বিনোদিনী দাসী
বিনোদিনী দাসী Binodini Dasi | |
---|---|
জন্ম | ১৮৬২ |
মৃত্যু | ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) |
পেশা | লেখিকা, কবি, অভিনেত্রী |
নিয়োগকারী | গ্রেট ন্যাশন্যাল থিয়েটার, বেঙ্গল থিয়েটার |
পরিচিতির কারণ | থিয়েটার কর্মী |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | দুর্গেশনন্দিনী, মেঘনাদবধ, বিষবৃক্ষ নাটকে অভিনয়। |
বিনোদিনী (১৮৬৩ - ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১) ঊনবিংশ শতকের বাংলা মঞ্চের একজন অভিনেত্রী। তার ১২ বছরের স্বল্প অভিনয় জীবনের মধ্যেই তিনি মঞ্চাভিনয়ে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন।
অভিনয় জীবন
[সম্পাদনা]তিনি বারবণিতার পরিবেশ থেকে একেবারে ছোট বয়েসে বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম অভিনয় ছিল ১২ বছর বয়সে মাত্র মাসিক দশ টাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশন্যাল থিয়েটারে শত্রুসংহার নাটকে দ্রৌপদীর সখীর ছোট্ট ভূমিকায়।[১] বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ করা হয় ১৮৭৩ সালে। এর একবছরের মধ্যেই বিনোদিনী সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগ দেন। নাচ গানে পারদর্শী বিনোদিনী খুব তাড়াতাড়ি অভিনয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৭৪ থেকে একটানা ১২ বছর তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর তিনি শেষবার অভিনয় করেন । এর আগে পর্যন্ত ৫০টি নাটকে তিনি ৬০টিরও বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।[২]
অভিনয় প্রতিভা
[সম্পাদনা]পৌরানিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক যেকোন রকমের চরিত্র রূপায়নেই তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । একই নাটকে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে সফলতার সাথে অভিনয় করেন। যেমন মেঘনাদবধের সাতটি চরিত্রে বা দুর্গেশনন্দিনীর দুটি ভিন্নমুখী চরিত্রে (আয়েষা ও তিলোত্তমা)। একই অভিনয় রজনীতে তিনি একাধিক নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন। যেমন বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী এবং সধবার একাদশীর কাঞ্চন, চৈতন্যলীলার চৈতন্য এবং বিবাহ বিভ্রাটে বিলাসিনী কারফরমা, বিল্বমঙ্গলে চিন্তামনি এবং বেল্লিক বাজার এ রঙ্গিনী।[১] পুরুষ চরিত্রের অভিনয়েও তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। তার অভিনীত পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে চৈতন্য প্রহ্লাদ প্রভৃতি। বিনোদিনী করুণরসাত্মক, ভক্তিরসাত্মক, গুরুভাবাপন্ন বা গভীর চরিত্রের রূপায়নে অনায়াস দক্ষ ছিলেন। তিনি হালকা এবং হাস্যরসাত্মক চরিত্রায়নেও নিপুন ছিলেন। [২]
স্টার থিয়েটার
[সম্পাদনা]১৮৮৩ সালের দিকে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। কারণ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক ছিলেন একজন অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ জহুরী, যিনি থিয়েটারকে ব্যবসা হিসেবেই দেখতেন। তাই তার অধীনে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী কারও পক্ষেই সহজ ছিল না। থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য যে রকম টাকা পয়সা দরকার ছিলো, তা গিরিশ ঘোষের ছিল না। একজন ২০-২১ বছরের ব্যবসায়ী গুরমুখ রায় অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। থিয়েটারের চেয়ে তার বিনোদিনীর