উইলিয়াম কেরি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
উইলিয়াম কেরি
William Carey
১৮৮৭ সালে জন ব্রাউন মায়ার্স অঙ্কিত উইলিয়াম কেরি।
জন্ম(১৭৬১-০৮-১৭)১৭ আগস্ট ১৭৬১
মৃত্যু৯ জুন ১৮৩৪(1834-06-09) (বয়স ৭২)
সঙ্গীপ্রথম (ডরোথী প্লাকেট)

দ্বিতীয় (সার্লট রুউমোরক)

তৃতীয় (গ্রেস হগ্সক)
সন্তানফেলিক্স কেরী
পিতা-মাতা
  • এডমন্ড কেরি (পিতা)
  • এলিজাবেথ (মাতা)

উইলিয়াম কেরি (ইংরেজি: William Carey; ১৭৬১ – ১৮৩৪) ছিলেন একজন মিশনারি ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক, ব্রিটিশ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক, যাজক, বিশেষ ব্যাপটিষ্ট মন্ত্রী, অনুবাদক, সামাজিক সংস্কারক, এবং সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ[১] তিনি ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, প্রথম ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর কলেজ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

জন্ম ও বাল্যকাল[সম্পাদনা]

উইলিয়াম কেরি ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের নর্দানটন শায়ার, পলাইপুরী গ্রামে একটি দরিদ্র তাঁতী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এলিজাবেথ ও এডমন্ড কেরির পাঁচ সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম কেরি ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। ছয় বছর বয়সে তার পিতা তার জন্য স্থানীয় চার্চ সম্প্রদায়ের করণিক ও গ্রাম্য স্কুলশিক্ষককে নিযুক্ত করেন। বাল্যকাল থেকেই কেরি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। তখন থেকেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষত উদ্ভিদবিদ্যায় কেরির গভীর আগ্রহ লক্ষিত হয়। এছাড়াও ভাষাশিক্ষার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন বিশেষ মেধাসম্পন্ন। স্বচেষ্টায় তিনি লাতিন ভাষা শিখতে সামর্থ হয়েছিলেন।[২]

প্রথম যৌবনকাল[সম্পাদনা]

১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হ্যাকেল্টন-এ ক্লার্ক নিকোলাস নামক এক মুচির অধীনে  কাজ শিখা শুরু করেন। নিকোলসের কাছে শিক্ষানবিশ করার সময় তিনি স্বচেষ্টায় স্থানীয় এক কলেজ-শিক্ষিত গ্রামবাসীর সহায়তায় গ্রিক ভাষা শিখেন। [৩]

১৭৭৯ সালে নিকোলসের মৃত্যু হলে কেরি থমাস ওল্ড নামক অপর এক মুচির নিকট কাজ করতে যান। ১৭৮১ সালে থমাস ওল্ডের শ্যালিকা ডরোথি প্ল্যাকেটকে বিবাহ করেন। তাঁদের বিবাহ হয়েছিল চার্চ অফ সেন্ট জন ব্যাপটিষ্ট গির্জায়। ডরোথি লেখাপড়া জানতেন না, তাই বিবাহের স্বাক্ষরের স্থানে ক্রস চিহ্ন দিয়েছিলেন। এঁদের মোট ৪টি পুত্র ও ২টি কন্যা সন্তান জন্মেছিল। মেয়ে দুটি অল্পবয়সেই মারা যায়। তাদের পুত্র পিটারও মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা যায়। এর কিছুদিনের ভিতরে থমাস ওল্ড মৃত্যুবরণ করলে, কেরী তার ব্যবসার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি হিব্রু, ইতালীয়, ডাচফরাসি ভাষা শেখেন। জুতা প্রস্তুত করার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়শই তিনি পড়াশোনা করতেন।[৪]

ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

এইভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠার কারণে স্থানীয় মিশনারীদের সাথে একটি শখ্যতা গড়ে উঠে কেরির, মাঝে মাঝে তাঁকে স্থানীয় গির্জায় ভাষণ দেওয়ার জন্যও আমন্ত্রণ জানানো হতো। সেই সময় কেরি নবগঠিত স্থানীয় সংঘ স্ট্রিক্ট ব্যাপ্টিস্ট-এর কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই সংঘে জন রিল্যান্ড, জন সাটক্লিফঅ্যান্ড্রু ফিলার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তীতে তারা কেরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেন। প্রায়শই রবিবার নিকটবর্তী বার্টন গ্রামের গির্জায় ধর্মোপদেশ দানের জন্য তারা কেরিকে আমন্ত্রণ জানাতেন। ১৭৮৩ সালে ৫ অক্টোবর রিল্যান্ড কর্তৃক বাপ্তিস্ম হন কেরি, এবং নিজেকে উৎসর্গ করেন ব্যাপ্টিস্ট ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে।[৫]

১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মৌল্টন স্কুলে শিক্ষতার চাকরি পান। এই চাকরির পাশাপাশি তিনি ব্যাপ্টিস্ট হিসেবে গির্জায় ভাষণও দিতেন। এই সময় তিনি গির্জা ও স্কুলের সূত্রে নানা ধরনের বই পড়ার সুযোগ পান। তিনি জোনাথান এডওয়ার্ডস রচিত অ্যাকাউন্ট অফ দ্য লাইফ অফ দ্য লেট রেভ. ডেভিড ব্রেইনার্ড এবং আবিষ্কারক জেমস কুকের অভিযানকাহিনি অধ্যয়ন করেন। সমগ্র বিশ্বে খ্রিষ্টীয় গসপেলগুলির প্রচার সম্বন্ধেও সচেতন হয়ে ওঠেন কেরি। তার বন্ধু অ্যান্ড্রু ফিলার ১৭৮১ সালে দ্য গসপেল ওর্দি অফ অল অ্যাকসেপ্টেশন নামে একটি প্রভাবশীল পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। তৎকালীন ব্যাপ্টিস্ট চার্চে কর্তৃত্বকারী হাইপার-ক্যালভিনিস্ট বিশ্বাস ছিল যে সকলে গসপেলে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নয়। এই পুস্তিকা সেই বিশ্বাসের জবাব হিসেবে রচিত হয়। ১৭৮৬ সালে মিনিস্টারদের একটি বৈঠকে কেরি প্রশ্ন তুললেন বিশ্বময় গসপেলের প্রচার প্রত্যেক খ্রিষ্টানের কর্তব্য কিনা। জন রিল্যান্ডের পিতা জে আর রিল্যান্ড তার উত্তর দিয়েছিলেন, " যুবক, তুমি বসো; ঈশ্বর যখন অখ্রিষ্টানদের ধর্মান্তরিত করতে চাইবেন, তখন তিনি সেই কাজ তোমার আমার সাহায্য ব্যতিতই করবেন।" ("Young man, sit down; when God pleases to convert the heathen, he will do it without your aid and mine.") রিল্যান্ডের পুত্র জন রিল্যান্ড জুনিয়র অবশ্য মনে করেন, তার পিতা এমন কোনো মন্তব্য করেননি।[৬]

১৭৮৯ সালে কেরি লেইসেস্টার-এ একটি ছোটো ব্যাপ্টিস্ট চার্চে পূর্ণ সময়ের প্যাস্টররূপে নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি জুতো তৈরির কাজ ছেড়ে দিয়ে পূর্ণদমে মিশনারির কাজ শুরু করেন। তিন বছর বাদে ১৭৯২ সালে তিনি প্রকাশ করেন (অ্যান এনকোয়ারি ইনটু দি অবলিগেশনস অফ খ্রিষ্টিয়ানস টু ইউজ মিনস ফর কনভারসন অফ দ্য হিদেনস) An Enquiry into the Obligations of Christians to use Means for the Conversion of the Heathens) নামে এক ঐতিহাসিক মিশনারি ইস্তেহার। এই ছোটো বইটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। প্রথম খণ্ডে ছিল মিশনারি কার্যকলাপের ধর্মতাত্ত্বিক যাথার্থবিচার। এখানে বলা হয় যে খ্রিষ্ট স্বয়ং বিশ্বব্যাপী শিষ্যসংগ্রহের আদেশ দিয়েছিলেন (মথি ২৮:১৮-২০), যা সকল খ্রিষ্টানের আবশ্যকর্তব্য। দ্বিতীয় খণ্ডে আদিযুগের চার্চ থেকে ডেভিড ব্রেনার্ড ও জন উইজলি পর্যন্ত মিশনারি কার্যকলাপের ইতিহাস বিধৃত আছে। তৃতীয় খণ্ডে ছাব্বিশ পাতা জুড়ে রয়েছে বিশ্বের সকল দেশের অঞ্চল, জনসংখ্যা ও ধর্মীয় পরিসংখ্যান তালিকার সারণি। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় কেরি এই তথ্যগুলি আহরণ করেছিলেন। চতুর্থ খণ্ডে মিশনারি প্রেরণের বিভিন্ন আপত্তির কারণ, যথা, ভাষার দুর্বোধ্যতা বা জীবনের আশঙ্কা প্রভৃতির উত্তর দেওয়া হয়েছে। সবশেষে পঞ্চম খণ্ডে একটি মিশনারি সমাজের ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানানো হয় এবং তার সাহায্যার্থে বিভিন্ন ব্যবহারিক ব্যবস্থার বর্ণনাও দেওয়া হয়। কেরির মৌলিক এই পুস্তিকাটি তার মিশনের মূলভিত্তিগুলি নির্ধারণ করে দেয়: খ্রিষ্টানের দায়িত্ব, প্রাপ্ত সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার ও যথাযথ তথ্য।[৬]

