রাধানগর যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রাধানগরের যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি যুদ্ধ। রাধানগর সিলেটে অবস্থিত। এখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিলো। মেজর শাফায়েত জামিল ও লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা গোলা সমর্থন ছাড়াই আকস্মিক আক্রমণ করে দখল করেন ছোটখেল ও রাধানগর।[১]

যুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ব্যাপক আর্টিলারি ফায়ার সমর্থন নিয়ে সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তসংলগ্ন রাধানগরে পাকিস্তানিদের অবস্থানে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়। মিত্রবাহিনীর পক্ষে চারজন অফিসারসহ ৮০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।[২] এর একদিন পর ২৮ নভেম্বর রাধানগরে পাকিস্তানিদের অবস্থান আক্রমণ করে দখল নিতে মিত্রবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রাজসিংহ এস আই এম নূরুন্নবী খানকে নির্দেশ দেন। সেদিন গভীর রাতে ১৬০ জন সৈনিক নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্থানীয় সদর দপ্তর রাধানগর এলাকার ছোটখেল গ্রামটির দখল করতে যান এস আই এম নূরুন্নবী খান। মিত্রবাহিনীর কোনো গুলি না নিয়ে নীরব আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

দীর্ঘ এক মাস পাকিস্তানিদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঘিরে রাখার কারণে শত্রুর প্রতিটি অবস্থান, অস্ত্রবল ও জনবলের ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর সঠিক ধারণা হয়েছিল। এফইউপি (ফর্ম-আপ-প্লেস) থেকে আক্রমণে যাওয়ার আগে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক শাফায়াত জামিল ডাউকি থেকে গভীর রাতে আসেন।

মিত্রবাহিনীর ২৬ নভেম্বরের আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর ওপর দায়িত্ব পড়ে রাধানগর দখলের। ২৮ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে ছোটখেল আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন শাফায়াত জামিল। যুদ্ধে শাফায়াত জামিল আহত হলে নেতৃত্ব দেন এস আই এম নূরুন্নবী খান। শাফায়াত জামিল গুরুতর আহত অবস্থায় পেছনের লুনি গ্রাম থেকে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে একটি চিরকুট পাঠান। ওই চিরকুটে তিনি এস আই এম নূরুন্নবী খানকে ব্যাটালিয়ন অধিনায়কসহ ডাউকি এলাকার সব মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ছোটখেল অবস্থানটি দখলে রাখতে বলেন।

মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ছোটখেল দখল করেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে যায়। সকাল আটটার দিকে তারা পুনর্গঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একের পর এক আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করেন। পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর, ইয়া আলী, ইয়া হায়দার ধ্বনি দিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। উত্তরে রাধানগর এবং দক্ষিণে গোয়াইনঘাট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রতি-আক্রমণ শুরু করে যা ছিল খুবই মারাত্মক ধরনের। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহামলা প্রতিহত করে। দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় পাকিস্তানিদের একটি ব্যাপক প্রতিহামলা আসে। এবারও তিন দিক থেকে এ হামলা আসে। মুক্তিযোদ্ধারা সেই প্রতিহামলা প্রতিহত করে।[৩] সেদিন যুদ্ধে মো. সানা উল্লাহ, সিপাহি নূরুল হকসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন।

মিত্রবাহিনীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২৯ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত পাকিস্তানিদের রাধানগর প্রতিরক্ষার অন্যান্য অবস্থানে আক্রমণ হয়নি। ওই দিন রাত ১০টা পর্যন্ত বারবার আক্রমণ করেও পাকিস্তানিরা ছোটখেল অবস্থানটি দখলে নিতে পারেনি। এদিন সন্ধ্যার দিকে এস আই এম নূরুন্নবী খান রাধানগর এলাকা ঘিরে অবস্থানগত সবক'টি এমএফ (মুক্তিফৌজ) ও এফএফ (গণবাহিনী) কোম্পানিকে যার যার সামনের পাকিস্তানিদের অবস্থানগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে দখল করার নির্দেশ দেন, এতে সন্ধ্যার পরপরই পুরো এলাকা ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানিরা গভীর রাতে তাদের সীমান্তবর্তী শত্রুঘাঁটি রাধানগর অবস্থান ছেড়ে গোয়াইনঘাট থানা সদরে পালিয়ে যায়। ৩০ নভেম্বর সকালের মধ্যেই পুরো তামাবিল-ডাউকি সীমান্তবর্তী এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মফিদুল হক (২০০৯-১২-১২)। "আত্মদানের রক্তধারা"। দৈনিক প্রথম আলো। ১০ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০২-২১ 
  2. আহমেদ হিরন, ওয়াকিল (৯ ডিসেম্বর ২০১৫)। "'রাধানগর অভিযান ছিল স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ'"দৈনিক সমকাল। ২৩ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১৮ 
  3. রহমান, রাশেদুর (৩-০৫-২০১২)। "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"দৈনিক প্রথম আলো। ৮ জুন ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 23 মার্চ 2018  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)

গ্রন্থপঞ্জী[সম্পাদনা]