বড়চতুল ইউনিয়ন

স্থানাঙ্ক: ২৫°১′২৬.০০০″ উত্তর ৯২°১১′৩৫.৯৯৯″ পূর্ব / ২৫.০২৩৮৮৮৮৯° উত্তর ৯২.১৯৩৩৩৩০৬° পূর্ব / 25.02388889; 92.19333306
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বড় চতুল ইউনিয়ন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বড়চতুল
ইউনিয়ন
৫নং বড়চতুল ইউনিয়ন পরিষদ
বড়চতুল সিলেট বিভাগ-এ অবস্থিত
বড়চতুল
বড়চতুল
বড়চতুল বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
বড়চতুল
বড়চতুল
বাংলাদেশে বড়চতুল ইউনিয়নের অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৫°১′২৬.০০০″ উত্তর ৯২°১১′৩৫.৯৯৯″ পূর্ব / ২৫.০২৩৮৮৮৮৯° উত্তর ৯২.১৯৩৩৩৩০৬° পূর্ব / 25.02388889; 92.19333306 উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
দেশবাংলাদেশ
বিভাগসিলেট বিভাগ
জেলাসিলেট জেলা
উপজেলাকানাইঘাট উপজেলা উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
আয়তন
 • মোট৪,৬২০ হেক্টর (১১,৪১৭ একর)
জনসংখ্যা
 • মোট২৩,৩৫৭
 • জনঘনত্ব৫১০/বর্গকিমি (১,৩০০/বর্গমাইল)
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
প্রশাসনিক
বিভাগের কোড
৬০ ৯১ ৫৯ ১৩
ওয়েবসাইটদাপ্তরিক ওয়েবসাইট উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
মানচিত্র
মানচিত্র

বড়চতুল ইউনিয়ন বাংলাদেশের সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট উপজেলার একটি ইউনিয়ন।[১]

অবস্থান[সম্পাদনা]

কানাইঘাট উপজেলা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে মেইন রোডে ১৪ কি মি দূরে অবস্থিত। পূর্বে কানাইঘাট,পশ্চিমে দরবস্থ ইউনিয়ন পরিষদ, উত্তরে চারিকাটা ইউনিয়ন, দক্ষিণে দক্ষিণ বানীগ্রাম ইউনিয়ন।

উক্ত ইউনিয়নে ওয়ার্ড সংখ্যা রয়েছে ৯ টি ।

বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক চৌধুরী

যোগাযোগ ব্যাবস্থা

অবস্থান কানাইঘাট উপজেলা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে মেইন রোডে ১৪ কি মি দূরে অবস্থিত। .

সিলেট-তামাবিল মহা সড়ক হয়ে দরবস্ত বাজার থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্তিত উক্ত ইউনিয়ন।

সড়ক পথই উক্ত ইউনিয়নের মানুষের প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম।

আয়তন ও জনসংখ্যা[সম্পাদনা]

আয়তন- ১৬.৭২ বর্গ কি মি। মোট জনসংখ্যা- ৩১৫২৬ জন পুরুষ-১৬৫৩৭ জন, মহিলা- ১৪৯৮৯ জন।

শিক্ষা[সম্পাদনা]

শিক্ষার হার- ৬০%

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

  • নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা- ১৬টি।
  • প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা- সরকারী ১১টি এবং বেসরকারী ৩টি ,কমিউনিটি ১টি।
  • মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা -বেসরকারী ২টি।
  • কলেজের সংখ্যা বেসরকারী ১টি।
  • টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ বেসরকারি ১ টি
  • মাদ্রাসার সংখ্যা-আলিয়া নাই, কওমি ৮টি
  • ধর্মীয় প্রতিষ্টানের সংখ্যা-মসজিদ ৫১টি মন্দির ২টি।
  • মহিলা মাদ্রাসা ৫ টি

গ্রাম[সম্পাদনা]

গ্রামের সংখ্যাঃ- ৩০টি। হারাতৈল কাজির পাতন, হারাতৈল বাগর আগন, হারাতৈল উপর বড়াই, মাজবড়াই, হারাতৈল কাদিরগ্রাম, রাঙ্গারাই,হারাতৈল বেতু, আগফৌদ, দুর্গাপুর আগফৌদ, দুর্গাপুর মল্লিফৌদ, রাউৎ গ্রাম,ইন্দ্রকোনা, সরুফৌদ,জাইমরা, নয়াগ্রাম, মুক্তাপুর, দলকিরাই, পর্বতপুর, রতনপুর, ভাটিপাড়া, ডুংরা, নয়াফৌদ, রায়পুর, মালিগ্রাম, বড়চতুল, কুড়ারপার, সোনাতুলা, লখাইর গ্রাম, বাল্লা,ডুংরা>নয়াপাড়া।

