বাণী জয়রাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাণী জয়রাম
২০১৫-তে এক অনুষ্ঠানে বাণী জয়রাম
২০১৫-তে এক অনুষ্ঠানে বাণী জয়রাম
প্রাথমিক তথ্য
জন্মনামকলাইবাণী
জন্ম(১৯৪৫-১১-৩০)৩০ নভেম্বর ১৯৪৫[১]
ভেলোর, তামিলনাড়ু, ভারত
মৃত্যু৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩(2023-02-04) (বয়স ৭৭) [২]
পেশানেপথ্য কন্ঠশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী
বাদ্যযন্ত্রকণ্ঠশিল্পী
কার্যকাল১৯৭১-২০২৩
ওয়েবসাইটOfficial website
পুরস্কারপদ্মভূষণ (২০২৩)

বাণী জয়রাম (৩০শে নভেম্বর ১৯৪৫ - ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩), যাঁকে আধুনিক ভারতের মীরা' নামেও অভিহিত করা হয়, ছিলেন একজন প্রথিতযশা ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী। তিনি দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে সুপরিচিত। বাণীর প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে এবং চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছেন। তিনি সহস্রাধিক সিনেমাতে দশ সহস্রেরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন। এছাড়াও, তিনি হাজার হাজার ভক্তিগীতি এবং ব্যক্তিগত অ্যালবাম রেকর্ড করেছেন এবং এছাড়াও ভারত এবং বিদেশে অসংখ্য একক সংগীত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন[৩]

তার কণ্ঠস্বর এবং কোনও কঠিন রচনার সাথে সহজে অভিযোজনযোগ্যতার জন্য বিখ্যাত, বাণী ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-য়ের দশক অবধি ভারত জুড়ে অসংখ্য ভাষার অসংখ্য সুরকারের প্রথম পছন্দ ছিলেন। তিনি তামিল, হিন্দি, তেলুগু, মালায়ালাম, কন্নড়, মারাঠি, ওড়িয়া, গুজরাতি এবং বাংলার মতো বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন।[৪]

তিনি তিনবার শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন এবং ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং গুজরাত রাজ্যগুলির রাজ্য সরকারের পুরস্কারও পেয়েছেন[৪] । ২০১২ সালে, তিনি দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র সংগীতে কৃতিত্বের জন্য দক্ষিণের ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন[৫]। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি নিউইয়র্ক সিটিতে নাফা ২০১৭ অনুষ্ঠানে সেরা মহিলা গায়কের সম্মান অর্জন করেন।[৬]

প্রাথমিক জীবন ও কর্মজীবন[সম্পাদনা]

বাণী জয়রাম তামিলনাড়ুর ভেলোরে প্রশিক্ষিত শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞদের একটি তামিল পরিবারে ছয় কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে পঞ্চম কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জন্মনাম ছিল কলাইবাণী। তার মা পদ্মাবতী, নিজের গুরু রঙ্গ রামানুজ আয়েঙ্গারের অধীনে বাণীকে প্রশিক্ষণের জন্যে ভর্তি করেন। সেখানে তিনি কবি মুথুস্বামী দীক্ষিতর কিছু কবিতা শিখেছিলেন। পরে তাঁকে কাদালুর শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, টি আর বালাসুব্রাহ্মণিয়ান এবং আর এস মণির মত গুরুদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ণাটকী সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি, বাণী প্রচলিত লঘু সঙ্গীত এবং ছায়াছবির গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং রেডিও সিলোন চ্যানেলে হিন্দি চলচ্চিত্রের গান শুনতেন; রেডিওতে বারবার বাজানো গানগুলির পুরো সমন্বয়সাধন তিনি অন্তঃস্থ করে ফেলে নিজে নিজে বাজাতেও পারতেন[৭]। ৮ বছর বয়সে আকাশবাণী, মাদ্রাজ কেন্দ্রে তিনি প্রথম অনুষ্ঠান করেন। তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন মেরি কলেজের ছাত্রী ছিলেন[৮][৯]। পড়াশনার শেষ করে তিনি ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কে যোগদান করেন ও মাদ্রাজ এবং হায়দ্রাবাদ শাখায় কাজ করেন।[১০]

