বিষয়বস্তুতে চলুন

মুরং

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ম্রো থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মুরং/ ম্রো
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর বাস মিয়ানামারের রাখাইন প্রদেশে। বাংলাদেশে ম্রো জনগোষ্ঠীর বাস মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে, বান্দরবান জেলা ও রাঙ্গামাটি জেলায়। ভারতে পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা জেলায়।
 মিয়ানমার৪০,০০০[]
 বাংলাদেশ৯০,০০০-১,০০,০০০[]
 ভারত২০,০০০[]
ভাষা
ম্রো (Dialects: Anok, Dowpreng, Sungma)[]
বাংলা
ধর্ম
সর্বপ্রাণবাদ, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম[] এবং হিন্দুধর্ম

মুরং বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। মুরুং শব্দটি বহুবচন যার একবচন হল ‘ম্রো’। ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ, মানব জাতি, মানব সত্ত্বা। ম্রো ভাষায় ‘ম্রো’রা নিজেদের ‘ম্রোচ্য’ বলে থাকে। মুরুংদের ভাষা মৌখিক, বর্তমানে ‘ম্রোচ চা’ বা ম্রো বর্ণমালা আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের নিজস্ব লিখিত ভাষা রয়েছে।

আদি ইতিহাস

[সম্পাদনা]

ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিসত্বা। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্য। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ম্রোরা মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী হলেও অধিকাংশই 'বৌদ্ধ' ধর্মাবলম্বী এবং 'খিস্টান' ধর্ম পালন করে। তবে কয়েক বছর আগে ম্রোদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ আর্বিভাবের ফলে বর্তমানে ম্রোদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরং উপজাতিরা আরকান থেকে পালিয়ে আলীকদমের বিভিন্ন পাহাড়ী উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে বার্মার আকিয়াব জেলায় এখনো মুরং উপজাতীয় বসতি বিদ্যমান বলে জানা যায়।

বর্তমান অবস্থান

[সম্পাদনা]
মুরং জনগোষ্ঠী মানুষের জনসংখার ঘনত্ব (পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ)

মুরং নৃগোষ্ঠীদের নিবাস বান্দরবান জেলাতে সর্বাধিক। তাছাড়া রাঙ্গামাটি জেলাতেও মুরং জনগোষ্ঠীদের নিবাস রয়েছে। তবে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় মুরংদের নিবাস সর্বাধিক। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে দেড় কি.মিটার দুরে চিওনী পাড়া ও আমতলী এলাকায় এ সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পাড়া রয়েছে। তাছাড়া প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকা তৈন মৌজা, মাংগু মৌজা, চ্যৈং মৌজা, চাইম্প্রা মৌজা, তৈনফা মৌজা এবং তৈন খাল এলাকা ও মাতামুহুরী সন্নিহিত পাহাড়ী এলাকায় তাদের বসতি রয়েছে। তবে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী ও পাহাড়ে তাদের বসবাস উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে। মুরং সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। মুরংদের একটি অংশ আলীকদমের প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় তাদের ‘‘কিম’’ ঘর তৈরী করে বসতি স্থাপন করেন। মুরংরা তাদের ঘরে জীব জন্তুর মাথা ঝুলিয়ে রেখে থাকে। মুরংদের মধ্যে কয়েকটি গোত্র রয়েছে; এর মধ্যে-

  • ঙারুয়া
  • প্রেন্জু
  • সাংকান
  • জালা
  • কানবক
  • নাইজাহ
  • তাং
  • দেং
  • রুমওয়া
  • উইয়াচা
  • দেং
  • রেংতিং

প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক পাড়ায় তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজনকে ‘কারবারি’ নিযুক্ত করা হয়। মুরং নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী বলে এদের স্বাস্থ্য সুঠাম। মেয়েরাও পুরুষের পাশাপাশি পাহাড়ী জুমচাষে সমান পারদর্শী।

পোশাক

[সম্পাদনা]