প্রতিই বেশি আকর্ষণ ছিল। গুরমুখ রায় বিনোদিনীকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে নিতে চেয়েছিল যাতে সে অভিনয় ছেড়ে দেয়। বিনোদিনী আংশিক রাজী হন সে প্রস্তাবে কারণ তিনি অভিনয় ছাড়তে রাজী ছিলেন না। গুরমুখ রায়ের রক্ষিতা হন বিনোদিনী। এই ঘটনায় তার পূর্ববর্তী মালিক ধনী জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তিনি লাঠিয়াল দিয়ে নতুন থিয়েটার ভেঙ্গে দিতে চেষ্টা করেন। সেই ধনী জমিদার তলোয়ার হাতে বিনোদিনীর শোবার ঘরে প্রবেশ করে তাকে খুন করতে উদ্যত হন। কিন্তু বিনোদিনী উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে যাত্রা বেঁচে যান।[৩]
খ্যাতি
[সম্পাদনা]সমাজের সকল স্তরের মানুষই তার অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার প্রশংসক দের তালিকায় ছিলেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, ফাদার লাঁফো, এডুইন আরনল্ড, কর্ণেল অলকট প্রমুখ। রামকৃষ্ণদেব তার চৈতন্যলীলার অভিনয় দেখে তাকে গ্রীনরুমে গিয়ে চৈতন্য হোক বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে বিনোদিনীর মধ্যে দিয়ে সফলভাবে গড়ে উঠতে দেখেছিলেন। তার অভিনয়ের গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ তার বহু প্রশংসা করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের 'কি করিয়া বড় অভিনেত্রী হইতে হয়' শীর্ষক প্রবন্ধের আলোচনায় বিনোদিনীর জীবনচর্চাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন সংবাদপত্রগুলি বিনোদিনীকে ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ, মুন অফ স্টার কোম্পানী, প্রাইমাডোনা অফ দি বেঙ্গলী স্টেজ আখ্যা দিয়েছিল। [২]
বঞ্চনা এবং অভিনয় জীবনের সমাপ্তি
[সম্পাদনা]বিনোদিনী ধনী যুবক গুর্মুখ রায়ের ৫০০০০ টাকার প্রলোভন ত্যাগ করেন। বরং বাংলা থিয়েটারের উন্নতির জন্য তিনি নতুন থিয়েটার খুলতে রাজি হন এবং গুর্মুখ রায়ের রক্ষিতা হতেও রাজি হন। বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে। কিন্তু কিছু মানুষের প্রতারনার শিকার তিনি হন। যাঁদের মধ্যে তার নিজের অভিনয় গুরু গিরিশচন্দ্রও ছিলেন। বিনোদিনীর ত্যাগ স্বীকারে যে নতুন থিয়েটার তৈরি হয় বিনোদিনীর নাম তাতে থাকেনি। এই নতুন থিয়েটারের নাম হয় স্টার থিয়েটার। এই বিশ্বাসঘাতকতায় যখন বিনোদিনী দুঃখে বেদনায় কাতর তখনই রামকৃষ্ণদেব তার চৈতন্যলীলা নাটক দেখতে এসে তাকে আশীর্বাদ করেন। এর দুবছর পরেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ২২-২৩ বছর বয়েসে তিনি রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে যান। তারপর দীর্ঘদিন জীবিত থাকলেও কখনও অভিনয়ে ফিরে আসেননি। ফলে বাংলা থিয়েটার বঞ্চিত হয় এক অসামান্য অভিনেত্রীর প্রতিভা এবং অভিনয় থেকে। [২]
বর্তমান সময়ে বিনোদিনীর জনপ্রিয়তা
[সম্পাদনা]- দীনেন গুপ্তের বাংলা চলচ্চিত্রে নটি বিনোদিনী (১৯৯৪)তে দেবশ্রী রায় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।[৪][৫]
- নটী বিনোদিনী তার আত্মজীবনীর উপর ভিত্তি করে একটি নাটক আমার কথা প্রথম ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয়য়ে রেপার্টরি কোম্পানি দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছিল। যার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী সীমা বিশ্বাস, তারপর ২০০৬ সালে, প্রখ্যাত নাট্য পরিচালক অমল আল্লানা এই নাটক পরিচালনা করেছিলেন। যার নাম দিল্লিতে প্রিমিয়ার হয়েছিল।[৬][৭][৮]
- প্রথম কাদম্বিনী, দিয়া মুখার্জি বর্তমানে নটী বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন।[৯]
- তুহিনাভা মজুমদার পরিচালিত "আমার কথা: বিনোদিনীর গল্প", তার আত্মজীবনীর উপর ভিত্তি করে একটি তথ্যচিত্র।[১০]
শেষ জীবন
[সম্পাদনা]বিনোদিনী মহিলাদের অভিনয়কে বাঙ্গালী দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। বিশ শতকের গোড়ায় যখন গ্রামোফোন চালু হয়, তখন বিনোদিনী গান শুরু করেন।তার গানের গলা ছিল উঁচুমানের। জীবনে তিনি মোট তিনজন ধনীর রক্ষিতা ছিলেন। এর মধ্যে শেষ ব্যক্তির সাথে তিনি ছিলেন ৩১ বছর। তিনি বিনোদিনীর জন্য বাড়িসহ কিছু সম্পত্তি রেখে যান।তাই স্বচ্ছলতা মধ্য দিয়েই তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যু বরণ করেন।[৩] বিনোদিনী লিখেছেন তার আত্মজীবনী আমার কথা, কবিতা গ্রন্থ বাসনা এবং কনক ।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "বিনোদিনী দাসী"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২৩শে সেপ্টেম্বর,২০০৯। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি,২০১১। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ ক খ গ ঘ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস -- দর্শন চৌধুরী -- পুস্তক বিপণী কলকাতা
- ↑ ক খ মুরশিদ, গোলাম (২০০৫)। "সুকুমারী থেকে সুচিত্রা"। অন্যদিন ঈদ সংখ্যা ২০০৫। মাজহারুল ইসলাম: ১০৪। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য); - ↑ "Nati Binodini (1994)"। youtube.com। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০২০।টেমপ্লেট:Dead Youtube links
- ↑ "Pradeep Sarkar to helm a biopic on Bengali theatre doyen Notee Binodini"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০২০।
- ↑ Romesh Chander (৮ ডিসেম্বর ২০০৬)। "Autobiography comes alive : "Nati Binodini", based on Binodini's autobiography "Aamar Kathaa""। The Hindu। Archived from the original on ৬ জুন ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০।
- ↑ "STAGE CRAFT"। India Today। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০।
- ↑ "Lights, sets, action..: Nissar and Amal Allana's "Nati Binodini" premieres this weekend in Delhi."। The Hindu। ২৪ নভেম্বর ২০০৬। ১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০।
- ↑ "Diya Mukherjee joins the cast of 'Prothoma Kadambini'"। The Times of India। ২৫ নভেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২০।
- ↑ "Aamaar Katha: Story of Binodini | Films Division"। ১৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০২২।
- বাঙালি নাট্যব্যক্তিত্ব
- বাংলার নবজাগরণ
- ১৮৬২-এ জন্ম
- ১৯৪১-এ মৃত্যু
- ভারতীয় মঞ্চ অভিনেত্রী
- কলকাতার অভিনেত্রী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় লেখিকা
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় অভিনেত্রী
- বাঙালি ব্যক্তি
- নারীবাদী শিল্পী
- কলকাতার লেখক
- ব্রিটিশ ভারতীয় ব্যক্তি
- ভারতীয় গণিকা
- ১৮৬৩-এ জন্ম
- ভারতীয় আত্মজীবনীকার
- ভারতীয় নারী পতিতা
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় লেখিকা
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় লেখক
- ভারতীয় অ-কল্পকাহিনী লেখিকা
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় জীবনীকার
- ব্রিটিশ ভারতের অভিনেত্রী