দেউলঘাটা

স্থানাঙ্ক: ২৩°২২′৪৯.২″ উত্তর ৮৬°০৭′৫৩.২″ পূর্ব / ২৩.৩৮০৩৩৩° উত্তর ৮৬.১৩১৪৪৪° পূর্ব / 23.380333; 86.131444
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দেউলঘাটা
দেউলঘাটার দুটি দেউল মন্দির
দেউলঘাটার দুটি দেউল মন্দির
দেউলঘাটা পশ্চিমবঙ্গ-এ অবস্থিত
দেউলঘাটা
দেউলঘাটা
পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩°২২′৪৯.২″ উত্তর ৮৬°০৭′৫৩.২″ পূর্ব / ২৩.৩৮০৩৩৩° উত্তর ৮৬.১৩১৪৪৪° পূর্ব / 23.380333; 86.131444
দেশ India
প্রদেশপশ্চিমবঙ্গ
জেলাপুরুলিয়া জেলা
সময় অঞ্চলIST (ইউটিসি+৫:৩০)
PIN৭২৩২০১
টেলিফোন কোড৩২৫৪

দেউলঘাটা বা বোড়াম পুরুলিয়া থেকে ৩৪ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত আড়ষা থানার অন্তর্গত একটি প্রত্নস্থল| এককালে এখানে অনেক দেউল এবং অজস্র মূর্তি ছিল| এখন মাত্র দুটি ইঁটের দেউল মন্দির দাঁড়িয়ে আছে| এখানকার একটি বৃহৎ দেউল ২০০২ সালে ভেঙ্গে পড়ে| বেশ কয়েকটি প্রস্তর নির্মিত দেউলের ধবংসাবেশ এখানে দেখতে পাওয়া যায়| একটির উপর একটি নতুন মন্দির তৈরী হয়েছে| দেউলঘাটার আরেকটি আকর্ষণ এখনকার প্রস্তরনির্মিত মূর্তিগুলি| [১]

প্রাচীন ইতিহাস[সম্পাদনা]

কর্নেল ই. টি ডাল্টনের বিবরণ[সম্পাদনা]