হাট-বাজার[সম্পাদনা]

চতুল বাজার, চতুল ঈদগাহ বাজার, মালীগ্রাম বাজার।

খাল ও নদী[সম্পাদনা]

খাল ৬ টি- নাপিতখাল,কুরি খাল, বল্লী খাল, জুনাইর খাল, সড়কের খাল,বাঘা খাল। নদী ২টি- হিংগাইর নদী, ঈশাবা নদী।

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব[সম্পাদনা]

বর্তমান চেয়ারম্যান- আব্দুল মালিক চৌধুরী

মহান মুক্তি যুদ্ধে উক্ত ইউনিয়নের অবদান[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের মহান মুক্তি যুদ্ধে উক্ত ইউনিয়নের অবদান অনস্বীকার্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন

মুক্তিযুদ্ধকালের অন্যতম স্মরণীয় যুদ্ধ হলো কানাইঘাটের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। কানাইঘাট সিলেট জেলার একটি থানা। জেলার পূর্বাঞ্চলীয় ভূ-ভাগে ৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। কানাইঘাট থানা সদরটি জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত। মেঘালয় সীমান্তের নিকটবর্তী এই থানাটি অবস্থানগত কারণে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী—উভয় পক্ষের কাছেই সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের মধ্যভাগ। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে সম্মুখ অবস্থানের ডিফেন্স লাইন ছিল কানাইঘাটে। কেননা ইতিমধ্যে জকিগঞ্জ, আটগ্রাম স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কানাইঘাটের ডিফেন্স ছিল অত্যন্ত চমৎকার। এখানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি, পশ্চিম পাকিস্তানি স্কাউটস দলের এক প্লাটুন মিলিশিয়া এবং বেশ কিছু রাজাকার। তাদের সহযোগিতা করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি ব্যাটারি। একই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী দরবস্ত চতুল ইউনিয়নের পশ্চিম পাশের ইউনিয়নের এলাকাতেও শক্তিশালী ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল, যা ছিল তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষের একটি অগ্রবর্তী অবস্থান। যেহেতু কানাইঘাট-দরবস্তের সঙ্গে সংযোগকারী একটি সড়ক ছিল, তাই মুক্তিবাহিনী কিংবা যৌথবাহিনীর জন্য এই দুটি স্থান দখল করে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা, সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হতে হলে এই পথ ধরেই তাদের এগিয়ে যেতে হবে।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত। যুদ্ধের বাস্তব প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত এবং যথেষ্ট পরিণত। এ সময়ে মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর সরাসরি সাহায্য-সহযোগিতায় যথেষ্ট সংহত আর শক্তিশালী। তারা দেশের মুক্তির জন্য তখন মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় কনভেনশনাল যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে জনযুদ্ধের বিস্ফোরণে পাকিস্তান সরকারও এ সময় যুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ দিতে চাইছিল। এ ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক শক্তি সীমান্ত এলাকায় তাদের শক্তি বাড়াতে থাকে। এই সময় পাকিস্তানিরা সিলেট জেলায় এক ব্রিগেড সেনা মোতায়েন করেছিল। সিলেট শহরের প্রতিরক্ষার জন্য সীমান্ত থেকে সিলেট অঞ্চলে প্রবেশের পথগুলোতেই মূলত ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল। সিলেট দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী কিংবা যৌথবাহিনীর কাছে কানাইঘাটের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম দখলের পর কানাইঘাট দখল করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। আর কানাইঘাটে পাকিস্তানিরা এ সময় অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। সত্যিকার অর্থেই ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি সাহসী গৌরবময় সফল অভিযান ছিল কানাইঘাট দখলের অভিযানটি।