ধর্মপ্রচারকদের সপক্ষে কেরি পরে একটি উপদেশ (তথাকথিত মৃত্যুহীন উপদেশ) প্রচার করেন। এই উপদেশে তিনি ইশাইয়া ৫৪:২-৩ অংশটি ব্যবহার করেন এবং বারংবার একটি শ্লেষোক্তি ব্যবহার করেন যা পরে তার সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ উক্তিতে পরিণত হয়: ইশ্বরের কাছ থেকে মহৎ বস্তু প্রত্যাশা কর; ইশ্বরের জন্য মহৎ কর্ম প্রচেষ্টা কর।[৭]

অবশেষে কেরি মিশনারি প্রেরণের সকল বাধা অতিক্রম করেন। ১৭৯২ সালের অক্টোবরে কেরি, অ্যান্ড্রু ফিলার, জন রিল্যান্ড, জন সাটক্লিফকে সনদ সদস্য করে গঠিত হয় পারটিকুলার ব্যাপ্টিস্ট সোসাইটি ফর পোপাগেটিং দ্য গসপেল অ্যামোং দ্য হিদেনস (বর্তমানে বিএমএস ওয়ার্ল্ড মিশন)।[৮] অতঃপর তারা অর্থসংগ্রহ এবং কোথায় ধর্মপ্রচার করা হবে সে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। ড. জন টমাস নামে এক মেডিক্যাল মিশনারি কলকাতায় কাজ করছিলেন। সেই সময় তিনি অর্থসংগ্রহের কাজে ইংল্যান্ডে আসেন। তারা তাকেই সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঠিক হয় কেরি তার সঙ্গে ভারতে যাবেন।[৯]

ভারতে আগমন[সম্পাদনা]

১৭৯৩ সালের ১৩ জুন  এই উপমহাদেশের মানুষের জন্যে স্মরণীয় দিন। এদিন কেরী উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কেরি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ফিলিক্স, স্ত্রী ও কন্যাসহ থমাস একটি ইংরেজ জাহাজে চেপে লন্ডন ছাড়েন। ডরোথি কেরি প্রথমে তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ সেই সময় কেরির চতুর্থ পুত্র ডরোথির গর্ভে। তাছাড়া তিনি জীবনে নিজের বাড়ি থেকে দূরে বড়ো একটা যাননি কখনও। কিন্তু ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে তারা আর একবার ডরোথিকে তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেন। ডরোথির বোন কেটি তাকে সন্তানের জন্মের সময় সাহায্য করবেন জেনে ডরোথি রাজি হন। আইল অফ ওয়েইট-এ তাদের যাত্রা বিলম্বিত হয়। একটি বার্তার মাধ্যমে তাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন জানতে পারেন এই অননুমোদিত মিশনারিদের কলকাতায় নিয়ে গেলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক একচেটিয়া নীতি লঙ্ঘিত হবে। তাই তিনি তাদের জাহাজে স্থান দিতে অস্বীকার করেন।[১০]

