বিষয়বস্তুতে চলুন

চীন–বাংলাদেশ সম্পর্ক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
মানচিত্র China এবং Bangladesh অবস্থান নির্দেশ করছে

চীন

বাংলাদেশ

চীন—বাংলাদেশ সম্পর্ক হল চীনবাংলাদেশ রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। বাংলাদেশ—চীন সম্পর্ক প্রাচীন ও প্রায় তিন হাজার বৎসরের পুরোনো। বাঙালি সভ্যতা ও চীনা সভ্যতার মাঝে খ্রিষ্টের জন্মেরও হাজার বৎসর আগে থেকে যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর মাধ্যমে চীন এবং বাংলায় মানুষের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে চীন বাংলাদেশর আধুনিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অন্যতম অংশীদার চীন এবং বাংলাদেশ চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক পক্ষ। সম্প্রতি ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী চীন থেকে দুইটি সাবমেরিন তার অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত করে। চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক এখন ভারতসহ প্রতিবেশী অনেক দেশের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার সংসদ ভবন এলাকায় চীনা দূতাবাসের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের আয়োজিত ড্রোন প্রদর্শনী।

বাংলাদেশ চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে বাংলাদেশের চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে একটি দূতাবাস, হং কং ও কুনমিংয়ে কনস্যুলেট রয়েছে। ঢাকায় রয়েছে চীনের এমব্যাসি। চীন ও বাংলাদেশ বাংলাদেশ চীনা মায়ানমার ও ভারত ফোরাম ফর রিজিওনাল কোঅপারেশনের সদস্য। চীন—বাংলাদেশ এখন কৌশলগত অংশীদারি চুক্তির মাধ্যমে সামরিক ও বেসামরিক ভাবে মৈত্রী চুক্তিবদ্ধ। আগামী বৎসরগুলোর মধ্যে চীনের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থপিত হবে।

ঐতিহাসিক পটভূমি

[সম্পাদনা]
চীনা ম্যাপে যোং হে তার নৌবহর নিয়ে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয় এসেছিলেন

বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল যে পথ, তার নাম সিল্ক রোড নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ছিল পশ্চিমা সিল্ক রোড, যার সূচনা হয়েছিল রাজধানী সিয়ান (তৎকালীন ছাংআন) থেকে। সেই পথ সিনজিয়াং হয়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে পৌঁছেছিল বাংলাদেশে (মংচিয়ালা)।কয়েক শতাব্দী ধরে এই মংচিয়ালাই ছিল চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের সেতুবন্ধ। একটি পূর্ব সিল্ক রোডও ছিল, যার উৎপত্তি হয়েছিল দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে তা সংযোগ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। এই দুটি পথ ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল, বৃদ্ধি পেয়েছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান।

প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র উপকূলীয় দেশ বিধায় সমুদ্রপথে তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ছিল চমৎকার। প্রায় ৬০০ বছর আগে চীনের মিং রাজবংশের পরাক্রমশালী সম্রাট ছিলেন ইয়ংলে। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ নাবিক অ্যাডমিরাল ঝেং হে ছিলেন সম্রাটের শান্তির দূত; তিনি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পরিভ্রমণ করেন। তিনিই সমুদ্রপথে চীনা সিল্ক রোড সৃষ্টি করেন। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অ্যাডমিরাল ঝেং হে শতাধিক জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে সাতটি আন্তসমুদ্র অভিযান পরিচালনা করেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার ৩০টি দেশ ও অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌবহর দুবার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। বাংলার শাসক সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ তার রাজধানী সোনারগাঁয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানান চীন থেকে আসা অ্যাডমিরালকে। সুলতান পরবর্তী সময়ে একটি দীর্ঘ গ্রীবার জিরাফসহ মূল্যবান নানা উপহার পাঠান মিং রাজার দরবারে। চীনা ঐতিহ্য অনুসারে জিরাফকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।[]

প্রাচীনকাল থেকে চীন নৌ ও স্থলশক্তিতে অত্যন্ত বলবান দেশ হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র ইতিহাসে চীন অন্য কোনো দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেনি, অন্য কোনো দেশ দখল করে নেয়নি। বরং সব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এসেছে।