৪ নম্বর সেক্টরের উত্তর দিক থেকে সিলেটের পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা দিয়ে সিলেট শহর অভিমুখে তিনটি প্রবেশপথ ছিল। যেমন কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট-সিলেট অক্ষ, তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষ এবং আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষ। তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট এবং আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট—এই দুটি অক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে কানাইঘাট একটি থানা হেডকোয়ার্টার এবং কৌশলগতভাবে স্থানটি একটি ডোমিনেটিং গ্রাউন্ড। দরবস্ত থেকে শহীদবাগ পর্যন্ত প্রসারিত একটি সংযোগকারী রাস্তার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী অক্ষ দুটির ওপর ডোমিনেট করা সম্ভব ছিল। কানাইঘাট এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য সমতল এলাকার মতোই সমতল ও উন্মুক্ত। কানাইঘাটের চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম, যেমন গৌরীপুর, বড় চাতলা, ডালিয়ারচর প্রভৃতি। এর চারপাশেই ছিল ধানখেত, পুকুর, জলাশয় ইত্যাদি। কানাইঘাটের উত্তর-পূর্বে ছিল আন্দল বিল নামে ছোট একটি বিল বা হ্রদও।

যৌথবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড, ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি সিলেট দখল করবে। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম ব্রিগেড জেড ফোর্স তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান [পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি] সিলেট অভিমুখে চূড়ান্ত অভিযানকালে তাঁর ব্রিগেডের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষ ধরে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেন। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের জালালপুর (আটগ্রামের বিপরীতে এর অবস্থান) থেকে তার অভিযান শুরু করে। তারা আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করার পর এই রেজিমেন্টের প্রথম কাজ দাঁড়ায় জকিগঞ্জ দখল করা। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অভিযানের অংশ হিসেবে পথিমধ্যে অবস্থিত জকিগঞ্জের পাকিস্তানি অবস্থানটি আয়ত্তে নেওয়াটা ছিল জরুরি। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। অতঃপর তারা আবারও চারগ্রামে আগের অক্ষে ফিরে আসে। এখানে রেজিমেন্টটি পুনরায় সংগঠিত হয়ে কানাইঘাট দখলপূর্বক সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রাম-কানাইঘাট-চরখাই-সিলেট অক্ষ বরাবর অগ্রসর হতে থাকে। তারা সুরমা নদীর উত্তর তীর ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। ২২ নভেম্বর তারা গৌরীপুরে পৌঁছায়, যা কানাইঘাট থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে অবস্থিত।

কানাইঘাটে পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ডিফেন্স থাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গৌরীপুরে গতি থামিয়ে দেয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নটির আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে মোতায়েন করা হয়। চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে মোতায়েন করা হয়। ইতিমধ্যে সর্বশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে (সি আর দত্ত বীর উত্তম। পরে মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক) তাঁর বাহিনী নিয়ে কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করার অনুরোধ করেন, যাতে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল নির্বিঘ্নে তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।

এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এ কারণে যে, সিলেট শহরের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের শক্তি-সামর্থ্য যেন পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে। ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং মিশন সফল করার জন্য পূর্ণ মনোযোগ দেন। ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল মূলত সাবেক ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বাহিনীর সেনাদের নিয়ে। তাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ কিছু বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ সদস্য যোগ দিয়েছিল। আর ছিল বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতার সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। সেক্টরের অধিনায়ক মেজর সি আর দত্ত মাত্র ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিজের অধীনে রেখেছিলেন। তিনি সবচেয়ে সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুর রবকে (পরে মেজর জেনারেল) এই চার কোম্পানি সেনা নিয়ে কানাইঘাট দখল করার আদেশ দেন। এই অপারেশনের জন্য অন্য কোম্পানি কমান্ডাররা ছিলেন লেফটেন্যান্ট জহির, লেফটেন্যান্ট গিয়াস (এ জেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ। পরে মেজর ও ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) এবং সুবেদার আবদুল মতিন চৌধুরী। তাঁদের সবাই ছিলেন সাহসী, প্রতিশ্রুতিশীল মুক্তিযোদ্ধা সেনা।

