শিবচন্দ্র দেব
শিবচন্দ্র দেব | |
---|---|
জন্ম | ২০শে জুলাই, ১৮১১ |
মৃত্যু | ১২ই নভেম্বর, ১৮৯০ |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
পেশা | ডেপুটি কালেক্টর |
শিবচন্দ্র দেব (২০শে জুলাই, ১৮১১-১২ই নভেম্বর, ১৮৯০) নব্যবঙ্গ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন৷ কলকাতার চার ক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গাতীরবর্তী কোন্নগর গ্রামে তার জন্ম হয়৷[১] তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলাস্থিত এই কোন্নগরের প্রভূত উন্নতি করেন৷ তার প্রচেষ্টায় কোন্নগরে রেলওয়ে স্টেশন, পোস্ট অফিস, বাঙলা বিদ্যালয়, ইংরাজী বিদ্যালয়, ডিসপেন্সারী, ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তার স্বলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত থেকে তার সম্পর্কে জানা যায়৷
জন্ম ও পরিবার
[সম্পাদনা]১৮১১ সালের ২০শে জুলাই কোন্নগর গ্রামে শিবচন্দ্র দেবের জন্ম হয়৷[১] তার পিতা ব্রজকিশোর দেব কমিসরিয়েটে সরকারের কাজ করতেন৷ ঐ কাজে সেইসময় যথেষ্ট আয় ছিল৷ সুতরাং ব্রজকিশোর দেব অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ছিলেন৷ বহুকাল সরকারি সরকারী চাকরি করে বৃদ্ধাবস্থায় পেনশন নিয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন৷ সংসারে শৃঙ্খলা, সুবন্দবস্ত ও সকল কাজে সুনিয়মের জন্য তিনি গ্রামের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ তিনি সবসময় নিজের কাছে একটি ঘড়ি রাখতেন এবং তদনুসারে কাজ করতেন৷ তার সমস্ত কাজকর্ম হিন্দুগৃহস্থের আদর্শ স্থানীয় ছিল৷
শিক্ষালাভ
[সম্পাদনা]শিবচন্দ্র দেব ব্রজকিশোর দেবের কনিষ্ঠতম পুত্র৷ প্রথমে তদানীন্তন নিয়মে গ্রাম্য পাঠশালায় তার শিক্ষারম্ভ হয়৷ দশ বছর বয়সে তিনি বাড়িতে বসেই এক আত্মীয়ের সহায়তায় ইংরাজী শিখতে আরম্ভ করেন৷ এগারো বছর বয়সে তার মাতার মৃত্যু হয়৷ এসময় কেউ তার বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে মনোযোগ দেন নি৷ তেরো বছর বয়সে বিশেষত শিবচন্দ্র দেবের আগ্রহে ব্রজকিশোর দেব তাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন৷ ১৮২৫ সালে ১লা আগস্ট চোদ্দ বছর তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন৷ ছয় বছর পাঁচ মাস এখানে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে উঠে ১৬টাকা বৃত্তি পান৷ এইসময় তিনি ডিরোজিওর শিষ্যদলভুক্ত হন ও তার যৌবনসুহৃদগণের সঙ্গে সম্মিলিত হয়৷ সে বন্ধুত্বের স্মৃতি চিরকাল তার হৃদয়ে লেখা ছিল৷ বৃদ্ধবয়সেও ডিরোজিওর সামান্য উক্তিগুলি তার মনে উজ্জ্বল হয়ে ছিল৷
কলেজে পড়ার সময় পরোলোকগত কেশবচন্দ্র সেনের পিতৃব্য হরিমোহন সেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় এবং উভয়ে মিলে আরব্য উপন্যাস বাঙলায় অনুবাদ করেন৷ [২]
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]কলেজের পাঠ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি জি.টি. সার্ভেতে ৩০টাকা বেতনের কম্পিউটারের কাজ করেন৷ ১৮৩৮ সালে তিনি ডেপুটি কালেক্টারের পদে উন্নীত হয়ে বালেশ্বর গমন করেন৷ ১৮৪৪ সালে তিনি বালেশ্বর থেকে মেদিনীপুরে বদলী হন৷ ১৮৫০ সালে কলকাতার সন্নিকটস্থ আলিপুরে তিনি ডেপুটি কালেক্টর হয়ে আসেন৷
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে শিবচন্দ্র দেব একদিন রেলগাড়িতে করে কলকাতায় আসছিলেন৷ সেই গাড়িতে কয়েকজন ইউরোপীয় মিউটিনী সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন৷ শিবচন্দ্র দেব সেখানে স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করেন৷ সেই ইংরাজ ভদ্রলোকগণ কলকাতায় গিয়ে সরকারকে এ বিষয়ে জানান৷ এই সামান্য কারণে সরকার তার থেকে কৈফিয়ত চেয়ে পাঠান৷