দেউলঘাটার মন্দির নিয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ছোট নাগপুরের কমিশনার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ই. টি ডাল্টনের লেখা "Notes on a Tour in Manbhoom in 1864-65" প্রবন্ধে| ডাল্টন তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে উনি পুরুলিয়ার জয়পুর গ্রামের চার মাইল দক্ষিণে কাঁসাই নদীর ডানদিকের পাড়ে বোড়াম গ্রামের সন্নিকটে অনেক পাথর ও ইঁটের ধংসাবসেশের মধ্যে তিনটি সুবিশাল ইঁটের তৈরী মন্দির দেখেছিলেন| ডালটন উল্লেখ করেছেন যে তিনটি ঢিপির উপর মন্দিরগুলি দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলো ছাড়া আরও অনেক ঢিপির উপর একই ধরনের ভগ্নাবশেষ ছিল| এর থেকে উনি অনুমান করেন যে এই স্থানটি একসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল|ডাল্টন তিনটি মন্দিরের মধ্যে সবচাইতে উঁচু মন্দিরটির উচ্চতা ৬০ ফুট ধার্য করেন| তিনি উল্লেখ করেন যে এই মন্দিরের উপরের ভাগটি তিনি ভগ্ন অবস্থায় দেখতে পান এবং এই অংশটির পূর্বাবস্থা অনুমান করা সম্ভব ছিল না| ডাল্টন এও উল্লেখ করেছেন যে এই মন্দিরটি যে ইঁট দিয়ে তৈরী তা এতটাই নিঁখুত যে মনে হয় যেন এগুলো যন্ত্রের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছিল| ইঁটগুলি এত নিঁখুত ভাবে বসানো আছে যে দুটো ইঁটের মাঝখানে একটা ছুরির ফলা ঢোকানোও অসম্ভব ব্যাপার| মন্দিরগুলি সবই পুবমুখী| ডাল্টন মন্দিরগুলির গর্ভগৃহে কোনও বিগ্রহ দেখতে পাননি| তবে সর্বোচ্চ মন্দিরের দেওয়ালে উনি জল নিষ্কাশনের জন্য পাথর নির্মিত চোঙ দেখতে পান| উনি অনুধান করেন মন্দিরের দেবতা কে স্নান করানো পর এই স্থান দিয়ে জল নিষ্কাশন করা হত| ডাল্টনের মতে যে ইঁটগুলি দিয়ে মন্দিরগাত্রের কারুকার্য করা হয়েছে সেগুলো আগে ছাঁচে ফেলে তৈরী করা হত আর তার পরে সেগুলো পোড়ানো হত| ডাল্টনের মতে যে ভাবে এই অলংকৃত ইঁটগুলি মন্দিরগাত্রে বসানো হয়েছিল তা খুবই নিঁখুত ও সুরুচিপূর্ণ| উনি উল্লেখ করেছেন যে কয়েকটি জায়গায় ষ্টাকোর বা চুন সুরকির অলংকরণও রয়েছে| ডাল্টন কিছু ট্রেসারী অলংকরণ বা স্রোতের ন্যায় চিত্র দ্বারা অলংকরণও এখানে দেখতে পান| বাকি যে দুটি মন্দির উনি দেখতে পান সেগুলির অলঙ্করণ এই মন্দিরের মতন, কিন্তু ওই দুটি মন্দিরের আকার এর থেকে ছোট| এখানে মন্দিরের সামনে ডাল্টন কিছু ছোট ছোট থাম দেখতে পান, কিন্তু তিনি মনে করেন সেগুলো এতই ছোট যে সেগুলো কোন মন্ডপের ভারবহন করতে অক্ষম| ওই অঞ্চলের লোকের মতে এই মন্দিরগুলি জৈন মন্দির কিন্তু ডাল্টন এখানে কোন জৈন মূর্তি দেখতে পাননি| তবে এই স্থান থেকে এক মাইল দক্ষিণে তিনি একটি হিন্দু মন্দিরের ধংসাবসেশ দেখতে পান যেখানে নিকটবর্তী সমস্ত মন্দিরের দেবমূর্তি এনে জড়ো করে রাখা ছিল| হিন্দু মন্দিরটি সম্ভবতঃ শিবের মন্দিরের , কিন্তু ওখানে সংরক্ষিত মূর্তির মধ্যে কিছু নগ্ন মূর্তিও ছিল| ডাল্টন অনুমান সেগুলো দেউলঘাটার ভগ্ন ইঁটের মন্দির থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে|[২]

জে. ডি. বেগলারের বিবরণ[সম্পাদনা]

