পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ পাকিস্তান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বে গঠিত একটি ঐতিহাসিক ছাত্র সংগঠন। ১৯৫৩ সালে এটির নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ রূপান্তর হয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রচারণা সমর্থন করার জন্য পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগে রূপান্তরিত হয়। সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্বে প্রতিষ্ঠালাভ করলে পরবর্তীতে এটি আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনে পরিণত হয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রতিষ্ঠা
[সম্পাদনা]ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে এক সাধারণ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার পক্ষে সবাই মত দেয়। ওই সভা থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়।[১] কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তারা শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বের ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, আজিজ মোহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আব্দুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ কলকাতা ও ঢাকার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্ররা। সব ছাত্র নেতা তখন একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হন। [২]
প্রতিষ্ঠার পরে এই সংগঠনটির অফিস করা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। ‘মুসলিম লীগ নেতারা চেষ্টা করেছিলেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেননি।’ ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার পর ছাত্রদের মধ্যে সাড়া পড়ে। এক মাসের ভিতর প্রায় সব জেলায় কমিটি করতে সক্ষম হন। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দলের ভাঙন শুরু হয় , শাহ আজিজুর রহমান নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে আরেকটি দল গঠন করে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে শাহ আজিজুর রহমানের ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’কে সাহায্য করত। আর ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’র বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতো।[৩]
নামকরণ
[সম্পাদনা]১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছিল। শাহ আজিজুর রহমান এই সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে বহাল ছিলেন।
কমিটি
[সম্পাদনা]শুরুর দিকে আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনিত হন দবিরুল ইসলাম। অলি আহাদ এর সদস্য হতে আপত্তি করেছিলেন। কারণ হিসেবে আহাদ বলেছিলেন ‘তিনি আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবেন না।’ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে তিনি থাকতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন অলি আহাদকে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন অলি আহাদকে। তিনি বলতে চেয়েছেন নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। যদিও নইমউদ্দিন ছিল কনভেনর, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেই সবকিছু তখন করতে হতো। [৪]
আন্দোলন-সংগ্রাম
[সম্পাদনা]প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যের ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অবস্থায় কিছুটা সরগরম ছিলো। কিন্তু তখন ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় ৷ ভাষা আন্দোনের মাধ্যমে সংগঠনটি তার প্রাণ ফিরে পায় এবং সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়।[৫]
অসম্প্রদায়িক চেতনা
[সম্পাদনা]তৎকালিন 'মুসলিম ছাত্রলীগের' অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে সংগঠনের নামে 'মুসলিম' শব্দটি ছিল একমাত্র বাধা ৷ ১৯৪৯ সালে সংগঠনের নাম হতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও ভাষা আন্দোলনের চরম তৎপরতায় সম্ভব হয়নি ৷ ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল সভায় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার প্রস্তাব এবং কার্যকর করা হয় ৷ [৬]
দলীয় বিভাজন
[সম্পাদনা]বলা হয়ে থাকে যে এখানে দুটি প্রধান সম্ভাব্য দলীয় বিভাজন ছিল:
- বাংলা জাতীয়তাবাদী ধারা, যারা সংযুক্ত স্বায়ত্তশাসনের মতো পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তৃত স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক ছিলেন।
- সমাজতান্ত্রিক ধারা, যারা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ও একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলা রাষ্ট্র গঠনের সমর্থক ছিলেন।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক
[সম্পাদনা]বছর | প্রেসিডেন্ট | পরবর্তী ভূমিকা/সংযুক্তি | সাধারণ সম্পাদক | পরবর্তী ভূমিকা/সংযুক্তি | |
---|---|---|---|---|---|
১ | ১৯৪৭-১৯৪৭ | নাইমুদ্দিন আহমেদ | অজানা | আদনান আলী খাদেম | অজানা |
২ | ১৯৪৭-১৯৫০ | দবিরুল ইসলাম | এমএলএ, কেএসপি | খালেক নেওয়াজ খান | এমএলএ, কেএসপি |
৩ | ১৯৫০-১৯৫২ | খালেক নেওয়াজ খান | এমএলএ, কেএসপি | কামরুজ্জামান | সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ |
৪ | ১৯৫২-১৯৫৩ | কামরুজ্জামান | সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ | এম এ ওয়াদুদ | সাংবাদিক, দৈনিক ইত্তেফাক |
৫ | ১৯৫৩-১৯৫৭ | আবদুল মমিন তালুকদার | উপমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় | এম এ আওয়াল | আহ্বায়ক, আওয়ামী লীগ |
৬ | ১৯৫৭-১৯৬০ | রফিক উল্লাহ চৌধুরী | প্রধানমন্ত্রীর সচিব | শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (আজহার আলীর পদত্যাগের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত) | সহ-সভাপতি, বিএনপি |
৭ | ১৯৬০-১৯৬৩ | শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন | সহ-সভাপতি, বিএনপি | শেখ ফজলুল হক মনি | নির্বাহী কমিটির সদস্য, বাকশাল |
৮ | ১৯৬৩-১৯৬৫ | কে এম ওবায়দুর রহমান | সাধারণ সম্পাদক, বিএনপি | সিরাজুল আলম খান | প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল |
৯ | ১৯৬৫-১৯৬৭ | সৈয়দ মজহারুল হক বাকী | অজানা | আবদুর রাজ্জাক | সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ |
১০ | ১৯৬৭-১৯৬৮ | ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী | যুগ্ম সম্পাদক, বিএনপি ও প্রতিষ্ঠাতা, পিডিপি | আবদুর রাজ্জাক | সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ |
১১ | ১৯৬৮-১৯৬৯ | আবদুর রউফ | বহিষ্কৃত, আওয়ামী লীগ থেকে এমপি | খালেদ মোহাম্মদ আলী | অজানা |
১২ | ১৯৬৯-১৯৭০ | তোফায়েল আহমেদ | মন্ত্রী, এমপি ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ | আ. স. ম. আবদুর রব | সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি |
১৩ | ১৯৭০-১৯৭২ | নূরে আলম সিদ্দিকী | ব্যবসায়ী | শাজাহান সিরাজ (১৯৭২ সালে বহিষ্কৃত) | মন্ত্রী ও এমপি, বিএনপি |
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা। পৃষ্ঠা ৮৮–৮৯।
- ↑ "ছাত্র রাজনীতি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ"। দৈনিক ভোরের কাগজ। ২০১৯-১২-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-১৫।
- ↑ "'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ - রাজনীতি"। Premier News Syndicate Limited (PNS)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-১৫।
- ↑ লেখক- শেখ, মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা। পৃষ্ঠা ৮৯।
- ↑ "২ জানুয়ারি ১৯৭২ | সংগ্রামের নোটবুক" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-১৫।
- ↑ লেখক- ড. মোহাম্মদ, হাননান। বই : বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০-১৯৭১।