বিষয়বস্তুতে চলুন

তাকলিদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তাকলিদ (আরবি: تَقْليد তাক়্-লীদ্, অর্থঃ ঐতিহ্য) একটি ইসলামি আইনি পরিভাষা। এ শব্দটি (আরবি: قلادة) থেকে এসেছে যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। যেমন বলা হয় قلد البعير সে উটের গলায় রশি বেধেছে। আরবিয় ডিকশনারি অনুযায়ী কোন ব্যক্তির কথা বিনা প্রমাণে মানার নাম তাকলিদ[]। তাকলিদ পারিভাষিক অর্থে বর্তমানে বোঝায় মুজতাহিদের কথা বিনা দলিলে অনুসরণ করা। যে ব্যক্তি তাকলিদ করে তাকে মুকাল্লিদ বলা হয়। কোনো ব্যক্তি যখন সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকে বিধি-বিধান জানার মত জ্ঞান রাখেন না তখন কোনো মুজতাহিদের মতের অনুসরণ করেন অর্থাৎ তাকলিদ করেন। যে সকল বিষয় না জানলে তাকলিদ করতে হয় সেগুলো হল - কুরআনের আয়াত, হাদিস, হাদিস সহিহ ও দুর্বল হওয়া সম্পর্কে, হাদিসের সনদ ও রাবীদের পরিচয়, নাসেখ (রহিতকারী), মানসুখ (রহিত) ও ইজমা (ঐকমত্য) সংঘটিত হওয়া বিষয়গুলো, তাখসিস (সীমাবদ্ধকরণ), তাকয়িদ (শর্তযুক্ত করণ) ইত্যাদি দলিলগুলো, শব্দের অর্থ নির্ণয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরবী ভাষা ও উসুলুল ফিকহ ইত্যাদি। তাকলিদ সাধারণত সেসকল বিধানের ক্ষেত্রেই করা হয় যেগুলো বাহ্যত অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য, ব্যাখ্যাযোগ্য এবং গবেষণালব্ধ। এর বিপরীতে যেসব বিধান দ্ব্যর্থতাহীন, সুস্পষ্ট ও অকাট্য, সে সকল বিষয় বা বিধানের ক্ষেত্রে তাকলিদ করার প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে চারটি প্রধান মাজহাব রয়েছে। এগুলো হল হানাফি, শাফি, মালিকি, হাম্বলি। এগুলোর প্রত্যেকটি পৃথক চারজন মুজতাহিদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। মাযহাবের অনুসরণ বলতে উক্ত মাযহাবগুলোর মুজতাহিদদের মতের অনুসরণ বুঝানো হয়। সাধারণভাবে এই চারটি মাযহাবের যেকোনো একটির অনুসরণ করা হয়। অবশ্য কেউ যদি জ্ঞান অর্জন করে মুজতাহিদ স্তরে পৌঁছুতে পারেন তাহলে তিনি কারো তাকলিদ না করে সরাসরি নিজে কুরআন হাদিস থেকে বিধান আহরণ করে চলতে পারবেন এবং তখন অন্য সাধারণ মানুষরা তাকে অনুসরণ করতে পারবে। সাধারণ মানুষদেরকে নিজের মাজহাব বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতো অন্য মাজহাবের মতামত গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়, তবে দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে অন্য মাজহাব সঠিক মনে হলে সেক্ষেত্রে ভিন্ন মাযহাবের মতামত গ্রহণ করতে বলা হয়। এই তাকলিদি পদ্ধতির সূচনা হয় ৪০০ হিজরির পরে বিশেষজ্ঞরা এই মত দিয়েছেন[]। হাতের কাছে কোন উৎস না থাকলে তাকলিদের না বুঝে অনুসরণের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হয়, আর সেক্ষেত্রে কোরআন হাদীসে সর্বাধিক অগ্রগণ্য, সৎ ও বিশ্বস্ত লোককে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তবে তারপরও যদি সমস্যা হয় তাহলে কোরআন ও সুন্নাহর দ্বারা যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হতে হবে, আর যখন সাধ্যে থাকবে না, তখন নির্ভরযোগ্য বলে অনুভূত ব্যক্তিকে তাকলিদ করা যায়, আর সাধ্যে থাকলে কিংবা খটকা লাগলে যাচাই বাছাই করতে বলা হয়েছে সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে উলীল আমর এর প্রসঙ্গে। তাকলিদ করা বা না করা দুটোরই উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অনুসরণ করা।