দেউলঘাটার জরাজীর্ণ একটি মন্দির

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের জে. ডি. বেগলার তাঁর "Report on a tour through the Bengal provinces in 1872-73" এ বোড়াম গ্রামের মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন| তিনিও তিনটি ইঁটের মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন| ধ্বংসপ্রাপ্ত বড় মন্দিরটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে বাইরের দিকের অলংকরণ বিভিন্ন স্তরে সারিবদ্ধ ভাবে খাঁজ কেটে করা হয়েছে| বৌদ্ধ গয়ার মত এখানকার মন্দিরে কোনও প্লাস্টারের আস্তরন নেই| মন্দিরের সমায়ত প্রবেশ দ্বারের মাথার দিকটা ত্রিভুজাকৃত| বেগলার কিন্তু এই মন্দিরের গর্ভগৃহে সিংহের পিঠে বসা এক চতুর্ভুজ দেবীমূর্তি দেখতে পেয়েছিলেন , যাকে তিনি দেবী পার্বতী ভেবেছিলেন| ছোট দুটি ইঁটের মন্দিরের মধ্যে একটির কারুকার্য বেগলারের উচ্চমানের মনে হয়েছিল| বেগলার এই মন্দিরটি যখন দেখেছিলেন তখন সেটি উপর প্লাস্টার করা হয়েছিল এবং সাদা চুনকাম করা ছিল| বেগলারের সন্দেহ হয়েছিল যে প্লাস্টারের কাজগুলো সাম্প্রতিক কারণ ইঁটের অলংকরনের সাথে পলেস্তরার প্রলেপ মানানসই লাগছিল না| বেগলার যখন বোড়াম গিয়েছিলেন তখন এই মন্দিরের সামনে ডাল্টন বর্ণিত থামের শুধুমাত্র কুঁদোগুলো অবশিষ্ট ছিল| এগুলো নিয়ে ডাল্টনের সাথে বেগলারের মতের এটাই তফাৎ যে বেগলার মনে করেছিলেন যে মন্দিরের সামনে পরবর্তীকালে একটি মহামন্ডপ তৈরী করা হয়েছিল যার ভারবহন করত এই থামগুলো| দ্বিতীয় মন্দিরটির পুবদিকে বেগলার আরেকটি চতুর্ভুজ পার্বতীর মূর্তি দেখেছিলেন, তার সঙ্গে একটি ছোট গনেশ মূর্তি ও একটি নারী মূর্তিও ছিল| এখানে একটা নিচু ঢিপি ছিল যার থেকে মনে বেগালারের মনে হয়েছিল যে এখানে একসময় একটা ছোট মন্দির ছিল, যেখানে এই মূর্তিগুলি পূজিত হত| তৃতীয় যে ইঁটের মন্দিরটি বেগলার এখানে দেখেছিলেন সেখানে একটি বড় আট হাতের মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তি তাঁর চোখে পড়েছিল| তিনি এই ধরনের মূর্তি দুলমি ও লখিসরাইতে দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর মতে এটি অনেক বেশি সংরক্ষিত অবস্থায় পেয়েছিলেন| এই তিনটি ইঁটের মন্দির ছাড়া বেগলার দুটি ধবংসপ্রাপ্ত পাথরের মন্দির দেখতে পেয়েছিলেন| তবে বেগলার মনে করেছিলেন এই মন্দিরগুলো শৈবদের আরাধ্য, কেননা উনি বৈষ্ণব বা অন্য কোন মূর্তি এখানে পাননি| বেগলার মনে করেছিলেন যে বোড়াম গ্রামের কোন এক সময় একটি বিশাল, ধনী ও অসহিষ্ণু শৈব সম্প্রদায় বাস করত|।[৩]:১৮৪-১৮৭

দেউলঘাটা মন্দিরের বর্তমান অবস্থা[সম্পাদনা]

দেউলঘাটার দুর্গামূর্তি

দেউলঘাটার দুটি ইঁটের দেউল মন্দির মুলত রেখ দেউল| দুটি দেউলই উঁচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত এবং দুটিতেই রয়েছে বাড়, গন্ডি ও মস্তক অংশ| দেউল দুটির মস্তক ক্ষয়প্রাপ্ত| দেউল মন্দিরগুলিতে রয়েছে ছোট ছোট কুলুঙ্গি| পুরুলিয়ার ইতিহাস গবেষক সুভাস রায় মনে করেন এই কুলুঙ্গিগুলিতে একসময় জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি বা অন্য কোনো দেবদেবীর বিগ্রহ বসানো থাকত| এই ইঁটের দেউলের গায়ে অলঙ্করণ হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির একাধিক দেউল যা থেকে পূর্ণাঙ্গ দেউলগুলির গঠন ভঙ্গিমা বুঝতে পারা যায়| দুটি দেউলের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে তার উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট|অন্য দেউলটির অবস্থা একেবারে ক্ষয়প্রাপ্ত| দুটি দেউলই পুবমুখী এবং প্রবেশপথ ত্রিভুজাকৃতি| দুটি পাথরের দেউলের অবশিষ্ট ভাগ এখনও রয়েছে| একটি প্রস্তর দেউলের পাদভাগের উপর তৈরী হয়েছে একটি আধুনিক শিব মন্দির| অন্য দেউলটির পাদ ভাগ এবং তিনদিকের দেওয়ালের অংশবিশেষ এখনও টিঁকে আছে| এর অভ্যন্তরে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ|[৪]

