দাওরা হাদিস
সংক্ষেপ | তাকমিল/ দাওরা |
---|---|
ধরন | স্নাতক |
উন্নতিকারক / পরিচালক |
|
পরীক্ষার বিষয়সমূহ | ১১টি বিষয়: |
উদ্দেশ্য | কওমি মাদ্রাসাসমূহের লেখাপড়ার মান নিয়ন্ত্রণ করা |
প্রথম গ্রহণ |
|
শেষ গ্রহণ | ২০২৪ |
পরীক্ষার সময় | হিজরি সালের শাবান মাসের ১৫–২৯ তারিখ |
নম্বর / গ্রেডের সীমা | ৩৩–১০০ |
যতবার হয় | প্রতিবছর ১ বার |
দেশ / অঞ্চল | বাংলাদেশ, পাকিস্তান |
ভাষা | আরবি, বাংলা, উর্দু |
পরীক্ষার্থীদের বার্ষিক সংখ্যা | ৩১, ৯৯৯ ( ২০২৪; বাংলাদেশ) |
যোগ্যতা | স্নাতক |
উত্তীর্ণের হার | ৮৮.৩৭% (২০২৪) |
ফি | বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত। |
দাওরা-এ-হাদিস বা দাওরায়ে হাদিস অথবা দাওরা হাদিস বা তাকমিলুল হাদিস (আরবি: تكميل الحديث; উর্দু: دورۂ حدیث) হলো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দরসে নিজামি দ্বারা পরিচালিত কওমি তথা দেওবন্দি মাদ্রাসামসূহের সর্বোচ্চ শ্রেণির নাম। বর্তমান দাওরার পরে তাখাস্সুস (আরবি: التخصص ; বা. বিশেষায়িত কোর্স) নামে কিছু বিশেষ কোর্স প্রচলিত আছে, যা দাওরা হাদিস সমাপ্ত করার পর সম্পন্ন করা যায়। দাওরা হাদিস সম্পন্নকারী একজন ছাত্রকে সাধারণত মাওলানা, ফাযেল/আলেম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দারসে নিজামি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে দাওরা হাদিস পর্যন্ত কোর্সের ব্যাপ্তি ১৬/১৭ বছর।[১] এর সাথে হিফজুল কুরআন যোগ করা হলে তার ব্যাপ্তি ২০ বছর পর্যন্ত হয়।
বাংলাদেশে প্রথম ১৯০৮ সালে দারুল উলুম হাটহাজারিতে দাওরা হাদিস জামাত (শ্রেণি) চালু করা হয় এবং বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি দাওরা হাদিস মাদরাসা রয়েছে।[২] ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবিতে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান করে।[৩][৪][৫][৬][৭][৮]
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]দাওরাহ ( الدَوْرَة ) শব্দটি আরবি, যার অর্থ পরিক্রমণ, কোর্স অথবা কোনো কাজ বারবার করা। এই শ্রেণিতে হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ সকল কিতাব পাঠদান করানো হয় হিসেবে এ শ্রেণির নাম দাওরায়ে হাদিস নামকরণ করা হয়। [৯]
তাকমিল (التكميل) শব্দটিও আরবি, যার অর্থ পরিপূর্ণ করা। এই শ্রেণিতে সিহাহ সিত্তাহর কিতাবসহ হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ সকল কিতাব পাঠদান করা হয় হিসেবে এ শ্রেণির নাম তাকমিলুল হাদিস নামকরণ করা হয়। [৯]
ব্যাপ্তিকাল
[সম্পাদনা]কওমি সিলেবাস দারসে নিজামি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়তে একজন ছাত্রকে ১৬/১৭ বছর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হয়। এর সাথে হিফজুল কুরআন পড়তে হলে তাকে আরো অতিরিক্ত ৩/৪ বছর ব্যয় করতে হয়।
বেফাক বোর্ডের সহ–সভাপতি ও বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক মহাসচিব মু. ফয়জুল্লাহ বলেন, “দাওরা হাদিস পর্যন্ত পড়ালেখা করতে মোট ১৭ বছর লাগে। সেই সাথে যারা কুরআন হেফজ (মুখস্ত) করেন তাদের আরো অধিক ৪ বছর ব্যয় করতে হয়। কোনো অংশেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে কম সময়ে কওমি শিক্ষার্থীরা দাওরা হাদিস সমাপ্ত করেন না।
দাওরা হাদিস পর্যন্ত শ্রেণিসমূহের ধারাবাহিকতা এমন:
- আল মারহালাতুল ইবতেদায়িয়্যা (প্রাথমিক স্তর): মোট ৫ বছর; শিশু শ্রেণি, নুরানি ১ম, ২য়, ৩য় শ্রেণি এবং নাজেরা।
- আল মারহালাতুল মুতাওসসিতা (নিম্ন মাধ্যমিক স্তর): ৩ বছর; ইবতেদায়ী (উর্দু), তাইসির (ফার্সি) ও মিজান শ্রেণি।
- আল মারহালাতুস সানুবিয়্যা আম্মা (মাধ্যমিক): ২ বছর; নাহবেমির ও হেদায়াতুন্নাহু শ্রেণি।
- আল মারহালাতুস সানুবিয়্যা আল খাসসাহ (উচ্চ মাধ্যমিক): ২ বছর; কাফিয়া ও শরহে জামি শ্রেণি।
- আল মারহাতুল ফাজিলা (স্নাতক): মোট ৪ বছর; শরহে বেকায়া, হেদায়া, জালালাইন ও মেশকাত শ্রেণি (অথবা শরহে বেকায়া, হেদায়া, দওম ও উলা শ্রেণি)।
- আল মারহালাতুত তাকমীল (স্নাতকোত্তর): মোট ১ বছর। এই শ্রেণিকেই দাওরা হাদিস বলা হয়। [১০]
সিলেবাসভুক্ত গ্রন্থাবলি
[সম্পাদনা]দাওরায়ে হাদিসে নিম্নোক্ত হাদিসের গ্রন্থাবলী পাঠদান করা হয়:[১১]
- সিহাহ সিত্তাহর ছয়টি গ্রন্থ: [১]
- সিহাহ সিত্তাহর বাইরে: [১]
প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন
[সম্পাদনা]২০১০ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার শিক্ষানীতি ঘোষণাকালীন দেশের কওমিমাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন এবং শাহ আহমদ শফির নেতৃত্বে ২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে সরকার একটি কমিশন গঠন করেন। [৪]
