ফারাক্কা বাঁধ
ফারাক্কা বাঁধ | |
---|---|
অবস্থান | মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
স্থানাঙ্ক | ২৪°৪৮′১৬″ উত্তর ৮৭°৫৫′৫৯″ পূর্ব / ২৪.৮০৪৪৪° উত্তর ৮৭.৯৩৩০৬° পূর্ব |
নির্মাণ শুরু | ১৯৬১ |
উদ্বোধনের তারিখ | ১৯৭২ |
নির্মাণ ব্যয় | ₹১৫৬.৪৯ কোটি |
নির্মাণ করেছে | হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এইচসিসি) |
নকশাকার | হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এইচসিসি) |
মালিক | ভারতীয় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ |
অপারেটর | ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ |
বাঁধ এবং অতিরিক্ত জলনির্গমপথ | |
আবদ্ধতা | গঙ্গা নদী |
দৈর্ঘ্য | ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফু) |
ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফু) লম্বা যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় বানানো হয়েছিল। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিমি)।[১]
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে পলি জমা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়। শুখা মরসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট/সে (১,১০০ মি৩/সে) জল হুগলি নদীর অভিমুখে চালিত করে।[২]
হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বাঁধটি তৈরি করে। বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জল এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধের উপর দিয়ে গিয়েছে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। যা কেবল উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকেই নয়, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশকে বাকী ভারতের সঙ্গে জুড়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। এই বাঁধের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল জলের অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার জলে পুষ্ট করে, দিন দিন নব্যতা হারিয়ে যাওয়া কলকাতা বন্দরকে পূর্বারূপে কার্যক্ষম করে তোলা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে অবস্থিত হলদিয়া বন্দর থেকে উত্তরপ্রদেশের বেনারস অবধি অংশকে ভারতীয় জাতীয় জলপথ-১ এর স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ফারাক্কা বাঁধ ভারত তৈরি করে কলকাতা বন্দরকে পলি জমা থেকে রক্ষা করার জন্য। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খালখননের পরিকল্পনােও কাজ শুরু করে । পরবর্তীতে যা মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে । এটি প্রায় ১৮ কি.মি লম্বা এবং মনহরপুরে অবস্থিত। [৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ব্রিটিশ সরকার পলি সঞ্চয়ের কারণে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা লক্ষ্য করছিলেন। কারণ হুগলী-ভাগরথী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছিল। ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে কীভাবে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।
তৎকালীন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেন।
- গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।
- গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।
- প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।
- ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতি শক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরনের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।
- ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
- শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিবে।[৪]
ভারতের একতরফা গঙ্গার জল সরাবার কারণে যে শুধু বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়; বরং এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বন ও নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২৯ অক্টোবর, ১৯৫১ সালে তখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গা নদী হতে বিপুল পরিমাণ পানি পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদী পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অপসারণ করার ভারতীয় পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত জবাব দেয় তাদের এই পরিকল্পনা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং এর ফলাফল সম্পর্কে পাকিস্তানি উদ্যেগ শুধু মাত্র তত্ত্বীয় ব্যাপার। সেই থেকে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে লম্বা আলাপ-আলোচনার জন্ম দেয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলোচনা করে। কিন্তু এই আলোচনা যখন চলছিল তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ অব্যহত রাখে এবং ১৯৭০ সালে এর কাজ সমাপ্ত করে। বাঁধটির অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৬.৫ কিলোমিটার (১০.৩ মাইল) দূরে অবস্থিত।[৫]