যেহেতু কানাইঘাটে পাকিস্তানিদের এক কোম্পানিরও অধিক শক্তি নিয়োজিত ছিল এবং এখানে তারা একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তাই কানাইঘাট দখলের অভিযানকে সফল করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। অপারেশন এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার পর দেখা গেল, দরবস্ত ও চরখাইতেও পাকিস্তানিরা ব্যাপক শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে ডিফেন্স তৈরি করে বসে আছে। কানাইঘাটের ওপর আক্রমণ করার সময় যাতে দরবস্ত কিংবা চরখাই থেকে কোনো রকম রিইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে, যাতে নির্বিঘ্নে কানাইঘাটে পাকিস্তানিদের ওপর ধ্বংসক্রিয়া চালানো যায়, সে জন্য এই মর্মে একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয় যে লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে মোতায়েন রাখা হবে। এই দুটি কোম্পানিকে মূলত উপরিউক্ত রাস্তা দুটির ওপর ব্লকিং পজিশন তৈরি করে রিইনফোর্সমেন্ট প্রতিহত করার আদেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে কানাইঘাট থেকে পাকিস্তানিরা যাতে পশ্চাদপসরণ করতে না পারে, সে দিকটিও তারা দেখবে। বাকি দুটো কোম্পানি ক্যাপ্টেন আবদুর রবের নেতৃত্বে সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণ করবে। যেহেতু সুরমার দক্ষিণে কানাইঘাটের সম্মুখ অবস্থানে পাকিস্তানিরা প্রচুর মাইন পুঁতে রেখেছিল, তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে গোয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া যায়, পাকিস্তানিরা প্রাকৃতিক আর নিজেদের তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার সাহায্য নিয়ে, আর্টিলারির আক্রমণ সহযোগে তাদের অবস্থান দৃঢ়তার সঙ্গেই ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। একান্তই যদি অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব না হয়, তখনই কেবল তারা তাদের পরবর্তী ডিফেন্সিভ অবস্থানে পশ্চাদপসরণ করবে।

২২ নভেম্বর যখন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গৌরীপুরে পৌঁছায়, তখন ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তাদের ডিফেন্সিভ পজিশন ছেড়ে পূর্ণ শক্তিতে গৌরীপুরে অগ্রসর হয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্মুখভাগের দুটি কোম্পানিকে বেষ্টন করে ফেলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই কোম্পানিটি কানাইঘাটে ছিল। আর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ওই দুই কোম্পানির (চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি) মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদীর উত্তর তীরে মোতায়েন ছিল। ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানিরা প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা একই সঙ্গে সুরমা নদীর দক্ষিণে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল) আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ওপরও আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর বি জি পাটোয়ারী (বজলুল গনি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক, পরে কর্নেল) জানান, তাঁর সর্ব দক্ষিণের প্লাটুনটি পাকিস্তানিদের হাতে বিধ্বস্ত। পাকিস্তানিরা ডেলটা কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে এবং কোম্পানির কেন্দ্রীয় প্লাটুনটিকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আক্রমণের সময় পাকিস্তানিরা হুমকি-ধমকিসহ মুক্তিবাহিনীকে বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বানও জানাতে থাকে।

নাজুক অবস্থা উপলব্ধি করে ডেলটা কোম্পানির মাঝখানের প্লাটুনটির কমান্ডার সুবেদার মুসা তাঁর ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কমান্ডার এবং অন্য উপদলগুলোর (প্লাটুন) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যান। সুবেদার মুসার বাম পাশে ছিল আমার নেতৃত্বাধীন প্লাটুনটির অবস্থান। নাজুক ওই পরিস্থিতিতে মুসা আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। তিনি যুদ্ধের সার্বিক অবস্থা আমার কাছে তুলে ধরেন। তিনি জানান, তাঁর পক্ষে আর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর এই বক্তব্য শুনে আমি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যেভাবেই হোক নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার পরামর্শ দিই। আমি তাঁকে আরও নির্দেশ দিই, যদি তা করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাঁরা যেন পাশের পুকুরপাড়ের নিচে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই অবস্থান করেন। আমি রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে আসছি।

তারপর আমি ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের দুটি মেশিনগান গ্রুপ, ছয়টি এলএমজি গ্রুপ পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে একযোগে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। এর ফলে পাকিস্তানিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে এবং আমাদের ফায়ারিং সাপোর্ট নিয়ে আমি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি অবস্থানের দিকে সুকৌশলে অগ্রসর হতে থাকি। আমার সহযোদ্ধা ছিলেন প্রায় ৩০ জন। তাঁদের নিয়ে ক্রল করে দ্রুত পাকিস্তানিদের একেবারে নাকের ডগায়, অর্থাৎ ৫০ গজের মধ্যে চলে যাই। আমাদের দেখে পাকিস্তানি সেনারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিল তাদের আকস্মিক আক্রমণে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পালিয়ে যাব।