জুন মাসে থমাস এক ড্যানিশ ক্যাপ্টেনের সন্ধান পান যিনি তার জাহাজে কেরির দলটিকে স্থান দিতে রাজি হন। কেরির স্ত্রী ততদিনে তাদের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তিনি এই শর্তে কেরির সঙ্গে যেতে রাজি হন যে তার বোনও তার সঙ্গে যাবেন।১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি ও তার সহযাত্রীগণ কলকাতায় উপনীত হন। তখন তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। কলকাতায় এসে স্থানীয় লোকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য, রামরাম বসুর কাছে বাংলা শিখতে আরম্ভ করেন। এই সময় দুটি নীলকুঠির মালিক ছিলেন থমাসের এক বন্ধু। সেই কুঠিতে ম্যানেজারের প্রয়োজন পড়াতে কেরি সপরিবারে মেদেনীপুরে চলে আসেন। এবং এই কুঠির ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নেন। পরবর্তী ছয় বছর সেই নীলকুটিতে ম্যানেজারের কাজ করার সময় এখানে তিনি একটি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খোলেন ও হিন্দু মুসলমান যুবকদের জন্যে মেদেনীপুরে একটি এবং রামপাল দীঘিতে একটি কলেজ স্থাপন করার চিন্তা প্রকাশ  করেন। এ সময় তিনি বাংলা ভাষায় বাইবেলের নূতন নিয়মের অনুবাদ এর প্রথম সংস্করণের কাজ সমাপ্ত করেন। এবং তিনি তার মিশনারির নীতিনির্দেশিকাও প্রস্তুত করেন। এই নির্দেশিকায় একত্র বাস, আর্থিক স্বনির্ভরতা ও স্থানীয় মিনিস্টারদের প্রশিক্ষণের কথা ছিল। এরই ভিত্তিতে স্থাপিত হয় তার মিশনারি সম্প্রদায়।[১১]

১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আমাশয় রোগে তার ৫ বৎসরের পুত্র পিটার মারা যায়। এই কারণে তার স্ত্রীর স্নায়ুবৈকল্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই রোগেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এবং এই বৎসরে তিনি বেঙ্গালি এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।[১২]

অবদান[সম্পাদনা]

১৭৯৮ সালে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর ছাত্রাবাস স্থাপন করেন।

শ্রীরামপুর কলেজে কেরির ব্যবহৃত ডেস্ক।

ইতিমধ্যে মুল মিশনারি সোসাইটি ভারতে আরও মিশনারি পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সুত্র ধরে প্রথমে আসেন জন ফাউন্টেইন। তিনি মেদেনীপুরে একটি স্কুল চালু করেন। তারপর ১৭৯৯ সালের শেষ দিকে আসেন চিত্রকর উইলিয়াম ওয়ার্ড, স্কুলশিক্ষক জোশুয়া মার্শম্যান, মার্শম্যানের ছাত্র ডেভিড ব্রানসডন এবং উইলিয়াম গ্রান্ট, যিনি অবতরণের তিন সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখনও মিশনারিদের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলো। তাই  মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে একটি মার্কিন জাহাজে এসেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁদের আসল উদ্দেশ্যের খবর জানতে পেরে তাঁদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়। এমন সময় তারা কলকাতার অদূরে শ্রীরামপুরের ড্যানিশ কলোনিতে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। ও সেখানে বসবাস শুরু করেন। এবং ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি কেরিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এদের প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্টমিশন গড়ে উঠে। ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা প্রসারের সুবিধার্থে তারা এখানে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। এই প্রেস থেকেই এ বছর ৫ই মার্চ উইলিয়ম কেরির সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় বাইবেলের নতুন নিয়ম প্রকাশ করা হয়।[১৩] এই বছরেই ফাউন্টেইন মারা যান এবং তারা প্রথম কৃষ্ণ পালকে খ্রিষ্টান বানাতে সক্ষম হন। এছাড়াও এ বছর তিনি বালকদের জন্যে প্রথম অবৈতনিক দৈনিক স্কুল স্থাপন করেন এবং পুরাতন নিয়মের মাত্র দুটো পুস্তক ছাড়া সম্পূর্ণ বাইবেলের অনুবাদ শেষ করেন।