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করে।১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে দশ (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) দিনের জন্য ভারতকে গঙ্গা হতে ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু মুজিবুর রহমান হত্যার পর ভারত কোনোরকম আলোচনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে এবং ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী হতে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে।[৬]
ফারাক্কা লং মার্চ
[সম্পাদনা]মাওলানা ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ সংগঠিত করা। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কা লং মার্চের নেতৃত্ব দেন তখন তার বয়স ৯০ বছরের বেশি।[৭]
১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে মাওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছিয়াত্তরের ১৮ই এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন। তাঁর এই কর্মসূচি তখন অনেককে বেশ চমকে দিয়েছিল। কারণ ৯০ বছরের একজন মানুষের ঘরেই থাকার কথা। এ জন্য ১৬ই মে রাজশাহী শহর থেকে লংমার্চ করার ঘোষণা দেন তিনি। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৬ সালের ২ মে মাওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। এর পরে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
এই লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লিখেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সে চিঠিতে মিসেস গান্ধির কাছে লংমার্চের কারণ বর্ণনা করেন ভাসানী।
সাংবাদিক এনায়েতউল্লাহ খান, আনোয়ার জাহিদ এবং সিরাজুল হোসেন খান এ চিঠি তৈরি করতে আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সহায়তা করেন। লংমার্চ সফল করার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে সবার প্রতি আহবান জানান।
জাতীয় কৃষক সমিতির আবু নোমান খান সে লংমার্চ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন মজলুম জননেতা : মাওলানা ভাসানী স্মারক সংকলন’ বইতে। আবু নোমান খান লিখেছেন, লংমার্চের মিছিল রাজশাহী থেকে প্রেমতলী, প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মনকষা এবং মনকষা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত ৬৪ মাইল অতিক্রম করবে। মাওলানা ভাসানীর অনুসারীরা তাকে একজন রাজনীতিবিদের চেয়ে ‘দার্শনিক’ হিসেবেই বেশি বিবেচনা করতেন। তার সমর্থকরা মনে করেন, ৪৫ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী যা অনুমান করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটিই ঘটেছে। বাংলাদেশের একজন লেখক আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করে ১৯৯৫ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই।’ উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ১৬ মে রাজশাহী শহর থেকে ফারাক্কা অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। হাজার-হাজার মানুষ সমবেত হয় সেই মিছিল ও জনসভায়।
সে সময় বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে কর্মরত ছিলেন হাসান মীর। তার বাড়িও রাজশাহীতে। হাসান মীর তখন লংমার্চের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করতে দুই-তিন দিন আগেই তিনি মাওলানা ভাসানী রাজশাহী এসে পৌঁছান। হাসান মীরের বর্ণনায়, ‘রাজশাহী শহরে তখন অচেনা মানুষের ভিড়। লংমার্চে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সর্বস্তরের মানুষ আসছে। রাস্তায় রাস্তায় লাউড স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে - ১৬ই মে রোববার মাদ্রাসা মাঠ থেকে লংমার্চ শুরু করবে। বাসা থেকে বেতার ভবনে যাওয়ার সময় দেখলাম পথঘাট লোকে লোকারণ্য। বিশাল মাদ্রাসা মাঠে ভীড় উপচে পড়ছে।’ সেই লংমার্চের খবর সংগ্রহ করতে রাজশাহী গিয়েছিলেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের জন্য খবরা-খবর পাঠাতেন। মোনাজাত উদ্দিনের স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘পথ থেকে পথে’ বইতে সেই লংমার্চের কিছু বিষয় বর্ণনা করেছেন।
মোনাজাত উদ্দিন লিখেছেন, ‘মিছিলের আগে মাদ্রাসা ময়দানে জনসভা। ভাসানী এলেন নীল গাড়িতে চেপে। জনসমুদ্র গর্জে উঠল। খুব অল্প সময়ের জন্য তিনি বক্তৃতা করলেন। বহু সাংবাদিক, বহু ফটোগ্রাফার।’ লংমার্চের ৬৪ কিলোমিটার যাত্রা ছিল বেশ কঠিন। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে। কারণ তার বয়স ৯০ বছরের বেশি। তার উপর কিছুদিন আগেই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ‘মাওলানা ভাসানীর জীবনস্রোত’ শিরোনামে একটি লেখায় সেই লং মার্চ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন জাতীয় কৃষক সমিতির সাবেক সপ্তর সম্পাদক আবু নোমান খান। ‘মিছিলের শুরুতে ভাসানীসহ নেতৃবৃন্দ পুরোভাগে দাঁড়ান। মিছিলটি তিন মাইল দুরে রাজশাহী কোর্ট এলাকায় যেতে না যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামে। তা সত্ত্বেও লক্ষ জনতার মিছিল এগিয়ে চলে। এগারো মাইল অতিক্রম করে প্রেমতলী পৌঁছে। তখন দুপুর দুটো,’ লিখেছেন আবু নোমান খান। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল তিনটা নাগাদ লংমার্চ আবারো যাত্রা শুরু করে। এরপর প্রায় ২০ মাইল পথ অতিক্রম করে রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছে মিছিলটি। রাতে সেখানেই তারা অবস্থান করেন। পরদিন সকাল আট ৮ টায় আবারো যাত্রা শুরু করে লংমার্চ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আরো ছয় মাইল পথ অতিক্রম করে কানসাট পৌঁছায়|