পাকিস্তানিরা আমাদের পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। তারপর দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ ধরনের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমার অধীন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনাদের বিরুদ্ধে বিপুল সাহসিকতা ও অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। পাকিস্তানিরাও মরণপণ লড়াই করতে থাকে। এই যুদ্ধের দৃশ্য লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। একপর্যায়ে ক্লোজ কোয়ার্টার কম্ব্যাট বা হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধ চলে প্রায় এক ঘণ্টার মতো। আমাদের সাহসিকতা ও অদম্য মনোবলের মুখে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি সেনারা ফায়ারিং সাপোর্ট অব্যাহত রেখে ক্রমে পেছনে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণের গতি আরও বাড়িয়ে দিই। আমার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।

আমার এই পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সারওয়ারসহ ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ২৬ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করতে সক্ষম হই। আমাদের পক্ষে (আমার ও সুবেদার মুসার দল মিলে) হতাহতের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। এই পাল্টা আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনারা এতই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে যে, তারা পরে আর কোথাও শক্তভাবে অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় বিনা বাধায় খুব সহজেই কানাইঘাট দখল করে নেয়। এই বিজয় সম্বন্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম। পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং ১৯৭৪ সালে চাকরিচ্যুত) বলেন, এই যুদ্ধ ছিল একটি কৌশলগত বিজয়।

এই যুদ্ধে অসাধারণ নৈপুণ্য আর বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী সময়ে আমাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে। মুক্তিবাহিনীর এই ছোট সাহসী দলটির পাল্টা আক্রমণ সাফল্যের মুখ দেখলেও বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়। এরা কানাইঘাটে গিয়ে তাদের ডিফেন্সিভ পজিশনে পুনরায় যোগ দেয়।

মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই অপারেশনটি ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করে। তাঁরা কানাইঘাটের পাকিস্তানিদের বিধ্বস্ত করতে বদ্ধপরিকর হন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাট আক্রমণ করেন। ক্যাপ্টেন আবদুর রব কানাইঘাট থেকে পাঁচ মাইল দূরের লুবাছড়া চা-বাগান এলাকায় তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোকে সমবেত করেন। ২৬ নভেম্বরের রাতে তিনি এখানে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পরদিন রাতে এই মুক্তিযোদ্ধারা বড় চাতলাপুর গ্রামের দিকে মার্চ করেন। তাঁরা এখানে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডের ওপর একটি ব্লকিং পজিশন তৈরি করেন, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর যেকোনো রকম চলাচল প্রতিহত করা যায়। এই গ্রামে তাঁরা সম্মুখভাগ ও পশ্চাদ্ভাগ দুদিকেই মুখ করে ডিফেন্সিভ পজিশন তৈরি করেন, যাতে কানাইঘাটে কোনো রকম রিইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে, সেই সঙ্গে কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিরাও যেন পালাতে না পারে।

ক্যাপ্টেন আবদুর রবের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের এই মিশনটি ছিল কঠিন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর ব্লকিং পজিশনটি বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ১০৫ মিমি কামানের মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানিদের প্রবল আক্রমণের মধ্যে ক্যাপ্টেন রবের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অবস্থান ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়লেও তাঁরা ওভারহেড প্রোটেকশনের কারণে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান ধরে রাখেন এবং দরবস্ত-কানাইঘাট রোডের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।

১ ডিসেম্বর জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান তাঁর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সদস্যদের অগ্রসর হওয়ার স্বার্থে ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কানাইঘাট দখলের জন্য আবারও অনুরোধ বার্তা পাঠান। সেদিন বিকেল পাঁচটায় ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ক্যাপ্টেন আবদুর রবকে পরদিন ভোরেই কানাইঘাট আক্রমণের আদেশ দেন। ক্যাপ্টেন আবদুর রব মেজর চিত্তরঞ্জনকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধারা তিন রাত ধরে নিঘু‌র্ম অবস্থায় রয়েছেন এবং তাঁরা প্রচণ্ড রকমের ক্লান্ত। এ ছাড়া এই কয়েক দিনের যুদ্ধের ফলে গোলাবারুদও কিছুটা কমে গিয়েছিল। এই ঘাটতি পূরণ করাটাও জরুরি। ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক চিত্তরঞ্জন দত্ত ক্যাপ্টেন রবের পরামর্শ উপেক্ষা করেন। তিনি যেটুকু শক্তি-সামর্থ্য রয়েছে, তা নিয়েই কানাইঘাট দখলের জন্য ক্যাপ্টেন আবদুর রবকে নির্দেশ দেন।

