বিষয়বস্তুতে চলুন

মুজিববাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মুজিববাদ
প্রতিষ্ঠাতাশেখ মুজিবুর রহমান
ভাবাদর্শপ্রধান:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ
সমাজতন্ত্র
গণতন্ত্র
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
অন্যান্য:
গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র
বামপন্থী জাতীয়তাবাদ
রাজনৈতিক অবস্থানবামপন্থী

মুজিববাদ হল বাংলাদেশের ১ম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের সমষ্টি।[] শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের মূল চারনীতি হলো– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে মুজিববাদের চার মূলনীতি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।[]


১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন,

পটভূমি

[সম্পাদনা]

উপনিবেশী আমলে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতে,

শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

মুজিববাদ বলতে শুধু এই চারটি মূলনীতি/স্তম্ভ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো রাজনৈতিক জীবনের চিন্তাধারা, দর্শন ও মূল্যবোধ এখানে অন্তর্ভুক্ত। তাই মুজিববাদের আলোচনায় স্থান পাবে শেখ মুজিবের ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিভিন্ন উপনিবেশে অধিকৃত জাতির মুক্তি আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশে তার অবস্থান। মুজিব ছিলেন শান্তিবাদী এবং জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন জড়িত। তার মতাদর্শ বিশ্বশান্তি এবং যুদ্ধবিরোধী অবস্থান সমর্থন করে, যদি না কোনো জাতি আক্রমণের শিকার হয়। শেখ মুজিব ছিলেন চরমভাবে ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধ বিরোধী তার লেখা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এবং শেখ মুজিব সবসময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আন্দোলনে প্রগতিশীলের কাছেও উদাহরণ হিসেবে থাকবে।

মূলনীতিসমূহ

[সম্পাদনা]

মুজিববাদের মূলনীতি গুলো হলো:

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক (বামে) এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পতাকার (ডানে) চারটি তারকা মুজিববাদের চারটি মৌলিক নীতির প্রতিনিধিত্ব করে।

জাতীয়তাবাদ

[সম্পাদনা]
রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবীতে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মৃতিকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের সকল অধিবাসীর পরিচয় বাঙালি ও বাংলাদেশী। তিনি ভেদাভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ মনে করতেন।[] 'বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল' মুজিববাদের মূল লক্ষ্য।[১০] বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা তখনই শুরু করার পরামর্শ দেন।[১১] তিনি বলেন,

তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে।[১১] কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে।[১১] ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিককরণে ভূমিকা রাখেন।[১২] ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।[১২] রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়,

সমাজতন্ত্র

[সম্পাদনা]

মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ সমাজতন্ত্র। তার মতে, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র কে সংবিধানে "একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উপকরণ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি যে চীন বা রাশিয়ার মতো, লেলিন-মার্কস-অ্যাঙ্গেলস বা মাও সে তুংয়ের মতো সমাজতন্ত্র চান না, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। তিনি চেয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায় সমাজতন্ত্র, এটিকে তিনি 'শোষিতের গণতন্ত্র' বলে অভিহিত করতেন। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশেলে বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। []কুষ্টিয়ায় একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন,

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে তিনি বলেন,

তাঁর মতে,

তিনি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জন এর একটি ধারণা পোষণ করেন।[১৩]

গণতন্ত্র

[সম্পাদনা]

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি। জনগণকে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েই জনগণের মতামতের উপর আমরা বিশ্বাস করি। তিনি "শোষিতের গণতন্ত্র" কথাটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে।[] তিনি আরো বলেন,

সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের জনগণের সেবক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন,

গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেন,

সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

ধর্মনিরপেক্ষতা

[সম্পাদনা]

মুজিববাদের চতুর্থ আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র এবং ধর্মকে আলাদা রূপে প্রকাশ করাকে বুঝায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মে নির্ভরশীল থাকে না এটি এমন একটি অবস্থান যাতে ধর্মীয় বিশ্বাস সরকারকে প্রভাবিত করে না । রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই হস্তক্ষেপ কিংবা পক্ষপাত করে না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান সুযোগ ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। উগ্রতার মূল তুলে হাজার বছরের বাঙালির সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করা এটাই মুজিবের দর্শন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে এবং প্রতিটি জনসভায় ধর্ম-বর্ণ নির্বশেষে সম্প্রীতির রাষ্ট্র গড়ার কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হলে ধর্মনিরপেক্ষতা কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে বাকশাল ঘোষণার সময়েও তিনি একে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে রেখেছিলেন। তার মতে,

তিনি আরো বলেন,

প্রভাব

[সম্পাদনা]

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে শেখ মুজিবুর রহমানের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।

  1. একাধিক উৎস: [][][][][][]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Ilias, Khondakar Mohammad (১৯৭২)। Mujibbad। ঢাকা: সাম্য। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫ 
  2. "'Father' of Bangladesh"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯৭৫-০১-২৭। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫ 
  3. Khan, Zillur R. (১৯৭৪-০২-০১)। "Leadership and political opposition in Bangladesh"Asian Affairs5 (1): 41–50। আইএসএসএন 0306-8374ডিওআই:10.1080/03068377408729695 
  4. Lifschultz, Lawrence; Bird, Kai (১৯৭৯)। "Bangladesh: Anatomy of a Coup"Economic and Political Weekly14 (49): 1999–2014। আইএসএসএন 0012-9976 
  5. দস্তগীর, কে.এম গোলাম (২০১২)। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন। ঢাকা: আদর্শ। পৃষ্ঠা ১০। আইএসবিএন 978-984-8875-31-5 
  6. "আমি আশাবাদী—কথাটি বলতে পারছি না"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫ 
  7. হোসেন, আবু মোঃ দেলোয়ার; উল্লাহ, মোঃ রহমত, সম্পাদকগণ (২০১৩)। বঙ্গবন্ধুর মানবাধিকার-দর্শন। ঢাকা: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। পৃষ্ঠা ১–১৯। 
  8. "ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব ॥ দুই॥ || চতুরঙ্গ"জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০৫-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-০৪ 
  9. "মুজিববাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার | খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস | ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২"সংগ্রামের নোটবুক। ২০২০-০৫-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১০ 
  10. "বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা"সমকাল। ২০১৯-০৫-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৮ 
  11. "বঙ্গবন্ধু যেভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর পরিকল্পনা করেছিলেন"Jugantor। ২০১৯-০৩-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫ 
  12. "ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান"দৈনিক আমাদের সময়। ২০১৯-০৫-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৮ 
  13. "মুজিববাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার | খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস | ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২"সংগ্রামের নোটবুক (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৫-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১০