এরপর তিনি আরও অনেক পদে উন্নীত হয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে ১৮৬৩ সালে চাকরি থেকে অবসৃত হন৷ অপরাপর লোকের কাছে কর্ম থেকে অবসৃত হওয়ার অর্থ বিশ্রামসুখ ভোগ করা৷ কিন্তু শিবচন্দ্র দেব পেনশন নিয়ে কোন্নগরে এসে বাস করতে থাকেন এবং নিজ গ্রামের উন্নতিতে মনোনিবেশ করেন৷
সমাজসংস্কার
[সম্পাদনা]পূর্ব থেকেই তিনি স্বদেশের উন্নতিতে মনোযোগী ছিলেন৷ কলকাতায় বদলি হয়েই নিজের গ্রামের উন্নতির দিকে তার দৃষ্টি পড়ে৷ ১৮৫২ সালে সমস্ত গ্রামবাসীকে সমবেত করে তিনি কোন্নগরে হিতৈষিণী সভা প্রতিষ্ঠা করেন৷ ১৮৫৪ সালে তারই প্রচেষ্টায় ও তার বন্ধুগণের সহায়তায়কোন্নগরে একটি ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷ ঐ সময় উক্ত গ্রামে লর্ড হার্ডিঞ্জ সময় স্থাপিত একটি বাঙলা বিদ্যালয় ছিল মাত্র৷ ১৮৫৬ সালে ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর সরকার বাঙলা বিদ্যালয়টি তুলে দেন৷ গ্রামে একটি বাঙলা বিদ্যালয় থাকা আব্যশক বোধে ১৮৫৮ সালে শিবচন্দ্র দেবের উদ্দ্যেগে পুনরায় একটি বাঙলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়৷ বিদ্যালয় দুটি স্থাপিত হওয়ার পর তিনি সাধারণের ব্যবহারার্থ একটি পুস্তাকালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে৷ তদনুসারে ১৮৫৮ সালে একটি সাধারণ পুস্তকালয় স্থাপিত হয়৷
অগ্রে কোন্নগরে কোনো রেলওয়ে স্টেশন ছিল না৷ কোন্নগরবাসীকে পূর্বে রেল ধরার জন্য শ্রীরামপুর বা বালী স্টেশনে যেতে হত৷ এতে তাদের অসুবিধা হত৷ এই অসুবিধা দূর করার জন্য শিবচন্দ্র দেব ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নিকট আবেদন জানান কোন্নগরে একটি স্টেশন তৈরীর করার জন্য৷ এর ফলস্বরূপ ১৮৫৬ সালে কোন্নগরে স্টেশন খোলা হয়৷ তার আবেদন অনুসারে ১৮৫৮ সালে কোন্নগরে ডাকঘর স্থাপিত হয়৷
কোন্নগরে ম্যালেরিয়া জ্বর দেখা দিলে তারই প্রযত্নে সরকার একটি চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারী স্থাপন করেন৷ সেজন্য একটি বাড়ি ডিসপেন্সারীর ব্যবহারের জন্য বিনা ভাড়াতে দেন৷ ওই ডিসপেন্সারীর দ্বারা কোন্নগরবাসীর মহোপকার সাধিত হয়েছিল৷ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিঞ্চিত হ্রাস পেলে ১৮৮১ সালে সরকার ওই ঔষধালয়টি তুলে দেন৷ ১৮৮৩ সালে শিবচন্দ্র দেব নিজ খরচায় কোন্নগরে একটি ঔষধালয় স্থাপন করেন৷ এখানে প্রতিদিন সকালে দরিদ্রদের বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ করা হত৷ তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে ছিলেন৷
ব্রাহ্মসমাজ
[সম্পাদনা]শিবচন্দ্র দেবের জীবনচরিত থেকে জানা যায় যৌবনকালে তিনি যখন ডিরোজিওর শিষ্যদলভুক্ত ছিলেন, তখন থেকেই প্রাচীন ধর্মের থেকে তার বিশ্বাস চলে যায় এবং অন্তরে অন্তরে একেশ্বরবাদী হন৷ কিন্তু চাকরি সূত্রে বহুবছর নানাস্থানে ভ্রমণ করার কারণে এই অন্তরের বিশ্বাস অন্তরেই থেকে যায়৷ সেই অনুযায়ী কাজ করার কোনো সুযোগ হয় নি৷ ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ব্রাহ্মসমাজ যোগ দিয়ে একে বলশালী করে তোলে এবং অক্ষয়কুমার দত্ত যোগ্যতার সাথে ''তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'' সম্পাদিত করতে থাকেন, তখন, ১৮৪৪ সালে, তিনি এই পত্রিকার গ্রাহক হয়ে পরমব্রহ্ম চর্চা করতে থাকেন৷ সেইসময় তিনি বালেশ্বর থেকে বদলি হয়ে মেদিনীপুরে ডেপুটি কালেক্টর হয়ে আসেন৷
ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি হওয়ায় ১৮৪৬ সালে তিনি মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন৷ ১৮৫০ সালে কলকাতার সন্নিকটস্থ আলিপুরে যখন ডেপুটি কালেক্টর হয়ে আসেন, তার কিছু পরেই তিনি বিধিপূর্বক ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসাবে যোগ দেন৷ কেবল তাই নয়, তিনি তার স্ত্রী-পুত্রকে ব্রাহ্মধর্মের আশ্রয়ে আনতে ব্যগ্র হন এবং তাতে কৃতকার্য হন৷