বহুবিধ সমস্যা সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন আবদুর রব ১ ডিসেম্বর বেলা দুইটার দিকে কানাইঘাট দখলের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করেন। ওই দিন দিবাগত রাত দুইটার দিকে তাঁরা পূর্বপরিকল্পিত সমাবেশস্থলে পৌঁছান। ভোর সাড়ে তিনটার (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২ ডিসেম্বর) দিকে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সড়কের ওপর পাকিস্তানিদের একটি স্ট্যান্ডিং টহল দলের প্রতি-আক্রমণ সামলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ৫০০ গজের ভেতরে পৌঁছে যান। অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল দল তাদের ফর্মিং-আপ প্লেসে (এফইউপি) পৌঁছে যায়। জায়গাটি ছিল বেশ নিচু ধরনের। এফইউপিতে পৌঁছেই মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রব উপলব্ধি করেন, যদি দিনের আলোতে তাঁরা পাকিস্তানিদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষায় আঘাত করেন, তাহলে তাঁদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে।

এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন রব আবারও মেজর সি আর দত্তের কাছে সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। মেজর দত্ত তার পরও আক্রমণ শুরু করতে বলেন। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হন। এফইউপির অসুবিধার দিকগুলো বিবেচনা করে ক্যাপ্টেন রবকে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন রব সহযোদ্ধাদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে এসে তাঁদের এক দিনের পূর্ণ বিশ্রাম দেন। যুদ্ধের অব্যাহত চাপ মুক্তিবাহিনীর এই দলের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সত্যিই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল এবং যুদ্ধের স্পৃহায় দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছিল। এক দিনের পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে ক্যাপ্টেন আবদুর রবের অধীন মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের জন্য পুনঃপ্রস্ত্তত হয়ে ওঠেন। মানসিক শৈথিল্যও কেটে যায়। তাঁরা কানাইঘাট দখলের জন্য আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হন।

৩ ডিসেম্বর রাত আটটার দিকে ক্যাপ্টেন আবদুর রব দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কানাইঘাট দখলের উদ্দেশ্যে পুনরায় অভিযান শুরু করেন। একই সময়ে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গিয়াস ও লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বাধীন কোম্পানি দুটিও দরবস্ত-কানাইঘাট এবং চরখাই-কানাইঘাট রোডের ওপর ব্লকিং পজিশন তৈরি করার জন্য অগ্রসর হয়। ৩ ডিসেম্বরের দিবাগত রাত দেড়টার দিকে লেফটেন্যান্ট গিয়াসের অবস্থানটি পাকিস্তানিরা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় এবং দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সম্ভবত একটি কালভার্টের পাশে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের একটি স্ট্যান্ডিং টহল দলের সঙ্গে গিয়াসের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই বাধে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হন। তার পরও তাঁরা যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। একই সময়ে লেফটেন্যান্ট জহিরের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানও পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরে আক্রমণ করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ বেধে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাত চারটার মধ্যে গিয়াস তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভালোভাবেই তাঁর ব্লকিং পজিশন তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট জহিরের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি পাকিস্তানিদের মর্টার ও মেশিনগানের ফায়ারের সামনে ব্যাহত হয়। এই দলের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অ্যামুনিশনের পরিমাণও কমে যায়।

ইতিমধ্যে ৪ ডিসেম্বর ভোর চারটার দিকে ক্যাপ্টেন আবদুর রব অপর দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফর্মিং আপ প্লেসে পৌঁছান। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ফর্মিং আপ প্লেসের অবস্থান প্রথম অবস্থায় নির্ণয় করতে পারেনি। তবে খানিকটা সময় পর পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ফর্মিং আপ প্লেস কোথায় বুঝে ফেলে প্রচণ্ড রকম আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। তবে পাকিস্তানিদের অব্যাহত আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখগতিকে থামিয়ে দিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারাও তিন ইঞ্চি মর্টারের ফায়ারিংয়ের কভার নিয়ে পাকিস্তানিদের অবস্থানের বেশ কাছে পৌঁছে যান। অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং আক্রমণ শুরু করার আগে তাঁদের বাড়তি গোলাবারুদেরও প্রয়োজন হয়।

