পূতনা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কেরালায় ১৭ শতকের কাঠের ভাস্কর্য - শিশুু শ্রীকৃৃষ্ণের সাথে পুতনা রাক্ষসী

পূতনা বা পুতনা হলো একজন রাক্ষসী (খেচরী), যাকে শিশু-দেবতা শ্রীকৃষ্ণ বধ করেছিল। কংসের আদেশে পূতনা এক যুবতী সুন্দরী মহিলার ছদ্মবেশ ধারণ করে, বিষাক্ত দুধ খাইয়ে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষ্ণ তার স্তন্যপানের মাধ্যমে তার জীবন চুষে নেয় এবং সে মৃত্যু বরণ করে। পূতনাকে কৃষ্ণের দাঈ-মা হিসেবেও বিবেচনা করা হয় কারণ তিনি তাকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। পূতনা তার স্তন্য দানের মাধ্যমে, তার অসৎ উদ্দেশ্যের ছায়ায় "মাতৃত্বের সর্বোচ্চ কাজ" সম্পাদন করেছিলেন।[১]

ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

"পুতানা" শব্দটি "পুত" (গুণ) এবং "না" (না) হিসাবে ভাঙা মানে "পুণ্য বর্জিত"। আরেকটি ব্যাখ্যা "পুতানা" থেকে এসেছে "পুতা" (শুদ্ধিকরণ), এইভাবে অর্থ "তিনি যিনি শুদ্ধ করেন"। হার্বার্ট তাত্ত্বিকভাবে "পুতানা" শব্দটি "পুট" থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা হিন্দু পুরাণের একটি নরক, পিতামাতা এবং সন্তানদের সাথে সম্পর্কিত।[২] এইভাবে, হার্বার্ট ব্যুৎপত্তি এবং মাতৃকাদের সাথে তার সংযোগের ভিত্তিতে প্রস্তাব করেন যে পুটানা মাতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।[৩]

পুতনা বধ[সম্পাদনা]

পুতানা এবং কৃষ্ণের কিংবদন্তি কাহিনী ভাগবত পুরাণ, হরিবংশ (মহাভারতের পরিশিষ্ট ), ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, গর্গ সংহিতা এবং প্রেম সাগরসহ অনেক হিন্দু গ্রন্থে বর্ণিত আছে।

পুতনার মৃত্যু, miniature c. ১৯২৫

কংস শিশু কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য পুতনাকে প্রেরণ করেছিলেন। পূতনা মায়াবলে গোকুলে নন্দ মহারাজের গৃহে প্রবেশ করে। এক অতি রূপবতী রমণীর রূপ ধারণ করে সে যশোদা মায়ের ঘরে প্রবেশ করল। পূতনা নানা রকম যাদুবিদ্যা জানত। সেই যাদুবিদ্যার প্রভাবে সে কি অপূর্ব সুন্দরী যুবতীর বেশ ধারণ করল। তার উন্নত নিতম্ব, নিটোল কুচযুগল, কানে দুল এবং কেশপাশে ফুলমালায় বিভূষিতা হয়ে সে এক অপূর্ব সুন্দর রূপ ধারণ করল। তার ক্ষীণ কটিতট তাকে বিশেষভাব সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলেছিল। মৃদু হাস্যে ভ্রু-ভঙ্গি করে সে সকলের দিকে তাকাতে লাগল, এবং সমস্ত ব্রজবাসীরাই তার রূপে মোহিত হল।

পূতনা যখন শিশু শ্রীকৃষ্ণকে তার কোলে তুলে নিচ্ছিল, তখন রোহিণী এবং যশোদা উভয়েই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাকে নিষেধ করেননি, কেননা সে এত সুন্দর সজ্জায় ভূষিতা ছিল আর তা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সে যে বাৎসল্য স্নেহ প্রদর্শন করেছিল, তাতে তাঁদের মনে কোন সন্দেহ স্থান পায়নি। তাঁরা বুঝতে পারেননি যে, সে একটা সুন্দর খাপে ঢাকা তলোয়ার। পূতনা তার স্তনে অতি তীব্র বিষ লাগিয়ে এসেছিল এবং শিশু শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়েই সে তৎক্ষণাৎ তাঁকে তার স্তন দান করল, যাতে সেই স্তন্য পান করা মাত্রই তাঁর মৃত্যু হয়। শ্রীকৃষ্ণ ক্রুদ্ধভাবে তৎক্ষণাৎ সেই স্তন করে দুগ্ধরূপী বিষের সঙ্গে সেই রাক্ষসীর প্রণবায়ুও শোষণ করে নিল। এর ফলে সে বিকটভাবে আর্তনাদ করতে করতে যখন তার মৃত্যু হল, তখন চারদিকে এক প্রচন্ড শব্দ হল, নদ-নদী, গিরি, তরু, ধরণী কেঁপে উঠল। লোকেরা মনে করল যেন চারদিকে বজ্রপাত হচ্ছে। তার বিশাল শরীরের পতনে ফলে ছয়-ক্রোশ জায়গা জুড়ে সমস্ত গাছপালা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। তার সেই অতি বিশাল শরীর দেখে সকলেই বিষ্ময়াভিভুত হয়ে পড়েছিল। তার মুখের দাঁতগুলি ছিল লাঙ্গলের ফলার মতো তীক্ষ্ণ, নাসারম্ব্র পর্বত-গহ্বরের মতো গভীর, তার স্তনদ্বয় গিরিশিখরচ্যুত শিলাখন্ডের মতো গভীর, তার কেশরাশি বিক্ষিপ্ত এবং তাম্রবর্ণ, চোখ দু’টি অন্ধকুপের মতো গভীর, জঙ্ঘদ্বয় নদীর দু’টি তটের মতো, তার হাত দু’টি সেতুর মতো এবং তার উদর জলশূন্য হ্রদের মতো মনে হচ্ছিল। তার পতনের ভীষণ শব্দে গোপ এবং গোপিকাদের কর্ণ বিদীর্ণ হল এবং প্রচন্ডভাবে হৃৎকম্প হতে লাগল। এইভাবে পূতনা রাক্ষসীর বিভীষিকা সমাপ্ত হল।

শ্রীকৃষ্ণ এতই কৃপাময় যে, সেই রাক্ষসী যেহেতু তার বুকের দুধ দান করবার জন্য তাঁর কাছে এসেছিল, তাই তিনি তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন এবং তার সেই কার্যকলাপ মাতৃবৎ বলে গ্রহণ করেছিলেন। আর তার বীভৎস্য কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য তাকে তৎক্ষণাৎ সংহার করেছিলেন। আর শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা নিহত হওয়ার ফলে সে মুক্তি লাভ করেছিল।

পুতনার পূর্ব জন্মের কাহিনী[সম্পাদনা]

গর্গ সংহিতা ( কৃষ্ণের জীবনের উপর একটি রচনা) এবং ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ আরও বর্ণনা করে যে পুতনার পূর্বজন্ম রত্নামালা রূপে দানব রাজা বলির কন্যা । যখন তিনি কৃষ্ণের পূর্ববর্তী অবতার বামনকে বামন হিসাবে দেখেছিলেন , তখন তিনি তাকে তার পুত্র হিসাবে গ্রহণ করতে এবং তাকে দুধ পান করার ইচ্ছা অনুভব করেছিলেন। তিনি শীঘ্রই তার মন পরিবর্তন করেন এবং বামনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, যখন তিনি তার পিতাকে পরাভূত করেন এবং তার সম্পত্তি অর্জন করেন। কৃষ্ণ তার আকাঙ্ক্ষা জানতেন এবং তাকে উভয়ই পূরণ করতে দিয়েছিলেন - তাকে স্তন্যপান করাতে এবং তার জীবন নেওয়ার চেষ্টা করতে।[৪] [৫]

অন্যান্য তথ্য[সম্পাদনা]

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং ভারতীয় বইসমূহে বহুল প্রচলিত, যেখানে তাকে বিভিন্নভাবে একজন দুষ্ট রাক্ষসী হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে; এবং এও বলা হয়েছে যদিও সে প্রাথমিকভাবে মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল, সে নিজেকে কৃষ্ণের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিল।

পূতনাকে কখনো কখনো শিশু রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় যা শিশুদের জন্য বিপদসঙ্কুল অবস্থা বোঝায়। আবার এটিকে পাখি হিসেবেও কল্পনা করা হয় যাকে কামনা বাসনার জন্য খারাপ প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এমনকি প্রতীকী খারাপ মা হিসাবেও বলা হয়ে থাকে। তিনি মাতৃকা নামক নৃশংস হিন্দু মাতৃদেবীদের একটি দলের অন্তর্ভুক্ত। একইসাথে যোগিনী এবং গ্রাহণীদের দলেরও অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা গ্রন্থে শিশুদের রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য তার পূজার কথা বলা হয়েছে।প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে একাধিক পূতনার একটি গোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে।

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. O'Flaherty p.250
  2. Herbert in Shashi p.844
  3. Herbert in Shashi p.846
  4. shanti lal nager। Brahmavaivarta Purana (Part 2)। পৃষ্ঠা 81 
  5. Herbert in Shashi p.845

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]