বঙ্গে জৈনধর্ম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় প্রাচীন কালে জৈনধর্ম ছিল বঙ্গ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ধর্মবিশ্বাস।[১]

সরাক[সম্পাদনা]

সরাক হল বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশাঝাড়খণ্ডের একটি জৈন সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় প্রাচীন কাল থেকেই জৈনধর্মের অনুগামী। যদিও পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মূল জৈনধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর থেকে এরা বিচ্ছিন্ন।

জৈন পণ্ডিত ভদ্রবাহু ছিলেন দ্বিতীয় লৌহাচার্য ও কল্পসূত্র গ্রন্থের রচয়িতা। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সম্ভবত তিনি ছিলেন এই সরাক সম্প্রদায়ভুক্ত।[২] সরাকরা ছিল কৃষিজীবী ও কুশিদজীবী। এদের নিজস্ব ভূসম্পত্তি ছিল।

সরাক সম্প্রদায় এখনও নিরামিশাষী। যদিও এই ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়ে এই প্রথা নেই। সরাকদের প্রিয় পৃষ্ঠপোষক সন্ত হলেন পার্শ্বনাথ। তারা নমোকার মন্ত্র আওড়ায়। কল্পসূত্র মতে, ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর বঙ্গ অঞ্চলে এসেছিলেন।

ইখতিয়ার উদ্দিম মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বিজয়াভিযানের পর অবশিষ্ট ভারতের জৈন সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মারাঠা সাম্রাজ্যে পারওয়ার মঞ্জু চৌধুরীকে (১৭২০-১৭৮৫) কটকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হলে দিগম্বর বুন্দেলখণ্ড জৈনদের সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের পুনরায় যোগাযোগ হয়।

২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের অধিবাসী ১৬৫ জন সরাক জৈন শ্রবণবেলগোলায় তীর্থযাত্রায় এসেছিলেন। শ্রবণবেলগোলায় সরাক জৈনদের স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।[৩]

সরাক পুরুলিয়ার প্রাচীনতম বাসিন্দা। এবং বলতে গেলে এরাই মানভূমে আসা আদি আর্য। এই জাতিটি আদিতে এতদঞ্চলে অর্থাৎ ছোটনাগপুর মাভূমি অঞ্চলে লৌহগলানো এবং তাম্র ব্যবসার কার্যে নিযুক্ত ছিল। সেকালে এই এলাকায় ছিল দুটি বিখ্যাত তাম্রখনি তামাজুড়ি এবং তামাখুন । এই দুই খনি থেকেতাম্র আকরিক সংগ্রহ করে তারা তৈলকম্প বন্দর ( বর্তমানে যা রঘুনাথপুর ২ নং ব্লকের অন্তর্গত তেলকুপি) হয়ে নদীপথে বা সড়ক পথে পৌঁছে যেত তাম্রলীপ্তে। জৈন শ্রাবক শব্দের অপভ্রংশ সরাক।O Malley,L.S.S প্রনীত District Gazetteers VOL-XX-1919 গ্রন্থে বলা হয়েছে - " The name sarawak,serak or sarak is clearly a corruption of Sravak the sanskrit Word "

"মানভুম জেলার ভূগোল ও ইতিবৃত্ত" গ্রন্থে শ্রী বিমলাপ্রসাদ চট্টোপাদ্ধায় স্পষ্টই লিখেছেন "খৃষ্টপূর্ব পাঁচ ছয় শত বৎসর পূর্ব হইতে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই জেলায় সরাকদিগের প্রাধ্যান ছিল। সরাকেরা জৈন ছিলেন।