এ অবস্থায় লেফটেন্যান্ট গিয়াস ও লেফটেন্যান্ট জহিরকে তাঁদের ব্লকিং পজিশন থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে গোলাবারুদ নিয়ে ক্যাপ্টেন রবের সঙ্গে যোগ দিতে বলা হয়। নির্দেশ মোতাবেক লেফটেন্যান্ট গিয়াস ও লেফটেন্যান্ট জহির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন রবের সঙ্গে যোগ দিয়ে কানাইঘাট আক্রমণে শরিক হন। ৪ ডিসেম্বর ভোরবেলায় পাকিস্তানিদের কানাইঘাটের অবস্থানকে দুই প্রান্ত থেকে বেষ্টন করে ফেলা হয়। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পাকিস্তানিদের অবস্থানে সর্বাত্মকভাবে ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এদিন দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা বিরতিহীনভাবে পাকিস্তানিদের বাংকারগুলোতে আঘাত হানতে থাকেন। উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সম্মুখবর্তী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কিছু সেনা তাদের হেডকোয়ার্টারের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। কানাইঘাটে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড বিস্ফোরণ, রাইফেলের গুলি কিংবা ট্রেঞ্চের মধ্যে বেয়নেট চার্জে মৃত্যুবরণ করে। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ধরে টানা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানিদের ডিফেন্স বিধ্বস্ত হয়।

মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২০ জন আহত হন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের পক্ষে ৫০ জন নিহত, ২০ জন আহত হয় এবং ২৫ জন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে কানাইঘাট মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেলে জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের পক্ষে নির্বিঘ্নে সিলেটের দিকে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়। কানাইঘাটের পতনের পর পাকিস্তানি সেনাদের চরখাই ও দরবস্তের দিকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়েছে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ৬ ডিসেম্বর দরবস্ত শত্রুমুক্ত করে জেড ফোর্সের অধিনায়কের সঙ্গে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। অতঃপর মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের এই ব্যাটালিয়নটি চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে হরিপুর হয়ে সিলেটমুখী অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে।

মুক্তিবাহিনীর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত সফলতম যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি হলো এই কানাইঘাটের যুদ্ধ। গৌরীপুরে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের পাল্টা আক্রমণে অনুপ্রাণিত ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কানাইঘাটের ডিফেন্সে চূড়ান্ত আক্রমণ পাকিস্তানিদের প্রকৃতপক্ষেই বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। কানাইঘাটে মুক্তিবাহিনীর বহুবিধ সমস্যা ছিল। তাঁদের না ছিল উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্রের সুবিধা কিংবা আর্টিলারির সাপোর্ট, না ছিল এয়ার রেইডের সমর্থন। বরং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদের ঘাটতি নিয়েই তাঁরা পাকিস্তানি ডিফেন্সে আক্রমণ চালান। নদী পারাপারের ভালো বন্দোবস্তও তাঁদের ছিল না। তার ওপর মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা দলের বেশির ভাগই ছিল স্বল্পকালের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-জনতার স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। তবু অভিযানটি চমৎকার সাফল্য অর্জন করে। মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, সাহস, সুদৃঢ় মনোবল, বীরত্ব তাঁদের নানাবিধ দুর্বলতা ছাপিয়ে বিজয় এনে দিয়েছিল। কানাইঘাটের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় সিলেট জয়েও প্রভাব ফেলেছিল।

ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক: জন্ম ২৫ মার্চ ১৯৫৩ (ঢাকা)। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টর এবং পরে জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম ওয়ার কোর্সে যোগ দিয়ে ৯ অক্টোবর কমিশন পান। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে মেজর হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে ব্যবসায়ী। ঢাকার শ্যামলীতে বসবাস করেন।

সূত্র: সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১, মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদনা: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন ২০২০


আরও দেখুন ...

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "এক নজরে বড় চতুল ইউনিয়ন"বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। ১১ নভেম্বর ২০১৮। ২ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০১৯ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]