দেউলঘাটার অন্যতম আকর্ষণ এখানকার প্রস্তরনির্মিত মূর্তি যেগুলো এখানকার ছোট ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে| কয়েকটি বাইরে পড়ে আছে| উল্লেখযোগ্য মূর্তিগুলির একটি তালিকা দেওয়া হল| মূর্তির বর্ণনা পুরুলিয়ার ইতিহাস গবেষক সুভাস রায়ের অনুযায়ী|

১. দুর্গা মূর্তি : উচ্চতা ৪ ফুট| অনেকে মনে করেন মূর্তিটি একাদশ শতাব্দীর| দেবীর দশটি হাতের মধ্যে মাত্র চারটি হাত অক্ষত| ডান হাতে তরবারি| দেবীর এক পা মহিষের পৃষ্টে, অন্য পা সিংহের উপরে|

২, চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি : চার ফুট উচ্চতার দেবীমূর্তি| একটি পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে| একটি হাত ভেঙ্গে গেছে| মূর্তিটি সালংকরা|

৩. সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি : সিংহের পিঠে দন্ডায়মনা মূর্তি| চতুর্ভুজা দেবীমূর্তির চার হাতে চারটি প্রতীক| সমগ্র মূর্তিটি একটি প্রস্তরখন্ডের উপর খোদিত|

৪. রণচন্ডি : শিমুল বৃক্ষের নিচে অবস্থিত আট হাতের দেবীমূর্তি| স্থানীয় ভাষায় রণচন্ডি| দেবীর আট হাতেই অস্ত্র

৫. গনেশ মূর্তি : উচ্চতা তিন ফুট| চতুর্ভুজ মূর্তি | পদ্মের উপর দন্ডায়মান|

৬. ভগ্ন ধ্যানমগ্ন মূর্তি : আনুমানিক ৩ ফুট উচ্চতা | মস্তক অংশ নেই|

৭. শিবলিং : এটি তিনটি স্তরে সজ্জিত| একটু ঘোরালেই তিনটি স্তর আলাদা ভাবে ঘুরতে থাকে|

দেউলঘাটায় আরো অনেক মূর্তি ছিল| যেমন কিনা ষড়বহুজা দেবীমূর্তি , শিব দুর্গার যুগল মূর্তি, ধনুকধারী শ্রীরাম চন্দ্রের মূর্তি, গনেশকে কোলে নিয়ে দেবী মূর্তি| কিন্তু সেগুলো চুরি গিয়েছে| [৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. রায়, সুভাষ (২০১২)। পুরুলিয়া জেলার পুরাকীর্তি, পুরুলিয়ার কয়েকটি প্রত্নস্থল, অনৃজু প্রকাশনী, চেলিয়ামা, পুরুলিয়া, ৭২৩১৪৬, প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৪১৯, পৃষ্ঠা ৫২ 
  2. Dalton, E.T. (১৮৬৬)। Notes on a Tour in Manbhoom in 1864-65, Journal of the Asiatic Society of Bengal, Volume XXXV, Part I, Page 187-189 
  3. Beglar, Joseph David Freedone Melik; Cunningham, Alexandar (২০০০) [1878]। "Burâm"। Report of a Tour Through the Bengal Provinces of Patna, Gaya, Mongir and Bhagalpur; The Santal Parganas, Manbhum, Singhbhum and Birbhum; Bankura, Raniganj, Bardwan and Hughli in 1872-73। Report of the Archaeological Survey of India। VIII। New Delhi: Archaeological Survey of India। 
  4. রায়, সুভাষ (২০১২)। পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য, ১ম খন্ড, রাঢ় প্রকাশনী, সিউড়ি, বীরভূম ৭৩১১০১ প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০১২ , পৃষ্ঠা ৫২-৫৪ 
  5. রায়, সুভাষ (২০১২)। পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য, ১ম খন্ড, রাঢ় প্রকাশনী, সিউড়ি, বীরভূম ৭৩১১০১ প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০১২ , পৃষ্ঠা ৫৫-৫৭