গোপীনাথ মন্দির, পাবনা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জোড় বাংলা মন্দির
ধরনপ্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
অবস্থানরাধানগর,পাবনা সদর উপজেলা
অঞ্চলপাবনা জেলা
পরিচালকবর্গবাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর
মালিকবাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর
সূত্র নংBD-E-49-63

জোড় বাংলা মন্দির পাবনা জেলার পাবনা সদর উপজেলার দক্ষিণ রাঘবপুরের জোড়বাংলা পাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।[১] ইহা পাবনা সদর পৌরসভার অন্তর্গত ৪ নং ওয়ার্ড এলাকায় অবস্থিত।

মন্দিরের সম্মুখভাগের খিলানগুলির উপরের টেরাকোটা ফলকগুলি রাম ও রাবণের সৈন্যবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধকে প্রদর্শিত করত, যা এখন ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তৎকালীন সময়ে সম্মুখভাগের অলঙ্করণগুলি জনপ্রিয় ধর্মীয় গ্রন্থ রামায়ণমহাভারতের চাক্ষুষ চিত্র হিসাবে কাজ করেছিল।

বর্তমানে মন্দিরটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে।

অবস্থান[সম্পাদনা]

পাবনা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কালা চাঁদ পাড়া জোড়-বাংলা শৈলীর গোপীনাথ মন্দির অবস্থিত। মন্দিরেরে ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক হল ২৪°০.০৯০´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৯°১৪.৭০১´ পূর্ব দ্রাঘিমা অক্ষাংশ। এটি পূর্বমুখী একটি মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণে প্রায় ৫০ মিটার দূরত্বে রয়েছে কানা পুকুর। এই জোড়-বাংলা মন্দিরটি নীচের অংশে কুলুঙ্গি সহ চারপাশে বাড়িঘর ঘেরা একটি খোলা জায়গার মাঝখানে একটি সামান্য বাঁকা ভিত্তিবেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

পটভূমি[সম্পাদনা]

ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে বাংলায় মন্দির নির্মাণ কার্যক্রমের একটি পুনরুজ্জীবন প্রত্যক্ষ করা হয়। এছাড়াও, চৈতন্যের দ্বারা ভগবানের (কৃষ্ণ) ভক্তি ধারণা প্রচারের ফলে গদ্য ও কবিতার আকারে স্থানীয় সাহিত্যের একটি স্রোতের সাথে মিলিত হওয়ার ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব মন্দির নির্মাণের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। এই সময়ে বিকশিত অনেকগুলি মন্দির শৈলীর মধ্যে চালা শৈলীর মন্দির সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল, যা ঘরোয়া কুঁড়েঘরের প্রতিরূপ। পাবনার গোপীনাথ মন্দির সহ জোড়-বাংলা মন্দিরগুলি এই চালা শৈলীর অন্তর্গত।

নতুন দিল্লিস্থিত ন্যাশনাল মিউজিয়াম ইনস্টিটিউট অব দি হিস্ট্রি অফ আর্ট, কনজারভেশন অ্যান্ড মিউজোলজি-এর গবেষক মৃন্ময়ী রায় চিত্রলেখা জার্নালে মন্দির নির্মাণের দুটি ভিন্ন কারণ বা প্রেক্ষাপটকে উল্লেখ করেছেন, সেগুলি হল- প্রথমত, মন্দিরের নির্মাণ সমসাময়িক সমাজে ক্ষমতা ও পরিচয়ের সংগ্রাম হিসেবে ধরা ও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মন্দির নির্মাণের কার্যকলাপ একটি প্রতীক ও সুরক্ষিত সম্পদের প্রমাণ ছিল এবং এইভাবে মন্দিরটি নতুন শক্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে এবং কর্তৃত্ব ও সামাজিক স্বীকৃতির সন্ধান করেছিল। দ্বিতীয়ত, নিজেকে একজন ধার্মিক ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি (রাধাকৃষ্ণের ভক্ত) হিসাবে উপস্থাপন করে, তিনি তার সম্পদকে বৈধতা দেওয়ার এবং সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থায় স্বীকৃতি ও পরিচয়ের সন্ধানের একটি পরিচিত উপায় অনুসন্ধান করেছিলেন।

১৮৫৬-৫৭–১৯১০: নির্মাণ ও পূজার্চনা[সম্পাদনা]

প্রামাণিক নথির অনুপস্থিতি এবং অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণকাল সম্পর্কে বিভিন্ন পার্থক্য ও অসমতা পরিলক্ষিত হয়। এই পরিস্থিতিতে, এই মন্দিরটিকে একটি নির্দিষ্ট কালানুক্রমিক কাঠামোর মধ্যে রাখা সম্ভবপর নয়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, জোড় বাংলা মন্দিরটি উনবিংশ শতাব্দীর (১৮০১–১৯০০) মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। রাধারমণ সাহা কর্তৃক প্রত্তত তথ্য ও বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক (ব্রজমোহন ক্রোড়ী) দ্রুত তার সম্পদ অর্জন করেছিলেন তবে নবাবী শাসনামলে জমিদারদের মতো উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়। মুর্শিদাবাদ নবাবের তহশীলদার, ব্রজমোহন ক্রোড়ী মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে মন্দিরটি আবিষ্কারের সময় কোন শিলালিপি পাওয়া না যাওয়ায় এর সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় না।

মানচিত্রে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলির মধ্যে পাবনার উল্লেখ করা হয়েছে।[২]

আসাম রাজ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ৮.২-৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যা "১৯৮৭ আসাম ভূমিকম্প" নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে মন্দিরের বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

