স্বাধীনতা
[সম্পাদনা]৩৮নং অনুচ্ছেদ বলে যে আইন সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা
[সম্পাদনা]৩৯ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে।
পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা ধারা ৪০
[সম্পাদনা]আইন সাপেক্ষে "কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।"
ধর্মীয় স্বাধীনতা ধারা ৪১
[সম্পাদনা]"প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।"
সম্পত্তির অধিকার ধারা ৪২
[সম্পাদনা]"আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।"
গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার
[সম্পাদনা]৪৩ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকবে এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার থাকবে।
মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হলে উচ্চ আদালতে রিট করার অধিকার
[সম্পাদনা]যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করার অধিকার রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে যে, [৪]১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের কোনো ক্ষমতার খর্ব না করে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করার অধিকার রয়েছে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "যেগুলো আপনার মৌলিক অধিকার"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-২০।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ "মৌলিক অধিকার"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-২০।
- ↑ "মৌলিক অধিকার"। বিচার বিভাগীয় বাতায়ন। ২০১৮-০৭-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-২২।
- ↑ আখতার, মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (১৯৮৯-১০-০১)। "দুর্নীতি ও উন্নয়ন"। বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন পত্রিকা (2)। আইএসএসএন 1605-7023। ডিওআই:10.36609/blp.i2.487।