১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে তার বিয়ের পরে, তিনি তার স্বামী জয়রামের সাথে পরিবার স্থাপনের জন্য মুম্বাই চলে যান। তার গানের দক্ষতা জেনে জয়রাম বাণীকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রশিক্ষণ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি পতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ আবদুল রেহমান খানের অধীনে ভর্তি হন। তার অধীনে কঠোর প্রশিক্ষণ তাঁকে তার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে সঙ্গীতকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে প্রায় বাধ্য করে। তিনি রেহমান খানের অধীনে ঠুংরী, গজল এবং ভজনের মতো বিভিন্ন সঙ্গীত শৈলীর রূপগুলি শিখেছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে তার প্রথম অনুষ্ঠান করেন[১১]। একই বছরে, সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত দেসাইয়ের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল যিনি গায়ক কুমার গন্ধর্বের সাথে একটি মারাঠি অ্যালবাম রেকর্ডিং করেছিলেন। তার কণ্ঠ শুনে, কুমার গন্ধর্বের সাথে একই অ্যালবামের জন্য "রুনানুবন্ধাচা" গানটি গাইতে দেসাই তাঁকে সুযোগ দেন। অ্যালবামটি প্রকাশিত হতেই, মারাঠি শ্রোতাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দ্বৈত সঙ্গীতটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। পরে তিনি প্রবীণ কণ্ঠশিল্পী 'পণ্ডিত দিনকর কৈকিনির সাথে ‘মীরা’ ছবিতে দ্বৈত সঙ্গীত গান। এটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।[৭]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

তেলুগু চলচ্চিত্র[সম্পাদনা]

তেলুগু চলচ্চিত্র এবং ভক্তিমূলক গানের প্রতি বাণীর অবদান বিস্তৃত। তিনি অভিমানবন্তুলু (১৯৭৩) চলচ্চিত্রের জন্য তার প্রথম তেলুগু গান রেকর্ড করেছিলেন। এস পি কোদনদাপানি রচিত "এপটিভালিকাডুর না স্বামী" গানটি ছিল একটি শাস্ত্রীয় নৃত্যভিত্তিক গান। পূজা (১৯৭৫) চলচ্চিত্রের জন্য তার গানগুলি তাঁকে তেলুগু সিনেমাতে নেপথ্য কন্ঠশিল্পী হিসেবে প্রথম সারিতে নিয়ে আসে।

তিনি পরিচালক কে. বিশ্বনাথ এবং সংগীত পরিচালক কে ভি ভি মহাদেবনের সাথে সীতামালক্ষ্মী (১৯৭৮), শ্রুতিলয়ালু (১৯৮৭), সংকরভারণম এবং স্বাতী কিরণমের মতো অনেক ছবির জন্য গান করেছেন। পরে ১৯৯০ সালে, স্বাতী কিরণম ছবিতে বাণীর দ্বারা গাওয়া সমস্ত গান ভালই প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি চলচ্চিত্রটির জন্য তার তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।

কে ভি মহাদেবন ছাড়াও বাণী রাজন-নগেন্দ্র, সত্যম, চক্রবর্তী, এম এস বিশ্বনাথন এবং ইলাইয়ারাজার জন্য অনেক তেলুগু গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি ইলাইয়ারাজা রচিত তামিলের বেশিরভাগ দ্বিভাষিক গান রেকর্ড করেছেন।

তেলুগু গান[সম্পাদনা]

হিন্দি সিনেমা[সম্পাদনা]

বসন্ত দেসাইয়ের সাথে তার ভাল পেশাদারিত্বের ফলস্বরূপ হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত গুড্ডি (১৯৭১) চলচ্চিত্রে তার গান গাওয়ার সুযোগ হয় এবং এই ছায়াছবির মাধ্যমে তার নাম হিন্দি ছায়াছবির জগতে প্রথম সারিতে উঠে আসে। দেসাই বাণীকে ছবিতে তিনটি গান রেকর্ড করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যার মধ্যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা জয়া বচ্চনের লিপে "বোল রে পাপিহারা" গানটি খুবই জনপ্রিয় হয় এবং বাণীকে নেপথ্যশিল্পী হিসেবে পরিচিত দেয়। 'মিয়াঁ কি মলহার' রাগে রচিত এই গানটিতে তার শাস্ত্রীয় দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর জন্যে তিনি তানসেন সম্মান (একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের সেরা ধ্রুপদী ভিত্তিক গানের জন্য), লায়ন্স আন্তর্জাতিক সেরা প্রতিশ্রুতিশীল গায়ক পুরস্কার, অল ইন্ডিয়া সিনেগোয়ার্স সহ বহু সম্মাননা ও পুরস্কার প্রাপ্ত হন। এছাড়াও একাত্তরের সেরা প্লেব্যাক গায়কের জন্য অল ইন্ডিয়া ফিল্ম-গোয়ারস অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এরপর তিনি বসন্ত দেসাইয়ের সাথে পুরো মহারাষ্ট্র রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন এবং স্কুল শিশুদের বহু মারাঠি গান শিখিয়েছিলেন।