১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড ব্রুনস্‌ডন এবং থমাস মৃত্যুবরণ করেন। এই বছরে কোম্পানির গভর্নর-জেনারেল ওয়েল্সলি ইংল্যান্ড থেকে আগত কোম্পানির তরুণ সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল ইত্যাদি শেখানোর উদ্দেশে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামক একটি কলেজ স্থাপন করেন। এবং উইলিয়াম কেরি এই বছর মে মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হন। সেই সাথে কেরির অধীনে কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিত এবং মুনশি নিযুক্ত হয়। দেশীয় পণ্ডিতদের নিয়ে কেরি শ্রেণি ভিত্তিক কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেন। রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রথম দু বছরে তিনটি গ্রন্থ এবং কেরি একটি বাংলা ব্যাকরণ ও আদর্শ সংলাপের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

১৮০৩ সালে তিনি নিজের মত করে একটি মিশনারি স্থাপন করেন।[১৪] ও ১৮০৫ সালে তার মারাঠী ব্যাকরণ (Marathi grammar) প্রকাশিত হয়। ১৮০৭ সালে তাকে বাউন ইউনিভার্সিটি সম্মান সূচক ডক্টর অফ ডিভিনিটি ডিগ্রি প্রদান করে। এবং এ বছর তার প্রথম স্ত্রী মারা যান। পরে ১৮০৮ সালে তিনি ড্যানিশ মেয়ে সার্লট রুউমোরকে বিয়ে করেন। এবং এই বৎসরেই তার সংস্কৃতিতে অনূদিত নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।

১৮০৯ সালে তিনি বাংলাতে সম্পূর্ণ বাইবেলের অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এবং এ বছরই তা ছাপা হয়। ও ১৮১১ সালে মারাঠি ভাষায় করা তার অনুবাদ নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়। ১৮১২ সালের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় তার প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর ছাপাখানায় আগুন লাগে। এতে করে টাইপ, অনুলিপি, পুস্তকসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এ সংবাদ কলকাতায় পৌঁছালে সেখান থেকে আট হাজার দুইশত টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে খবর পৌছানোর দুই মাসের মধ্যে প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। এ বছরই কেরির "ইতিহাস মালা" পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে প্রায় ১৫০টি শিরোনামের নানা স্থানের ১৪৮টি গল্প মুদ্রিত হয়।

১৮১৪ সালে ভারতবর্ষের জনসাধারণের জন্যে তিনি সরকারের কাছে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব (Plan for instructing native inhabitants of India in European Sciences) পেশ করেন। ও ১৮১৫ সালে পাঞ্জাবি ভাষায় করা তার অনুবাদ নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়। এবং ১৮১৭ সালে দেশীয় ছাত্রদের মাঝে পুস্তকের অভাব মেটানোর উদ্দেশ্যে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে ১৬ জন ইউরোপীয়, ৪ জন মৌলভী ও ৪ জন বাঙালী হিন্দু, নিয়ে এর পরিচালক সমিতি গঠন করা হয়।

১৮১৮ সালে "দিকদর্শন" নামে একটি মাসিক, "সমাচার দর্পণ" নামে একটি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা এবং ১৮২১ সালে "Friends of India" নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেরি শ্রীরামপুর কলেজে এখানে বসবাস করতেন।

স্কুল পরিচালনার জন্য কলকাতা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হয়।  স্কুল এবং কলেজের জন্যে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের জন্যেও কেরী কাজ করেন। ভারতে স্ত্রী শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে এবং সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে তিনি বিশেষভাবে তৎপর ছিলেন। এ বছর সংস্কৃত ভাষায় করা তার অনুবাদ পুরাতন নিয়ম অনূদিত হয়।

১৮১৯ সালে বড়লাট পত্নী লেডি হেস্টিংসের উৎসাহে ড.উইলিয়াম কেরি একটি কৃষি সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির কয়েকটি স্থানে আদর্শ কৃষি উদ্যান ছিল। ১৮২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হর্টিকালচার ও এ্যাগ্রিকালচার সোসাইটি স্থাপন করেন। এই বছর তিনি মারাঠি ভাষায় পুরাতন নিয়ম প্রকাশ করেন। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর স্কুলকে কলেজে উন্নীত করেন। এবং এ বছর কেরীর দ্বিতীয় স্ত্রী সার্লট মারা যান।[১৫]