মুরংরা অত্যন্ত স্বল্পবসন পরিধান করে (তবে বর্তমানে ব্যবহার নেই)। মেয়েরা ‘ওয়ানক্লাই’ নামে একধরনের ছোট পরিধেয় ব্যবহার করে। যা নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর উপরিভাগ পর্যন্ত পড়ে থাকে। এটি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়ামাত্র। মেয়েরা পায়ে “খক খ্যান” (নুপুর) কোমরে ‘‘রোওয়া কম” (বিছা) পড়ে থাকে। পুরুষগণ ‘ডং’ (লেংটি-বিদ্রি) নামে একধরনের কিঞ্চিতকর বস্ত্র পরিধান করে। মুরুং মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখে। নারী-পুরুষরা মাথায় অধিকন্তু “ছুরুত” (চিরুনী) গেঁথে রাখতে দেখা যায়। মুরুং মেয়েরা মাথায় কানে ও খোঁপায় বিভিন্ন ধরনের “পাও” (পাহাড়ী ফুল) গুজে রাখে। ছেলেরাও মাথার চুলকে খোপা আকারে বেঁধে রাখে। মুরংরা দাঁতের মধ্যে এক ধরনের রংয়ের প্রলেপ দিয়ে থাকে। লোহাকে উত্তপ্ত করে কাঁচা বাঁশের সাথে লাগিয়ে নির্গত রসকে দাঁতে লাগিয়ে দেয়। মুরুং সম্প্রদায়ের ছেলে একই গোত্রের কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেনা। মুরুং সমাজে তিন পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী মুরুং ছেলে কন্যার দেহের মূল্য বাবদ রৌপ্য মুদ্রায় ১০১/= টাকা, মায়ের দুধের দাম বাবদ ১০/= টাকা প্রদান করতে হয়। এসব রৌপ্য টাকা অবশ্য পরিশোধনীয় বলে গণ্য করা হয়। একই গোত্রের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিবাহ নিষিদ্ধ। মুরুং দম্পতির মধ্যেও মনের মিল না থাকলে তালাক প্রথা বিদ্যমান রয়েছে।

সংস্কৃতি

[সম্পাদনা]
মুরং উপজাতিদের গো-বলি উৎসব।

মুরুং নৃত্যের মধ্যে ছেলে মেয়েরা গালে, ঠোঁটে ও কপালে রংয়ের প্রলেপ লাগায়। নৃত্যের আগে ১৫ থেকে ২০ জন মুরুং যুবক-যুবতী মুখোমুখী দাড়িয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি রচনা করে। এরপর তাদের তৈরী বাঁশির সুর ও বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশ করে থাকে। নাচে ও গানে বিবাহিত মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়না। মুরুং সম্প্রদায় নিজেরাই ‘‘প্লুং” নামের একটি বাঁশি তৈরী করে। পাহাড়ে উৎপন্ন ‘‘বুদুম’’ (এক ধরনের পাহাড়ী লাউ) এর শুকনো খোলের সাথে ৫/৬ বা ততোধিক “কাও” (বাঁশের কঞ্চি) এর টুকরা দিয়ে এ বাঁশীটি তৈরী করা হয়।

রীতিনীতি

[সম্পাদনা]
মুরং নারীদের চিয়া-চট-প্লাই নৃত্যের ভিডিওচিত্র

মুরুং সম্প্রদায় মূলতঃ প্রকৃতি পুজারী। তারা ইহকালকেই স্বর্বস্ব জ্ঞান করেন। তাঁরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। মুরুংদের ধর্মীয় বিধি নিষেধ সংবলিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। মুরংদের ধর্মবিশ্বাসে আকীর্ণ প্রধান উৎসবের নাম হলো “চিয়া-ছট-প্লাই” অর্থাৎ গো-হত্যা উৎসব। গো-হত্যাকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসাবেই পালন করা হয়। প্রতিবছর জুমের ফসল ঘরে তোলার আগে মুরুং সম্প্রদায় মহাধুমধামের সাথে এ উৎসব করে। এছাড়া এ সম্প্রদায়ের পরিবারে কারো অসুখ বিসুখ হলে তারা রোগ বালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘চিয়া-চট-প্লাই’ পালনের মানত করে থাকন। তারা “চাম্পুয়া” নামের অপর একটি উৎসব পালন করে থাকে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ধর্মীয় বিধান কলাপাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল বিশ্বাসে তারা কলাপাতা কেটে এ উৎসব করে থাকে। এ সম্প্রদায়ের অনেকে আবার ‘‘ক্রামা’’ নামের অপর একটি ধর্ম মতেও বিশ্বাস করে থাকে। মৃত ব্যক্তির পাশে শুকর, ছাগলমোরগ জবাই করে পরিবেশন করা হয়। মৃতকে নদী তীরবর্তী চিতায় দাহ করার আগ পর্যন্ত গান বাজনা ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে উল্লাস করা হয়।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. 1 2 3 Hattaway, Paul (২০০৪)। Peoples of the Buddhist World: A Christian Prayer Diary (পিডিএফ)। Pasadena, CA: William Carrey Library। পৃ. ১৯৫। আইএসবিএন ৯৭৮০৮৭৮০৮৩৬১৯[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. Lewis, Simons, and Fennig, M. Paul, Gary F. and Charles D.। "Ethnologue: Languages of the World"। SIL International। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১৪{{ওয়েব উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (লিঙ্ক)
  3. "Conversion of Jumma people to Islam in CHT–1 – Hill Voice"। ৩ আগস্ট ২০২২। ৩ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত।