সফিউদ্দীন আহমেদ
[১][২]বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জগতে শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ এক অনন্য শিল্পী ব্যক্তিত্ব । তিনি ১৯২২ সালের ২০ জুন কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন ।
তিনি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন । তাঁকে বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক বলা হয় । ছাপচিত্রের পাশাপাশি তিনি জলরং , তেল রং - সহ অনেক মাধ্যমে শিল্পকর্ম রচনা করে বাংলাদেশের শিল্পকলার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন । বাংলাদেশের শিল্পকলার জগতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে " শিল্পগুরু ' উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।
শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে সেখান থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । পরবর্তী কালে তিনি যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস্ থেকে এচিং ও এনগ্রেভিং বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন ।
তিনি শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে একসঙ্গে ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন । এই শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে চারুকলাঅনুষদ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত ।১৯৩৬-৪১ সালের মধ্যে সফিউদ্দিন আহমেদ বিহারের মধুপুর , দেওঘর , জেসিডি , গিরিডি , চাইবাসা , ঝাঝা প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে ছবি আঁকেন । এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালে তিনি গিয়েছেন সাঁওতাল পরগনার দুমকা অঞ্চলে । দুমকা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আঁকা চিত্রমালা শিল্পী হিসেবে তাঁকে গুরুত্বপূর্ন করে তোলে । আর্ট স্কুলে ফাইন আর্ট বিভাগে অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে তিনি জলরং ও তেলরঙে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি উড এনগ্রেভিং মাধ্যমটিও গভীরভাবে রপ্ত করেন ।
নব্বইয়ের দশকে তিনি রেখাচিত্রে ছবি আঁকেন যা ' ব্ল্যাকসিরিজ ' বা ' কালো চিত্রমালা ' নামে পরিচিত । তার শিল্পকর্মে ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ছবি উঠে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে । ১৯৬৪ সালে তাঁর ‘ বন্ধ মাছ ' শীর্ষক চিত্রে মাছের চোখটি তার বদ্ধাবস্থাজনিত প্রতিবাদ প্রকাশ করছে । আশির দশকে তিনি সরাসরি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে , আঁকলেন ‘ কান্না ' , ' একুশে স্মরণে ' , ‘ একাত্তরের স্মৃতি ' , ‘ একাত্তরের স্মরণে ' শীর্ষক শিল্পকর্ম । এসব শিল্পকর্মে শিল্পী ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন । বাংলাদেশের শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে ' একুশে পদক ' লাভ করেন । এছাড়া তিনি ১৯৮৫ সালে ' বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো ' মনোনীত হন এবং ১৯৯৬ সালে ' স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ' লাভ করেন । ১৯ মে ২০১২ সালে এই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন ।
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]সফিউদ্দিন ১৯২২ সালে কলকাতায় জন্ম নেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে এখান থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস্ থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয় বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।[২] ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ধানমন্ডিতে চলে আসেন।[২]
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালে থেকে। চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন ছাপচিত্রে। তাঁর কিছু অসাধারণ কাজের মাধ্যমে তিনি ভারতের কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।[৩] বাংলাদেশের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারক আলভী, ফরিদা জামান, আবুল খায়ের, সুবীর চৌধুরী সফিউদ্দিন আহমেদের কাজের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।[৪]
শৈলী ও প্রযুক্তি
[সম্পাদনা]দুই বাংলার রঙ তার কাছে ছিল ভিন্ন। তাই পশ্চিম বাংলার প্রকৃতির ধূসরতা এবং বাংলাদেশে নীলাভ সবুজের ছড়াছড়িকে মিশিয়ে নিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তার কাজে পরিস্ফুিটিত হয় লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য। কালো রঙের প্রতি দুর্বলতা ছিলো তার তাই কালো রঙের অনুশীলনের জন্যে ত্রিশ-চল্লিশের দশকেই শিয়ালদা স্টেশনে গেছেন রাতের বেলার কালো রঙ দেখতে। যুক্তরাজ্যে তিনি কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে তিন বছরের মতো সময়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে রেখাচিত্র আঁকেন যা "ব্ল্যাক সিরিজ" বা "কালো চিত্রমালা" নামে পরিচিত। তার শিল্পকর্মে ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি উঠে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে রচনার মাধ্যমে। তার কলিকাতায় আঁকা ছবিতে এসেছে মহানগরের বস্তিজীবন, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন এবং ঢাকায় আঁকা ছবিতে বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি নানা শ্রমজীবী মানুষ।[২]
মৃত্যু
[সম্পাদনা]১৯ মে ২০১২ শনিবার রাত ১২টা ২০ মিনিটে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান শিল্পী সফিউদ্দীন।
পুরস্কার এবং সম্মাননা
[সম্পাদনা]শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ তার জীবনে অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন।
তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সাথে ও অন্যান্য শিল্পীরা মিলে একসঙ্গে ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।
তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা একাডেমী অব ফাইন আর্ট প্রদত্ত একাডেমী প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি অর্জন করেন ভারতের পার্টনার শিল্পকলা পরিষদের দেওয়া ‘দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক’(১৯৪৭ সাল), পাকিস্তান সরকারের দেয়া ‘প্রেসিডেন্ট পদক’ ১৯৬৩ সালে, বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ‘একুশে পদক’ (১৯৭৮ সাল) এবং ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ (১৯৯৬ সাল)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ছাপচিত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত।
২০০৮ সালে ২৩শে জুন প্রচারবিমুখ এই গুণী শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী 'রেখার অশেষ আলো' অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে যা উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শিল্পীর ছাত্র শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, "তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই, ধৃষ্টতাও নেই। তার চিত্রকর্মের যে বিশালতা, বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা এবং ড্রইংয়ে রংয়ের প্রলেপ, যেভাবে লাইন টেনেছেন তা শুধু অনুধাবন করার বিষয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ সৈয়দ আজিজুল হক (নভেম্বর ১০, ২০১০)। "অশেষ আলোর আধার"। দৈনিক প্রথম আলো। ২০১৭-০৩-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২৮, ২০১৪।
- ↑ ক খ গ ঘ "ছাপচিত্রের স্রষ্টা সফিউদ্দীন আহমেদ"। bdnews24.com। মে ১৯, ২০১৪। ১১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২৮, ২০১৪।
- ↑ http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2010-11-26&ni=40291[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০১৮-০৬-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১২-২৯।