সরাকের বর্তমান পরিস্থিতিঃ- সহজ সরল এই অনাড়ম্বর জাতিটি মানভূমে জৈন ও হিন্দু উভয় সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে আদর্শ নাগরিক জীবন যাবন করছে। আজ এই জাতিটিকে উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বোকার জেলার সমস্ত সরাক জাতিকে নিয়ে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে "সরাক সমাজ উন্নয়ন সমিতি" ইতিমধ্যে নানান উন্নয়ন তথা সংস্কারমূলক কাজে হাত দিয়েছে এই সমিতি ।সরাক সমাজে পণপ্রথা আজ ভয়ঙ্কর ব্যধির আকার ধারণ করেছে। সমাজের যুবকদের বিনাপণে বিবাহে উৎসাহ দিতে গ্রামে গ্রামে আলোচনা সভা ,পথনাটক এবং যে সকল যুবক বিনাপণে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন তাদেরকে "সরাকশ্রী"সম্মানে সম্মানিত করছে সমিতির পক্ষ থেকে। এছাড়াও সমাজের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে সমস্ত শিক্ষককে নিয়ে গঠিত হয়েছে "টিচার্স ফোরাম" এই ফোরামের সাথে যুক্ত সমস্ত শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্র ছাত্রীদের কোচিং দেন। যে সকল গ্রামে পাঠাগার নেই সেই সকল গ্রামে সরাক সমাজ উন্নয়ন সমিতির পক্ষ থেকে " সরাক সম্প্রীতি পাঠাগার" তৈ্রি করা হয়েছে।তৈ্রি হয়েছে অল ইন্ডিয়া জৈন মাইনরিটি সেল (সরাক সমাজ বিভাগ) ।এছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতিতে নিয়োজিত সরাক ব্যক্তিকে প্রদান করা হচ্ছে " সরাক গৌ্রব" সম্মান। ২০১৪ সালে এই সম্মান পেয়েছেন " সরাক জাতির হারানো ইতিহাস" পুস্তকের লেখক অমরেন্দ্রনাথ সরাক। ৬০ বৎসরের ঊর্ধ্বে বিশিষ্ট সরাক ব্যক্তিদের দেওয়া হয় "সমাজসেবী " সম্মান।এবং এই সকল সম্মান দেওয়া হয় প্রতি বৎসর "মহা সম্মেলনের দিন।২০১৪ সাল থেকে সমিতির দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৪ সম্পাদক- শ্রীলোক মাজী , সভাপতি -অপূর্ব মন্ডল, ২০১৫- সম্পাদক- রামনারয়ন মাজী, সভাপতি- তারাপদ মাজী, ২০১৬- সম্পাদক- তারকনাথ মাজী, সভাপতি- তারাপদ মাজী, টিচার্স ফোরাম - সম্পাদক- বীরেশ লায়েক, সভাপতি- ভূদেব চন্দ্র মন্ডল , অল ইন্ডিয়া জৈন মাইনরিটি সেল ( সরাক সমাজ বিভাগ) এর দায়িত্ব শ্রীলোক মাজী।

সর্বোপরি সরাক জাতির নিজস্ব ইতিহাস,কৃষ্টি এবং বিশেষত্বগুলি উজ্জীবিত রাখতে সরাক সমাজ উন্নয়ন সমিতি চালিয়ে যাচ্ছে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তথ্যপ্রসঙ্গে কয়েকটি গ্রন্থেরনাম'সরাকসংস্কৃতি'ও 'পুরুলিয়ার পুরার্কীতি'লেখক যুধিষ্ঠির মাজী। 'শ্রীতির্থঙ্কগীতাবলী'ও 'শ্রাবকাচার' লেখক হরিশচন্দ্র সরাক (নূতনডি)'Notes on tour in manbhum in 1864-1865' - - E.T Dalton. সরাকদের নামে গ্রাম 'সরাকডি। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা জুড়ে প্রচুর প্বার্শনাথ, মহাবীর, চন্দ্রপ্রভুর মূর্তি ও ধ্বংস স্তূপ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু মন্দির তৈরি করা হলেও সংরক্ষণের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই সব স্থানে কোন সরাক সম্প্রদায়ের মানুষের বাস নেই। এর সঠিক ইতিহাস জানা একান্ত প্রয়োজন। 'পাকবেড়্যা' প্রাচীন সরাক সংস্কৃতির সুবর্ণভূমি বলেছেন যুধিষ্ঠির মাজী। বুধপুরের চারটি ভগ্নাবশিষ্ট মন্দির সরাক নির্মিত বলেছেন -লে: বিভান। জৈন পত্নক্ষেএ গুলির নাম(পুরুলিয়া আনাইজামবাদ,শীতলপুর, ভাঙ্গড়া,পাকবেড়্যা,লাখেরা,ধাদকি(ধাদকিডি নয়),ললাড়া,বুধপুর,পারুলডিহা,ভাসারডাঙ্গা,তুসিয়ামা, মানবাজার, পলমা(আপনারা পলমা নয়),পদুনাড়া,ছররা, গোলমার, তেলকূপি, বান্দদেওল,পাড়া। সরাক সম্প্রদায়ের ইতিহাসের প্রচার ও প্রসার নেই বলে পরবর্তী প্রজন্ম সরাক সম্প্রদায়ে জন্ম গ্রহণ করেও সরাকসংস্কৃতির কিছুই জানতে পারছে না। এই তথ্যপ্রসঙ্গে কলমটি যোগ করেন বিকাশ চন্দ্র মন্ডল (শিক্ষক)সরাক সম্প্রদায়ভুক্ত গদীবেড়ো গ্রামের বাসিন্দা।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. Bibliography PC Bagchi, 'Development of Religious Ideas' in RC Majumdar (ed), History of Bengal, Vol-1, Dacca, 1968 (2nd edn);
  2. Kundu, Santosh Kumar (২০০৮)। Bangali Hindu Jati Parichay [An Introduction of Bengali Hindu Castes] (Bengali ভাষায়)। Kolkata: Presidency Library। পৃষ্ঠা 273–275। আইএসবিএন 978-81-89466-13-8 
  3. "> News Updates"। Www.Jainheritagecentres.Com। ২০০৯-০৯-০২। ২০১৫-১২-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৫-১৯ 

টেমপ্লেট:Jainism Topics