ইজতিহাদ ও তাকলিদ

[সম্পাদনা]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী স্বীয় গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’তে এবং কাজী সানাউল্লাহ পানিপতি তাঁর তাফসীরে মাযহারীতে বলেন, যে সকল ব্যক্তির ইজতিহাদ করার ক্ষমতা রয়েছে, তাদের জন্য কোন ব্যক্তি বা মাজহাবের তাকলিদ করা জায়েজ হবে না।[] শাহ ওয়ালীউল্লাহ বলেন,

যিনি কোনো একটি বিষয়েও ইজতেহাদ করার মত যোগ্যতা অর্জন করবেন, তার পক্ষে সে বিষয়ে অপরের অন্ধ তাকলীদ করা হারাম। অনুরূপভাবে যার নিকট এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো একটি আদেশ বা নিষেধ করেছেন এবং সে আদেশ বা নিষেধের ব্যাপারে বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস অনুসন্ধান করে এবং এর পক্ষে বা বিপক্ষে যারা রয়েছেন, তাদের কথা-বার্তা অনুসন্ধান করে সে ব্যক্তি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সে আদেশ বা নিষেধের কোনো মনসূখ বা রহিতকারী দলীল খুঁজে না পায়, অথবা বিষয়টি যদি এমন হয় যে, অধিকাংশ ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ রাসূলের আদেশ বা নিষেধ সম্বলিত কোনো হাদীস গ্রহণ করে থাকেন, অথচ দেখা যায় যিনি তা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছেন, তিনি কেবল কোনো ক্বিয়াস (রায়) অথবা ইজতেহাদ বা অনুরূপ কিছুর দ্বারা এর বিরোধিতা করছেন, এমতাবস্থায় সে যদি (তা অনুধাবন করার পরেও নিজের ইমাম বা মাযহাবের মতামত পালন করার জন্য) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সে হাদীসের বিরোধিতা করে, তখন বুঝতে হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের বিরোধিতার পিছনে তার অন্তরে গোপন নেফাকী বা প্রকাশ্য আহমকী ব্যতীত আর কোনো কারণ নেই।

সানাউল্লাহ পানিপথী কুরআনে বর্ণিত ‘‘আমরা যেন পরস্পরকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি।’’[আল ইমরানঃ ৬৪] এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন :

‘‘এখান থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো হাদীস যদি কারো নিকট কোনো প্রকার বিরোধ থেকে মুক্ত অবস্থায় সহীহভাবে প্রমাণিত হয় এবং এর কোনো রহিতকারীও তার নিকট প্রমাণিত না হয়, এমতাবস্থায় উদাহরণস্বরূপ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর কোনো ফতোয়াও যদি এর বিপরীতে হয়, আর চার ইমামের কোনো ইমাম এ হাদীসের উপর ‘আমল করে থাকেন, তা হলে সে ব্যক্তির পক্ষে উক্ত হাদীসের উপর ‘আমল করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। (এমতাবস্থায়) কঠিনভাবে তার মাযহাবকে আঁকড়ে ধরে থাকা যেন তাকে সে হাদীসের উপর ‘আমল করা থেকে বিরত না রাখে। কেননা, এমনটি করলে এতে আল্লাহকে ব্যতীত পরস্পরকে অসংখ্য রব বানানোর শামিল হবে।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. আল মুজা'মুল ওয়াসীয়ত পৃঃ৭৫৪, আল কামুউস আল ওয়াহীদ পৃঃ১৩৪৬, মিসবাহুল লুগাত পৃঃ৭০১, হাসানুল লুগাত ফারসী পৃঃ২১৬।
  2. হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীস দেহলভী
  3. আলী, মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল। "আনুগত্য ও অনুসরণের উপাসনা (عبادة الطاعة والاتباع)"www.hadithbd.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]