রাজনৈতিক সম্পর্ক

[সম্পাদনা]

চল্লিশের দশকের শেষ বছরে সংঘটিত চীনা বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এক নতুন রূপ নেয়। এ সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল না; এটা ছিল আদর্শিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের শিকড়সূত্রে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই একাধিকবার বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সফর করেছেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। চীন-বাংলা সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়ায় জটিল ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে নানা কারণে চীনের বৈরী সম্পর্ক এবং ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে চীনের তিক্ততা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। এ অবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিলে চীন দক্ষিণ এশিয়ায়র একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে চীন ১৯৭৪ সাল অবধি বিরোধিতা করেছে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সালের শেষে ও ১৯৭৬ সালের শুরুতে চীন–বাংলাদেশ সম্পর্কের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল তার প্রধান অবলম্বন ছিল নিরাপত্তা ইস্যু। সেদিক থেকে এ সম্পর্ক সামরিক-রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ ছিল। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের প্রাথমিক সূত্র তৈরি হয় অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে।[]

অর্থনৈতিক সম্পর্ক

[সম্পাদনা]

চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে চীন থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী আমদানির বিপরীতে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। তবে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি চীন বাংলাদেশের ৯৭শতাংশ পণ্যের উপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে।

আঞ্চলিক নদী বণ্টন

[সম্পাদনা]

ব্রক্ষ্মপুত্র নদীতে বাধ দিয়ে তিব্বতে পানি দেওয়ার প্রকল্পে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়ই উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে।[]

দুই দেশের মধ্যে তুলনা

[সম্পাদনা]
বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চীন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন
আয়তন ১৪৮,৬১০ কিমি ৯,৫৯৬,৯৬১ কিমি
জনসংখ্যা ১৬২,৯৫০,০০০ ১,৩৭৬,০৪৯,০০০
জনসংখ্যার ঘনত্ব ১,১০৬/কিমি ১৪৫/কিমি
রাজধানী ঢাকা বেইজিং
বৃহত্তম শহরীয় এলাকা ঢাকা সাংহাই
সরকার সংসদীয় গণতন্ত্র কমিউনিস্ট একক রাষ্ট্র একদলীয় রাষ্ট্র
প্রথম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাও সেতুং
বর্তমান নেতা মুহাম্মদ ইউনূস শি জিনপিং
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাইনীজ
জিডিপি (নামমাত্র) $২৬১ বিলিয়ন $১২,০১৫ বিলিয়ন
জিডিপি (নামমাত্র) মাথাপিছু (২০১৭) ১৬০২ মার্কিন ডলার ৮৬৪৩ মার্কিন ডলার
জিডিপি (পিপিপি) (2017) ৬৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ২৩,১৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
জিডিপি (পি) প্রতি ক্যাপিটা (২০১৭) ৪,২০৭ মার্কিন ১৬,৬২৪ মার্কিন ডলার
মানব উন্নয়ন বিষয়সূচি ০.৬৩২ (মধ্যম) ০.৭৬১ (উচ্চ)
বৈদেশিক রিজার্ভ ৩৩,১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ৪,০০৯,৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
সামরিক ব্যায় ৩.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (জিডিপির ১.২ শতাংশ) ১৬৬.১০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০১২) (জিডিপির ২%)
জনবল সক্রিয় সেনা: ১৫৭,০০০ (৬৩,০০০ সংরক্ষিত কর্মী) সক্রিয় সেনা: প্রায় ২,২৮৫,০০০ (৮০০,০০০ সংরক্ষিত কর্মী)
মুল ধর্ম ইসলাম (৮৯%), হিন্দু (৯%), বৌদ্ধ (১%), খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য (১%). ১০% প্রতিটি: অ-ধর্মীয়, লোক ধর্ম এবং তাওবাদ, বৌদ্ধধর্ম। সংখ্যালঘু ধর্মগুলি হল ইসলাম এবং খ্রিস্টান

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা - বাংলাদেশের পাশে চীন"। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৭ 
  2. "চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের রসায়ন ও তার প্রভাব"। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৭ 
  3. Bagchi, Indrani (১২ জুন ২০০৭)। "Water-sharing clouds Indo-China ties"The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ 

টেমপ্লেট:চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক