বিষয়বস্তুতে চলুন

চৌধুরী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

চৌধুরী (হিন্দি: चौधुरी; গুরুমুখী: ਚੈਧਰੀ; উর্দু: چودهرى‎‎; নেপালি: चौधरी) ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত একটি সম্মানসূচক উপাধি।[] চৌধুরী শব্দের চৌর উৎপত্তি চৌ বা চৌত অর্থ চার বোঝায় আর ধুরী শব্দের অর্থ ধারক। মূলত এই দুইটা শব্দের মিশ্রনে চৌধুরী শব্দের উৎপত্তি। চৌধুরী এর স্ত্রীলিঙ্গের সমতুল্য শব্দ ছিল "চৌধুরানী"।[]

ভারতীয় উপমহাদেশে কোন সামন্ত রাজা যিনি যুদ্ধের জন্য নৌ, হস্তী, অশ্ব ও পদাতি এই চার শক্তির অধিকারী হতেন। তাদের ওই সাম্রাজ্যের সম্রাট চৌধুরী পদবীতে ভূষিত করতেন। পরবর্তীতে মুসলিম শাসন আমলে সুলতানরা রাজকীয় ব্যক্তিদের চৌধুরী উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতে দেখা যায়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এর প্রচল রয়েছে।

সুলতানী আমলে সুলতানরা রাজা, জমিদার, সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তি দের চৌধুরী উপাধি দিতেন। যেমন বর্ধমানের রাজপরিবারের জমিদার কৃষ্ণরাম রায়কে ১৬৮৯ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে ফরমানে সম্মানিত হন এবং সুখাইড় জমিদার বাড়ি একইসাথে রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিলো কিন্তু এই উপাধি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাক্ষান করেছিলো এই জমিদার পরিবার। কিন্তু বর্ধমানের জমিদার ও চৌধুরী হিসাবে তাঁর উপাধি নিশ্চিত করে। নাটোরে রাজপরিবারের রাজা রাম জীবন চৌধুরী এই উপাধি ব্যবহার করতে দেখা যায়। বোমাং বংশের রাজাদেরও চৌধুরী ব্যবহার করতে দেখা যায় — যেমন রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরী। চৌধুরী, সাহেব, মল্লিক, সরদার এই ধরনের উপাধি ব্রিটিশদের অধীনে নিয়োজিত বাঙালি কর্মচারীদের ও ব্যবহার করতে দেখা যায়। জমিদার বঙ্কু বিহারী রায়ের পুত্র আবু রায় ১৬৫৭ সালে চাকলা বর্ধমানের ফৌজদারের অধীনে বর্ধমানের রেখাবী বাজারের চৌধুরী ও কোতোয়াল নিযুক্ত হন। তাঁকে বর্ধমান রাজপরিবারের পিতৃপুরুষ বলে মনে করা হয় কারণ তাঁর সময়েই জমিদারির বিকাশ শুরু হয়েছিল এবং জমিদারি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ব্রিটিশরা বাংলা শাসন ভার দখলের পর, তাদের শাসন পরিচালনার জন্য সমাজে কিছু মানুষ তাদের সাহায্য করত। তাদের কাজে খুশি হয়ে ব্রিটিশরা তাদের চৌধুরী উপাধি প্রদান করতো। মূলত তখন থেকে চৌধুরী নামটি পারিবারিক পদবিতে রূপান্তিত হয়। চৌধুরীরা ব্রিটিশদের ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজে প্রভাব বিস্তার করত। কিন্তু এছাড়াও 'মাল্লাহ' জাতির পদবি চৌধুরী। তাদের কথা অনুসারে মাল্লাহ জাতের পদবি ব্রিটিশরা ব্যবহার করে থাকে।

তাৎপর্য

[সম্পাদনা]

মুঘল সাম্রাজ্যে "চৌধুরী" ছিল মুসলিম এবং হিন্দুসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া একটি সম্মানসূচক উপাধি। এছাড়াও এই উপাধি ছিল সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের জন্য, যারা অশ্বারোহী, নৌবাহিনী, পদাতিক ও হাতি বাহিনীসহ চারটি পৃথক বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন।[] ব্রিটিশ ভারতের জমিদার পরিবারগুলোতে এই ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[]

মুঘল ও নবাবরা প্রচুর সংখ্যায় এই উপাধি প্রদান করতেন। চৌধুরীরা ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যারা পরগনা নামে পরিচিত প্রশাসনিক এককে আমিল (রাজস্ব আদায়কারী) এবং কারকুন (হিসাবরক্ষক)-এর পাশাপাশি ভূমি কর আদায়ে দায়িত্ব পালন করতেন।[][]

বর্তমান সময়ে এই শব্দটি দক্ষিণ এশিয়ায় পুরুষ এবং নারী উভয়েরই একটি সাধারণ পদবি।

ওড়িশায় "চৌধুরী" উপাধিটি করণ সম্প্রদায়ের লোকেরা ব্যবহার করেন।[]

বিভিন্ন অঞ্চলে চৌধুরী উপাধির ব্যবহার

[সম্পাদনা]

পার্বত্য চট্টগ্রামে বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেলের রাজাদের পদবি "চৌধুরী"।[][][]

সাবেক কাছাড়ি রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিম মিরাশদারদের কাছাড়ি রাজা কর্তৃক দেওয়া উপাধি বর্তমানে তাদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[১০]

বিহারে পাসি সম্প্রদায়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে তাড়ি প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত, তারাও চৌধুরী নামে পরিচিত।

রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশে জাট সম্প্রদায়ের মধ্যে "চৌধুরী" পদবি ব্যাপক প্রচলিত। এছাড়াও রাজপুত, গুজ্জর, আহির ও দলিত সম্প্রদায়ের অনেকে এই পদবি ব্যবহার করেন।[১১][১২][১৩] উত্তর ভারতে এই পদবি সম্মান ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[১৪] সাধারণত ব্যক্তির নামের আগে "চৌ." সংক্ষেপে ব্যবহৃত হয়, যেমন: চৌ. চরণ সিং, ভারতের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী এবং চৌ. দেবী লাল, ভারতের ষষ্ঠ উপ-প্রধানমন্ত্রী।

দক্ষিণ ভারতের দেশস্থ ব্রাহ্মণ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার কাম্মা সম্প্রদায়ের সদস্যরাও গোলকোন্ডার কুতুব শাহী এবং হায়দ্রাবাদের নিজামদের আমলে এই উপাধি লাভ করেছিলেন এবং বর্তমানে "চৌধুরি" বা "চৌধারী" পদবি হিসেবে ব্যবহার করেন।[১৫][১৬][১৭]

চৌধুরী পদবি যুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তি

[সম্পাদনা]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Hanks, Patrick; Coates, Richard; McClure, Peter (২০১৬-১১-১৭)। The Oxford Dictionary of Family Names in Britain and Ireland (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-967776-4ডিওআই:10.1093/acref/9780199677764.001.0001/acref-9780199677764 
  2. "::: Star Weekend Magazine :::"archive.thedailystar.net। ২০১৪-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৬ 
  3. The Journal of the Anthropological Survey of India (ইংরেজি ভাষায়)। The Survey। ২০০২। 
  4. "Wayback Machine" (পিডিএফ)nios.ac.in। ২০২৪-০৬-১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  5. "Wayback Machine" (পিডিএফ)www.universityofcalicut.info। ২০১৯-১১-০১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  6. "rediff.com: The evil that envelopes Orissa"www.rediff.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  7. "Saching Prue new Mong King" 
  8. "Feature: 'Kingdom' system in Bangladesh's Chittagong Hill Tracts still in force - People's Daily Online"en.people.cn। ২০১৮-০৬-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  9. "Article on UNPO and the Uyghurs in Checks & Balances -" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৯-১১-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  10. Principal Heads of the History and Statistics of the Dacca Division (English ভাষায়)। Oxford University। E.M. Lewis, CalcuttaCentral Press Company। ১৮৬৮। 
  11. Elliot, Sir Henry Miers (১৮৬৭)। The History of India, as Told by Its Own Historians: The Muhammadan Period (ইংরেজি ভাষায়)। Trübner and Company। 
  12. Sheoran, C. B. Singh (২০১৯-০৬-১৭)। Gallant Haryana: The First and Crucial Battlefield of AD 1857 (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 978-1-000-43913-7 
  13. Paswan, Sanjay (২০০২)। Encyclopaedia of Dalits in India: Struggle for self liberation (ইংরেজি ভাষায়)। Gyan Publishing House। আইএসবিএন 978-81-7835-066-0 
  14. "Surname Choudhary: Meaning Origin Variants"www.igenea.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭ 
  15. Gaikwad, V. R.; Tripathy, Ram Niranjan (১৯৭০)। Socio-psychological Factors Influencing Industrial Entrepreneurship in Rural Areas: A Case Study in Tanuku Region of West Godavari, Andhra Pradesh (ইংরেজি ভাষায়)। National Institute of Community Development। 
  16. Brand, Coenraad M. (১৯৭৩)। State and Society: A Reader in Comparative Political Sociology (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-02490-8 
  17. India, The Hans (২০১৬-০৭-২৪)। "Revealing the missing links"www.thehansindia.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৭