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই এপ্রিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান ঘোষণা করেন। সেদিন গণভবনে বাংলাদেশী আলেমদের এক অনুষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এর আলোকে এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে। এ প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, কওমি মাদ্রাসাসমূহের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলী বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের সব মূলনীতিকে ভিত্তি করে কওমি মাদ্রাসাকে এই সমমান দেওয়া হয়েছে। [৫]
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে "আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের' অধীন ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল, ২০১৮’ আইনটি পাস হয়। [৫] উক্ত আইন পাস হলেও সনদের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সমালোচনা
[সম্পাদনা]দাওরা হাদিস আইনটি পাস হওয়ার পর বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাবিদ এর ধরণের সমালোচনা করেন। [৭] জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সরকার কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে যেহেতু স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই এর জন্য কিছু সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। [১২]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড আখতারুজ্জামান বলেন, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নীতি রয়েছে। তাই তাদেরও ভর্তির জন্য নীতিমালা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। [১২]
আলিয়া মাদরাসাভিত্তিক আহলে সুন্নত নামের একটি সংগঠনের কিছু নেতা কর্মী দাবি করেন যে, দেশের সব মাদ্রাসায় (আলিয়া ও কওমি) এক ও অভিন্ন পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা উচিত; অন্যথায় কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যার আশংকা থেকে যায়। সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র সিলেবাসের বিরোধীতা করে। [৭]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলেন যে, কওমী শিক্ষার্থীদের ডিগ্রির সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তবে এই ডিগ্রি যে প্রক্রিয়ায় দেওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে। [৭]
এ সব সমালোচনার জবাবে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন যে, যখন দেশে ইসলামী শক্তি সম্মান অর্জন করে এবং দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে– তখন কিছু মানুষ এর বিরোধীতা করবেই। ফয়জুল্লাহ মনে করেন, সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে কওমি শিক্ষার্থীদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মু. ফয়জুল্লাহ আরো বলেন যে, ইসলামের আসল শিক্ষা এবং জীবনাদর্শকে সামনে রেখেই কওমি শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এছাড়াও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেই সনদের কার্যকারিতা নিয়ে কাজ শুরু হবে তিনি জানান। [৭] [১৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ "যা আছে দাওরায়ে হাদিস সিলেবাসে"। Bangla Tribune। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ "আল-হাইয়া; নিবন্ধভুক্ত মাদরাসা"। hems.alhaiatululya.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৭।
- ↑ "মাস্টার্সের সমমান পাচ্ছে দাওরায়ে হাদিস"।
- ↑ ক খ "মাস্টার্সের সমমান পেলো দাওরায়ে হাদিস"। banglanews24.com। ২০১৮-০৮-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ ক খ গ রিপোর্টার, স্টাফ। "দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে আইন অনুমোদন"। DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ "দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে গেজেট"।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমপর্যায়ের ডিগ্রি হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার পর ইসলামপণ্থী দলগুলোতে মতপার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়েছে"। BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ "দাওরা হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান প্রদান আইন ২০১৮"।
- ↑ ক খ "দাওরায়ে হাদিস কি? - Ask Answers"। www.ask-ans.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ "কওমি মাদ্রাসার ক্লাসের নাম সমূহ ২০২৪ জানুন! - Amar Sikkha" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৯-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৭।
- ↑ "দাওরায়ে হাদিসে কী পড়ানো হয়?"। www.amadershomoy.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ ক খ "দাওরায়ে হাদিস সনদের স্বীকৃতি মান নিয়ে আবারো প্রশ্ন"। amarsangbad.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০৭-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।
- ↑ "বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্সের সমান মর্যাদা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা"। BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৬।