আবু নোমান খানের বর্ণনায়, ‘পথের দুধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে হাজার-হাজার মানুষ- উদ্দেশ্য ফারাক্কা লং মার্চের মিছিলকারীদের অভ্যর্থনা জানানো। মিছিলকারীদের পানি ও বিভিন্ন খাবার খাইয়েছেন তারা।’ ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি চলতে পারে।
বিকেল চারটার দিকে সেখানে জনসভায় বক্তব্য রাখেন মাওলানা ভাসানী। সে জনসভায় তিনি বলেন, ফারাক্কা সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষের দাবি উপেক্ষা করে তাহলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হবে। হাসান মীর বলেন, ‘তিনি বাড়তি কোন ঝুঁকি নিতে চাননি বলে মিছিলকারীদের সীমান্তের কাছে যেতে নিষেধ করেন। আর এভাবেই মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের সমাপ্তি ঘটে।’ ফারাক্কা লং মার্চের পর থেকে মাওলানা ভাসানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তখন থেকে মাওলানা ভাসানীর বেশিরভাগ দিন কেটেছে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ১৭ ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মাওলানা ভাসানীর মৃত্যু হয়।
বিভিন্ন সময়ের জলবণ্টন চুক্তি
[সম্পাদনা]ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। ২৬ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তি পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কোনো চুক্তি না থাকায় ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়, ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশর নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ভারত বাংলাদেশকে সমান পরিমাণ পানি দেবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে। ফলে এরপর দুই দেশের মধ্যে কোন মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়নি। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রীজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হত। ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেওয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। অবশেষে,১৯৯৬ সালে মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক উন্নত হয় এবং ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সই করেন।
বাংলাদেশের ক্ষতি
[সম্পাদনা]শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবং সৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
- পদ্মা নদী দিয়ে পলি প্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।
- কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।
- পলি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।
- মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমুদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশঙ্কা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।
- জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না ।
- টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সাথে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে
- প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।[৮]
বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণ
[সম্পাদনা]পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] মওসুমী বৃষ্টি ও এই স্তরে রিচার্জ করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সেচের জন্য খরার মৌসুমে এখন ভরসা দ্বিতীয় স্তর (>৩০০ ফুট)। বরেন্দ্র অঞ্চলে এই স্তরটা মোটামুটি ফসিল পানি দিয়ে পূর্ণ। ব্যাপক সেচের ফলে এই স্তর থেকে কতদিন পানি উত্তোলন করা যাবে কে জানে। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার যোগান কীভাবে দিবে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এই দৃষ্টিকোণ থেকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাহিক রূপ এই অঞ্চলের জনগণ ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন। মরুকরণের অনেক বায়ো মার্কার রয়েছে, এইগুলো হতে পারে পানি নির্ভর উদ্ভিদ এবং আরো সুক্ষ স্তরে অণুজীব। আশা করা যায় দেশের নতুন প্রজন্মের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে গবেষণায় ব্রত হবেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
নদীর নাব্যতা
