বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(সংবিধান (৪র্থ সংশোধনী) আইন ১৯৭৫ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭৫ সালে কার্যকরা হয়েছিল। সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন ১৯৭৫ এর মাধ্যমে এই সংশোধনী কাযর্কর করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এতদসংক্রান্ত বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। একই দিনে তা ২৯৪-০ ভোটে পাস হয়েছিল। একই দিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তা অনুমোদনপূর্বক কার্যকর করেছিলেন।[]

এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। এই দলের নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রপতি অপসারণ পদ্ধতি জটিল করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতিকে যে কোন আদেশ দান ও চুক্তি সম্পাদন করার ক্ষমতা প্রদান অর্পণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে যে কোন সময় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।[]

সংবিধানের পরিবর্তন

[সম্পাদনা]

চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারা সংবিধানে কতিপয় বড় পরিবর্তন আনা হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়; বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থলে আনা হয় একদলীয় ব্যবস্থা; জাতীয় সংসদের কতক ক্ষমতা খর্ব করা হয়; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকটা খর্ব হয়; সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা ও প্রয়োগের এখতিয়ার থেকে বঞ্চিত হয়। এই আইন দ্বারা (১) সংবিধানের ১১, ৬৬, ৬৭, ৭২, ৭৪, ৭৬, ৮০, ৮৮, ৯৫, ৯৮, ১০৯, ১১৬, ১১৭, ১১৯, ১২২, ১২৩, ১৪১ক এবং ১৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়; (২) ৪৪, ৭০, ১০২, ১১৫ ও ১২৪ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করা হয়; (৩) সংবিধানের তৃতীয় ভাগ সংশোধন করা হয়; (৪) তৃতীয় ও চতুর্থ তফসিল পরিবর্তন করা হয়; (৫) প্রথম জাতীয় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়; (৬) রাষ্ট্রপতির পদ ও এই পদের প্রার্থী সম্পর্কে বিশেষ বিধান করা হয়; (৭) সংবিধানে একটি নতুন (একাদশ) ভাগ সংযুক্ত করা হয়; এবং (৮) সংবিধানে ৭৩ক ও ১১৬ক অনুচ্ছেদ দুটি সংযুক্ত করা হয়।[]

সংশোধনীর প্রধান দিকসমূহ

[সম্পাদনা]
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। এই দলের নাম রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে সকল সাংসদকে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। অন্যথায় সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়ার বিধান সংবিধানে সংযোজন করা হয়।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবীরা রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান করা হয়। তাদের বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার প্রবিধান করা হয়। এতকাল সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতি করা নিষিদ্ধ ছিল।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে ব্যতিরেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়।
  • এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে থাকার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে সকল বিচারপতির নিয়োগ ও অপসারণের সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে অধিকার বিচার বিভাগের ছিল তা রদ করা হয়েছিল।
  • সংবিধানের এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে উপরাষ্ট্রপতিনিয়োগের ও অপসারণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল।
  • এই বিধান যোগ করা হয়েছিল যে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য থাকবেন না।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ হতে সংসদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়।
  • এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের পদ্ধতি আরও জটিল করা হয়েছিল।

সমালোচনা

[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ করেন যে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার যে পূর্ণাঙ্গ রায় ২৫ শে জুলাই ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয় এতে দেখা যায়, আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির সকলেই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমান নয়, বরং চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারাই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে বিচারক অপসারণের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। আর সেই ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বিবেচনা করে এবং তার তুলনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ‘অধিকতর স্বচ্ছ’ পদ্ধতি বিবেচনায় আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর মামলার রিভিউতে তা মার্জনা করেছিলেন।[][]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "একনজরে সংবিধানের ১৭টি সংশোধনী"। ৩০ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০২১ 
  2. "সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী"বিবিসি বাংলা। ২০১১-১২-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০৪ 
  3. "সাংবিধানিক সংশোধনী"বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০৪ 
  4. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০১৭-০৮-০৩)। "চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধান পরিপন্থী"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০৪ 
  5. "পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে '৭২ সংবিধানে ফিরতে বাধা থাকবে না: আইনমন্ত্রী"। ৩০ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০২১