বিষয়বস্তুতে চলুন

১৯৩২ ভারত ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯৩২ সালে ভারত ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফর
 
  ইংল্যান্ড ভারত
তারিখ ২৯ এপ্রিল, ১৯৩২ – ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২
অধিনায়ক ডগলাস জারদিন সি. কে. নায়ডু
টেস্ট সিরিজ
ফলাফল ২ ম্যাচের সিরিজে ইংল্যান্ড ২–০ ব্যবধানে জয়ী

১৯৩২ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দল ‘নিখিল ভারত’ নামে ইংল্যান্ড গমন করেছিল।[] শুরুতে পোরবন্দরের মহারাজা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯১১ সালের পর এ সফরটি ইংল্যান্ডে ভারতের দ্বিতীয় সফর ছিল। ভারত দল সবেমাত্র আইসিসি’র পূর্ণাঙ্গ সদস্যের স্বীকৃতি পায়। জুনে লর্ডসে দলটি তাদের উদ্বোধনী টেস্ট খেলায় অংশ নেয়। এ সফরে দলটি একটিমাত্র টেস্টে অংশ নিয়েছিল। খেলায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল ১৫৮ রানে জয়লাভ করে। ২৫৯ ও ২৭৫/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। অন্যদিকে, ভারত দল ১৮৯ ও ১৮৭ তুলে দুইবারই অল-আউট হয়ে যায়।[]

এ সফরে ভারত দল ৩৭ খেলায় অংশ নেয়। তন্মধ্যে, ২৬টি প্রথম-শ্রেণীর খেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। খারাপ আবহাওয়ার কারণে কোন বল মাঠে গড়ানো বাদেই গুরুত্বহীন দুইটি খেলা পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়।[] দলটি নয়টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় জয়ী হয়, নয়টিতে ড্র করে ও আটটিতে পরাজয়বরণ করে। খেলার সময়সূচী বেশ ঢিলেঢালা ছিল। ২৯ এপ্রিল প্রথম খেলায় অংশগ্রহণের পর সর্বশেষ খেলাটি ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। খেলা এই ফলাফলের বিষয়ে উইজডেন মন্তব্য করে যে, কয়েকজন খেলোয়াড় এ সময়কে কাজে লাগাতে পারেননি। ফলশ্রুতিতে, দলে মাংসপেশীর টানের কবলে পড়ে আঘাতের ঘটনা ঘটে। এরফলে, শেষদিকের খেলাগুলোয় তারা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েন।[]

এ সফরে ডানহাতে ব্যাটিংয়ের অধিকারী সি. কে. নায়ডু ভারতের অসাধারণ ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সবগুলো প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ৪০.৪৫ গড়ে ১৬১৮ রান তুলেন। তন্মধ্যে, পাঁচটি শতরানের ইনিংস ছিল তার ও ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ করেন ১৬২ রান।[] এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৩ সালের উইজডেন সংস্করণে সি. কে. নায়ডুকে অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছিল।

অমর সিং ও মোহাম্মদ নিসার উদ্বোধনী বোলার হিসেবে যথেষ্ট সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। অমর সিং ২০.৩৭ গড়ে ১১১ উইকেট ও মোহাম্মদ নিসার ১৮.০৯ গড়ে ৭১ উইকেট পান। তন্মধ্যে, অমর সিং তিনবার খেলায় দশ উইকেট পেয়েছিলেন। ইনিংসে সেরা বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন ৮/৯০।[]

দলীয় সদস্য

[সম্পাদনা]

দলের খেলোয়াড় নির্বাচনের বিষয়ে রামচন্দ্র গুহ মন্তব্য করেন যে, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত’ হিসেবে ভারসাম্য রাখার প্রয়াস চালানো হয়।[] দলে সাতজন হিন্দু, চারজন মুসলিম, চারজন পারসি ও দুইজন শিখ খেলোয়াড়ের উপস্থিতি ছিল। তন্মধ্যে, বিজয় মার্চেন্টসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও জানুয়ারি, ১৯৩২ সালে মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এতে অংশ নেননি।[] পোরবন্দরকে অধিনায়কত্ব প্রদান করা হলেও তিনি এ সফরে খুব কমই অংশগ্রহণ করেন। মূল খেলায় সি. কে.নায়ডুকে অধিনায়কের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। টেস্ট খেলা থেকে পোরবন্দর ও সহঃ অধিনায়ক লিম্বডি দলের বাইরে চলে আসলে সি. কে. নায়ডু খেলা পরিচালনা করেন।[]

টেস্ট ক্রিকেট

[সম্পাদনা]
২৫-২৮ জুন, ১৯৩২
স্কোরকার্ড
উইজডেন
২৫৯ (১০৫.১ ওভার)
ডি. আর. জারদিন ৭৯
মোহাম্মদ নিসার ৫/৯৩ (২৬ ওভার)
১৮৯ (৯৩ ওভার)
সি. কে. নায়ডু ৪০
ডব্লিউ. ই. বোস ৪/৪৯ (৩০ ওভার)
২৭৫/৮ডি. (1১১০ ওভার)
ডি. আর. জারদিন ৮৫
এম. জাহাঙ্গীর খান ৪/৬০ (৩০ ওভার)
১৮৭ (৫৯.৩ ওভার)
এল. অমর সিং ৫১
ডব্লিউ. আর. হ্যামন্ড ৩/৯ (৫.৩ ওভার)
ইংল্যান্ড ১৫৮ রানে বিজয়ী
লর্ডস

  • ইংল্যান্ড টসে জয়ী হয়ে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়
  • ৩-দিনের টেস্ট

ব্যাটিং অবস্থান অনুযায়ী দল

[সম্পাদনা]

ইংল্যান্ড: পি. হোমস, এইচ. সাটক্লিফ, এফ. ই. ওলি, ডব্লিউ. আর. হ্যামন্ড, ডি. আর. জারদিন (অধিনায়ক), ই. পেন্টার, এল. ই. জি. অ্যামিস (উইকেট-রক্ষক), আর. ডব্লিউ. ভি. রবিন্স, এফ. আর. ব্রাউন, ডব্লিউ. ভোস, ডব্লিউ. ই. বোস

ভারত: জে. জি. নবলে (উইকেট-রক্ষক), নাউমল জিউমল, এস. ওয়াজির আলী, সি. কে. নায়ডু (অধিনায়ক), এস. এইচ. এম. কোলা, এস. নাজির আলী, পি. ই. পালিয়া, লাল সিং, এম. জাহাঙ্গীর খান, এল. অমর সিং, মোহাম্মদ নিসার

প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট

[সম্পাদনা]

লর্ডস টেস্টসহ ভারত দল ২৫টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশগ্রহণ করে। ১৭টি কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ দলের সবগুলোর বিপক্ষে খেলে। তন্মধ্যে, গ্ল্যামারগনল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে সফরকারীরা দুইবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। অন্য ছয়টি প্রথম-শ্রেণীর দলের মধ্যে - মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি), কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ডান্ডির ফোর্টহিলে স্কটল্যান্ড, ফোকস্টোনের চেরিটন রোডে ইংরেজ একাদশস্কারবোরা উৎসবে নর্থ মেরিন রোড গ্রাউন্ডে এইচ. ডি. জি. লেভেসন গাওয়ার একাদশের বিপক্ষে অংশ নেয়।[]

ঐ দলগুলোর বিপক্ষে দুইজন ভারতীয় খেলোয়াড় ভারতের পক্ষে অংশগ্রহণ করেননি। তারা হলেন দিলীপসিংজীইফতিখার আলি খান পতৌদি। উভয়েই ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলেছিলেন। তবে, তারা নিজ কাউন্টি দল সাসেক্সওরচেস্টারশায়ারের সদস্যরূপে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন।[] মে মাসে এমসিসির বিপক্ষে তৃতীয় ও খেলার শেষদিনে আবহাওয়ার কারণে ফলাফল আসেনি। খেলাটি ড্রয়ে গড়ালেও নায়ডু তার ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছিলেন। তার সংগৃহীত অপরাজিত ১১৮ রানের ইনিংসটি দলের মোট সংগ্রহের অর্ধেকেরও বেশি ছিল।[] গুহ এ প্রসঙ্গে বলেন যে, এ সফরে এটিই তার সেরা ইনিংস ছিল। একটি ছক্কা ‘ক্রিকেট স্বর্গ’ অতিক্রম করে বাইরে চলে যায়।[]

ইংল্যান্ড বাদে ভারতের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল কাউন্টি চ্যাম্পিয়ন ইয়র্কশায়ার দল। ভারতীয় একাদশ হ্যারোগেটে সেন্ট জর্জেস রোডে তাদের মুখোমুখি হয়। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় তারা ছয় উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে কম শক্তিধর দল নিয়ে ইয়র্কশায়ার মাঠে নেমেছিল। হার্বার্ট সাটক্লিফ খেলেননি। এরপর প্রথম দিনেই মরিস লেল্যান্ড আহত হলে দশজন ব্যাটিং করে। টসে ইয়র্কশায়ার জয় পায় ও ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। শনিবারের ঐ খেলায় নাউমল জিউমালের ৪৮ রানের কল্যাণে দলটি ১৬০ রানে অল-আউট হয়। হেডলি ভেরিটি ৬৫ রান খরচায় পাঁচ-উইকেট পান। দিন শেষে ইয়র্কশায়ার ১৪/২ করে। সোমবার দলটি ১৬১/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ভারত দল জর্জ ম্যাকাউলি ও হেডলি ভেরিটির তোপে পড়ে। ম্যাকাউলি তার খেলোয়াড়ী জীবনের ব্যক্তিগত সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ৮/২১ পান। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস মাত্র ২৫ ওভারব্যাপী স্থায়ী হয় ও মাত্র ৬৬ রানে গুটিয়ে যায়। স্মর্তব্য যে, নাজির আলী ৫২ রানের মূল্যবান অর্ধ-শতকের ইনিংস খেলেছিলেন। পরবর্তী সর্বোচ্চ সেরা ছিল অতিরিক্ত ৫ রান। মঙ্গলবার সকালে ইয়র্কশায়ার ৬৮/৪ তুলে জয় তুলে নেয়।[]

হ্যারোগেটে বাজে অভিজ্ঞতা লাভের পর ২০ থেকে ২২ জুলাই লর্ডসে অনুষ্ঠিত খেলায় মিডলসেক্সের বিপক্ষে দূর্দান্ত খেলে ভারতীয় দল। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলেও ৪০৯/৭ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। এরপর মিডলসেক্সকে ফলো-অনে ফেলে। জিওমল ও নায়ডু - উভয়েই সেঞ্চুরির দেখা পান।[১০] সফরের শেষ পর্যায়ে ভারত দলের আঘাত সমস্যা পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করেছিল। সেপ্টেম্বরে ফোকস্টোনের খেলায় ইংরেজ একাদশের বিপক্ষে ইনিংস ও ৪০ রানের ব্যবধানে পরাজয়বরণ করে। ঐ দলটি টেস্ট মানের ছিল না। ইংল্যান্ডে সর্বশেষ খেলা হিসেবে স্কারবোরা উৎসবে লেভেসন গাওয়ার একাদশের মুখোমুখি হয়। আবারও দলটি বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হয়। তবে, আবহাওয়ার কারণে এবার তারা রক্ষা পায়। দ্বিতীয় দিনের পুরোটা সময় নষ্ট হয় ও ড্রয়ে পরিণত হয়।[১১]

অন্যান্য খেলা

[সম্পাদনা]

বিভিন্নমানের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তেরোটি গুরুত্বহীন খেলায় ভারত দল অংশ নেয়। এক পর্যায়ে সুদূর উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা মোরের এলগিনে খেলায় অংশ নিয়েছিল। পনেরোটি গুরুত্বহীন খেলার আয়োজন করা হলেও অল্ডারশট ও সান্ডারল্যান্ডের খেলা দুটি মন্দ আবহাওয়ায় পরিত্যক্ত হয়। শেষের খেলাটি তৎকালীন মাইনর কাউন্টিজ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপের সদস্য ডারহামের বিপক্ষে ছিল। ভারত দল অন্য চারটি মাইনর কাউন্টিজ দলের বিপক্ষে খেলে।[]

কেবলমাত্র একটি গুরুত্বহীন খেলায় ভারত দল পরাজয়বরণ করে। পশ্চিম ব্রিজফোর্ডের ওয়েস্ট পার্কে স্যার জুলিয়ান কান একাদশের বিপক্ষে ইনিংস ও ২৬ রানে পরাজিত হয়। কেবলমাত্র কান ব্যতীত দলটি প্রায় কাউন্টি শক্তিধর ছিল। দলটিতে ওয়াল্টার রবিন্স, ডেনিস মরকেল, লেন রিচমন্ডজর্জ হিনের ন্যায় খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণ ছিল।[১২]

প্রভাব

[সম্পাদনা]

উইজডেন এ সফরকে ঘিরে মন্তব্য করে যে, গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় দল নিজেদেরকে মেলে ধরার চেষ্টা করে। আগমনের পর তাদের এ চেষ্টা দ্বিগুণ ছিল। নিঃসন্দেহে তারা যে অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মাঝে প্রবাহিত হতে থাকে।[]

ডিসেম্বর, ১৯৩৩ সালে ভারত দল তাদের পরবর্তী টেস্ট খেলায় অংশ নেয়। এবার নিজ দেশে টেস্ট আয়োজন করে। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে ইংরেজ দল তিন খেলায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করে। সফরকারীরা ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে। এবারও উভয় দলকে সি কে নায়ডু ও ডগলাস জারদিন অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

বার্ষিক পর্যালোচনা

[সম্পাদনা]
  • Wisden। Caine, C. Stewart, সম্পাদক। Wisden Cricketers' Almanack, 70th edition (1948 সংস্করণ)। London: John Wisden & Co. Ltd। 

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]
  • Bill Frindall, The Wisden Book of Test Cricket 1877-1978, Wisden, 1979