১৮২২ সালে তার জীবনে বড় ধরনের দুটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এ বছর তিনি তার যোগ্য পুত্র ফেলিক্স কেরিকে হারান এবং তার বহু পরিশ্রমের ফসল ইউনিভার্সাল ডিকশেনারি বা ভারতীয় ১৩টি প্রধান ভাষার সর্বশব্দ কোষ আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গ্রেস হগ্সকে তার তৃতীয় সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। ও ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন। এবং ১৮২৯ সালে ৫ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি আইন জারি করেন এবং বিশেষ দূতের মাধ্যমে ঐ দিনই এই আইনের বাংলা অনুবাদের জন্য কেরির কাছে পাঠান। সারাদিন ধরে এটি অনুবাদ করে বৃদ্ধ কেরি নিজেই বেন্টিঙ্কের হাতে পৌঁছে দেন। এবং সেই দিনই ঘোড়ায় চড়ে কলকাতার আশেপাশের লোকদের এই আইনের কথা জানান। আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটি ১৮৩০ সালে বন্ধ হয়ে যায়, যেখানে কেরি প্রায় ৩১ বছর বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।তিনি বাংলা মুদ্রনের প্রবর্তক।


মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৮৩৪ সালের ৯ জুন ৭৩ বছর বয়সে উইলিয়াম কেরি নামক এই ভদ্রলোকের মহান কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের সমাধি ক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।[১৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মঙ্গলাদি, বিশাল (১৯৯৯)। The Legacy of William Carey: A Model for the Transformation of a Culture। পৃষ্ঠা ৬১–৬৭। আইএসবিএন 978-1-58134-112-6 
  2. Beck, James R. Dorothy Carey: The Tragic and Untold Story of Mrs. William Carey. Grand Rapids: Baker Book House, 1992.
  3. "Glimpses #45: William Carey's Amazing Mission"। Christian History Institute। ২০০৫-০৪-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-১১ 
  4. Carey, William. An Enquiry into the Obligations of Christians to Use Means for the Conversion of the Heathens. Leicester: A. Ireland, 1791.
  5. F. Deaville Walker, William Carey. Missionary Pioneer and Statesman (1925 ed.; repr. Chicago: Moody Press, n.d.), 54, n.1. See the recent discussion of this event by Brian Stanley, The History of the Baptist Missionary Society 1792–1992 (Edinburgh: T & T Clark, 1992), 6-7.
  6. Nicholls, Bruce J. "The Theology of William Carey." In Evangelical Review of Theology 17 (1993): 372.
  7. Marshman, Joshua Clark. Life and Times of Carey, Marshman and Ward Embracing the History of the Serampore Mission. 2 vols. London: Longman, 1859.
  8. Oussoren, Aalbertinus Hermen. William Carey, Especially his Missionary Principles. Leiden: A. W. Sijthoff, 1945.
  9. Walker, F. Deaville. William Carey: Missionary Pioneer and Statesman. Chicago: Moody, 1951.
  10. Murray, Iain. The Puritan Hope: Revival and the Interpretation of Prophecy. Edinburgh: Banner of Truth Trust, 1971.
  11. Potts, E. Daniels. British Baptist Missionaries in India 1793–1837: The History of Serampore and its Missions. Cambridge: University Press, 1967.
  12. Smith, George. The Life of William Carey: Shoemaker and Missionary. London: Murray, 1887.
  13. "উইলিয়াম কেরী : বাংলাপ্রেমী এক বিদেশী"dailysangram.com। ১৫ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ এপ্রিল ২০২০ 
  14. "উইলিয়ম কেরি"onushilon.org। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০২০ 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বাংলা
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় । বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত । পঞ্চম খণ্ড । কলকাতা: মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড । ১৯৮৫ ।
ইংরেজি

Carey, Eustace – Memoir of William Carey, D. D. Late missionary to Bengal, Professor of Oriental Languages in the College of Fort William, Calcutta. 1837, 2nd Edition, Jackson & Walford: London.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]