১৮৬৩ সালে রাজকার্য থকে অবসৃত হওয়ার পর তিনি নিজ বাসগ্রামে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করতে থাকেন৷ ১৮৬৬ সালে উন্নতিশীল ব্রাহ্মসমাজ আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তিনি তাতে যোগ দেন৷ পরবর্তীকালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হলে তিনি এর নেতৃবর্গের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন৷ বহুবছর তিনি এর সভাপতির কার্য করেছিলেন৷
১৮৭৬ সালে শিবচন্দ্র দেব তার পুত্র সত্যপ্রিয় দেবের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী কালীনাথ বোসের কন্যা শরৎকুমারীর ব্রাম্ভ মতে বিবাহ দেন৷ ইণ্ডিয়ান মিররে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও শালগ্রাম শিলা ব্যতীত ই বিবাহের সংবাদ তৎকালীন সমাজে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়৷ ব্রাহ্ম মতে পুত্রের বিয়ে দেওয়ার জন্য তার আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী তাকে একঘরে করে৷ কিন্তু তাতে তিনি একদিনের জন্যও দুঃখিত হন নি, বা একদিনের জন্যও গ্রামবাসীগের হিতেচ্ছা তার হৃদয় পরিত্যাগ করে নি৷
স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার
[সম্পাদনা]হিন্দুকলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন৷ ১৮২৬ সালে হুগলি জেলার গোপালনগরের বৈদ্যনাথ ঘোষের কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ হওয়ার পর তিনি তার বালিকা পত্নীকে বাংলা লেখাতে ও পড়াতে শুরু করেন৷ প্রৌঢ়াবস্থাতেও তার উৎসাহ মন্দীভূত হয় নি৷ যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই পণ্ডিত নিয়োগ করে নিজ কন্যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন৷ মহাত্মা বেথুন যখন কলকাতায় তার সুবিখ্যাত বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি দলপতিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তার এক কন্যাকে সেখানে ভর্তি করে দেন৷ নিজ বাসগ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি সরকারকে প্রস্তাব দেন৷ যদি বালিকা বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য সরকার থেকে ৫০০ টাকা দেয়, তবে তিনি নিজে আরও ৫০০ টাকা দিতে পারেন এবং বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার মাসিক ৪৫ টাকা দিলে তিনি আরও ১৫ টাকা চাঁদা তুলতে পারেন৷ অনেক লেখালেখির পর সরকার এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন৷
শিবচন্দ্র দেব এতে নিরুদ্যম না হয়ে নিজ চেষ্টায়, নিজ অর্থে, নিজ ভবনে ১৮৬০ সালে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন৷ পরে তারই প্রদত্ত জমিতে বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য গৃহ নির্মাণ করেন৷ শুধু তাই নয়, ১৮৬২ সালে শিক্ষিত নারীদের ব্যবহারের জন্য শিশুপালন নামে গ্রন্থ রচনা করেন৷ পরে ১৮৬৭ সালে আধ্যাত্মবিজ্ঞান নামে প্রেততত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন৷
জীবনাবসান
[সম্পাদনা]জীবনের অবসানকালে তিনি কলকাতায় বন্ধুবান্ধবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এখানে ১৮৯০ সালে ১২ই নভেম্বর তার দেহান্তর ঘটে৷ তিনি সকলের কাছে সদাশয়তা, মিতচারিতা, পরহিতৈষণা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ধর্মভীরুতার আদর্শস্বরূপ ছিলেন৷
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- Ramtanu Lahiri O Tatkalin Banga Samaj in Bengali by Sivanath Sastri
- Sansad Bangali Charitabhidhan (Biographical dictionary) in Bengali edited by Subodh Chandra Sengupta and Anjali Bose