[সম্পাদনা]ফারাক্কা পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙা নদীর (পদ্মা) প্রবাহে চরম বিপর্যয় ঘটে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে প্রায় বাংলাদেশর বর্তমানে প্রায়ই বড় বন্যা সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মাটির লবণাক্ততা
[সম্পাদনা]ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুলনার রুপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবণ, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কৃষি
[সম্পাদনা]কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেচযন্ত্র গুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা সেগুলোর উপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে। এই প্রকল্পের অন্তর্গত প্রায় ১২১,৪১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাটির আর্দ্রতা, লবণাক্ততা, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্বক ক্ষতি করেছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মৎস্য
[সম্পাদনা]পানি অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরন, পানি প্রবাহের বেগ, মোট দ্রবীভূত পদার্থ (Total dissolved solids) এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিষয় গুলো মাছের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গার পানির উপর এই এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
নৌ-পরিবহন
[সম্পাদনা]শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ফলশ্রুতিতে, কয়েক হাজার লোক বেকার হয়ে পড়ে, নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।
ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর
[সম্পাদনা]ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর বেশিরভাগ জায়গায়ই ৩ মিটারের বেশি কমে গেছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তাছাড়া বিভিন্ন দ্রবিভুত পদার্থের, ক্লোরাইড, সালফেট ইত্যাদির ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণেও পানির স্তর কমছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, শিল্প, পানি সরবরাহ ইত্যাদির উপর। মানুষের বাধ্য হয়ে ১২০০ মিলিগ্রাম/লিটার দ্রবিভুত পদার্থ সম্পন্ন পানি পান করছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO = World health organization) ৫০০ মিলিগ্রাম/লিটারের কম দ্রবীভূত পদার্থ সম্পন্ন পানিকেই মানুষের পান করার জন্য উপযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।
ভারতের ক্ষতি
[সম্পাদনা]একচল্লিশ বছর আগে গঙ্গার উপর যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা।সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না-হলেও ফারাক্কার জেরে গঙ্গার উজানে যে পলি পড়া শুরু হয়েছে, তারে জেরে প্রতি বছরই বর্ষার মরশুমে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশ॥ বহুদিন ধরেই মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী দুর্ভোগ ও বিপর্যয়কবলিত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, ভূমি ও পুনর্বাসন দাবি করে আসছে। অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও তারা দাবি জানিয়ে আসছে। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ফারাক্কা বাঁধ বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্য বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে।[৯][১০]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Salman, Salman M. A.; Uprety, Kishor (২০০২)। Conflict and cooperation on South Asia's international rivers: a legal perspective। World Bank Publications। পৃষ্ঠা 135–136। আইএসবিএন 9780821353523। সংগ্রহের তারিখ ২৭ এপ্রিল ২০১১।
- ↑ Bangladesh : a country study। Washington, D.C.: Federal Research Division। ১৯৮৯। পৃষ্ঠা 306। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০১-১০।
- ↑ http://banglapedia.search.com.bd/HT/F_0018.htm
- ↑ "ফারাক্কা বাঁধ ও পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার এর অভিমত"। http://www.bdinfo.online/। ৪ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
|ওয়েবসাইট=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ "ফারাক্কা বাঁধ"। SATT ACADEMY | স্যাট একাডেমি (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-০৪।
- ↑ "৪১ দিনের কথা বলে ৪১ বছর ধরে চালু ফারাক্কা বাঁধ"। ১ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "মাওলানা ভাসানী যেভাবে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন"। ABNEWS24। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-১২।
- ↑ "ফারাক্কা বাঁধ"। bangladesh.webinfopage.com।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "ফারাক্কা বাঁধটাই তুলে দেওয়ার দাবি নীতিশ কুমারের"। বিবিসি বাংলা,।
- ↑ "মরণ বাঁধ ফারাক্কা Copyright Daily Inqilab"। ২৭ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।