তামিল সিনেমা[সম্পাদনা]

বলিউড সিনেমায় বাণীর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে তিনি দক্ষিণ ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রির কাছ থেকেও প্রস্তাব পেতে শুরু করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে, তিনি এস এম এম সুবাইয়া নাইডুর সংগীত পরিচালনায় থায়ুম সেয়িয়াম চলচ্চিত্রের জন্য তার প্রথম তামিল সংগীত রেকর্ড করেছিলেন।

মালায়ালাম সিনেমা[সম্পাদনা]

১৯৭৩ সালে স্বপ্নম চলচ্চিত্রের জন্য সলিল চৌধুরী রচিত একক গান "সৌরায়দাতিল বিদারন্নোরু" রেকর্ড করে বাণী জয়রাম মালয়ালম গানে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।[১২]

বাংলা ভাষায় গাওয়া বাণী জয়রামের বিখ্যাত একটি গান “নাচ রে পেখম তুলে নাচ ময়ূর"

পুরস্কার[সম্পাদনা]

রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পুরস্কার[সম্পাদনা]

  • ২০২৩- তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার[সম্পাদনা]

ফিল্মফেয়ার পুরস্কার[সম্পাদনা]

বিভিন্ন রাজ্য সরকার দ্বারা প্রদত্ত পুরস্কার[সম্পাদনা]

  • ১৯৭২ – গুজরাত রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার-শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়ক – ঘুঙ্ঘট
  • ১৯৭৯ – তামিলনাড়ু স্টেট চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ নারী প্লেব্যাক – আঝাগি উন্নাই আরাধিক্কিরেন
  • ১৯৭৯ – অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার প্রদত্ত নন্দী পুরস্কার শ্রেষ্ঠ নারী প্লেব্যাক গায়ক – শঙ্করভরনম
  • ১৯৮২ – ওড়িশা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার-শ্রেষ্ঠ গায়ক – দেবযানী

অন্যান্য পুরস্কার[সম্পাদনা]

  • ২০০৪: কামুকারা পুরস্কার[১৩]
  • ২০০৭: দক্ষিণ ভারতীয় মীরা[১৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sampath, Janani (২৯ নভেম্বর ২০১২)। "Serenading a dream"The New Indian Express। ২৯ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৪ 
  2. "৭৮ বছর বয়সে প্রয়াত প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী বাণী জয়রাম"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০৫ 
  3. "Lending `Vani' to patriotism"The Hindu। ১২ জুন ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-২৩ 
  4. "Sweet music for the ears"The Hindu। Chennai, India। ৫ ডিসেম্বর ২০০৪। ১০ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০২০ 
  5. "South Filmfare Awards 2012 winners' list:"। Bollywood Life। ২৩ জুলাই ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-২৩ 
  6. Best Female Singer Award by NAFA in 2017
  7. "The song that rained many songs"The Hindu। ১২ নভেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-২৩ 
  8. "Queen Mary's College, the home of musicians, on song"B SivakumarThe Times of India। ৫ জানুয়ারি ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২৬ এপ্রিল ২০১৮ 
  9. Asha Krishnakumar (এপ্রিল ২০০৩)। "The end of a women's college?" [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  10. "When Mrs.Vani Jayaram met me"The Hindu। ১২ জুন ২০০৬। ২৪ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-২৩ 
  11. "I do not abuse my voice: Vani Jairam"The Times of India। ১৩ জানুয়ারি ২০১৭। 
  12. Swapnam: 1973 The Hindu (2 February 2014)
  13. "The Hindu"। ১৩ নভেম্বর ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  14. "The Hindu"। Chennai, India। ২৮ মে ২০০৭। ৩ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]