রাধারমণ সাহা রচিত পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, এখানে গোপীনাথের মূর্তি ছিল এবং নিয়মিত তার পূজাও হতো। গোপীনাথের পূজার কারণেই মন্দিরটি গোপীনাথের মন্দির বা গোপীনাথ মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এখানে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি ছিল বলেও জানা যায়। মন্দিরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও পূজার্চনা হয়েছে, এবং এটি একটি উপাসনালয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। গোপীনাথের মূর্তিটি ১৯১০ সালে স্থানীয় কালী মন্দিরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন থেকে তা ওখানেই আছে।

১৯১০–বর্তমান[সম্পাদনা]

ভারত বিভাজনের পর মন্দিরটি দীর্ঘদিন যাবত অনাদরে ও অবহেলায় পড়ে ছিল, যার ফলে মন্দিরের স্তম্ভ, দেয়াল ও অলংকরণসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরেছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসন-আমলে ১৯৬০-এর দশকে পাবনা জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় মন্দিরটির আমূল সংস্কার করা হয়েছিল।

স্থাপত্য[সম্পাদনা]

ছবিতে, "পশ্চিম দিকের চালা" (গর্ভগৃহ) বাম পাশে এবং "পূর্ব দিকের চালা" (মণ্ডপ) ডান পাশে দেখা যাচ্ছে।

গোপীনাথ মন্দিরের অভ্যন্তর ও বহির্ভাগ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুটি কক্ষে, মন্দিরটি তার ঢালু ছাদ প্রাথমিক চালা শৈলীর উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা এই সময়ের মধ্যে নির্মিত বাংলার হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণ ছিল।

পাবনার গোপীনাথ মন্দির হল একটি সরল জোড়-বাংলা মন্দির, যেখানে দুটি দো-চালা কাঠামো একত্রে মিলিত হয়ে একক নিরবিছিন্ন চালা গঠন করেছে। পূর্ব দিকের চালাটি মণ্ডপ হিসেবে কাজ করে এবং পশ্চিমে দিকের চালাটি গর্ভগৃহ হিসাবে কাজ করে। মন্দিরটি ইট নির্মিত একটি মঞ্চের উপর নিমান নির্মিত হয়েছে।

মন্দিরের তিনটি খিলানাকার প্রবেশ পথ রয়েছে, যেগুলো ৪ টি স্তম্ভের সাহায্য নির্মাণ করা হয়েছে। খিলানের বহির্ভাগে সরুকারী ভুস্বায়া পরিলক্ষিত হয়, যা ইট কেটে তৈরি করা হয়েছে।

মন্দিরের পরিমাপ হল ৭.৯২ × ৭.৮১ বর্গ মিটার এবং পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মণ্ডপ প্রকোষ্ঠের দৈর্ঘ ও প্রস্থ যথাক্রমে ৭.৯২ মিটার ও ৭.৩১ মিটার, অপরদিকে গর্ভগৃহ প্রকোষ্ঠের দৈর্ঘ ও প্রস্থ যথাক্রমে ৬.১২ মিটার ও ২.২৮ মিটার। মন্দিরের উচ্চতা ৭.০১ মিটার। দেয়ালের নকশা ও কারুকার্যের ভিত্তিতে এটি কান্তনগর মন্দির-এর অনুরূপ স্থাপনা। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে মন্দিরটির বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[৩] বর্তমান বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে সংস্কারের কাজ করেছে।

শিল্পকর্ম[সম্পাদনা]

মন্দিরটি সাজানোর কেন্দ্রীয় বিষয় হল রামেররাবণের সেনাবাহিনীর মধ্যেকার যুদ্ধ। বর্তমানে বামদিকে ও কেন্দ্রীয় খিলানে খুব বেশি পোড়ামাটির ফলক অবশিষ্ট নেই। যাইহোক, পুরানো চিত্রগুলির সাথে তুলনা করলে দেখা যায় উভয় দল তীর-ধনুক, তলোয়ারবর্শা নিয়ে লড়াই করছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা ১৯৩০-এর দশকে তোলা চিত্র অনুসারে, কেন্দ্রীয় খিলানে স্থাপিত টেরাকোটা ফলকে রাবণকে রামের সেনাবাহিনীর দিকে তীর নিক্ষেপকারী দশানন হিসাবে দেখানো হয়েছিল।[৪]

মন্দিরের সম্মুখভাগের সর্বনিম্ন স্তরে টেরাকোটা শিল্পকর্মের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সর্বনিম্ন স্তরের বাম দিকে একটি শিকারের দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে, যেখানে একটি দলের নেতৃত্বে রয়েছে কুকুর এবং কুকুরগিলিক্র পুরুষেরা ঘোড়ায় চড়ে অনুসরণ করছে; পথের শেষে ঢোল বাজাচ্ছেন বাদ্যযন্ত্রীরা। একেবারে ডান কোণের ফলকে চিত্রিত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তার ভৃত্য হুক্কা প্রদান করছে। অন্য একটি ফলকে চিত্রিত হয়েছে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তার প্রিয়তমার প্রশংসা করছে।[৫]

গর্ভগৃহের খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বারের চারপাশের অলঙ্করণ হল একমাত্র স্থান যেখানে ফলকটি বিষ্ণুর বাহন গরুড় রূপে বিষ্ণুকে অ্যানিওনিক উপস্থাপনার মাধ্যমে চিত্রিত করে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি মন্দিরের বৈষ্ণব অধিভুক্তির দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। খিলানের স্প্যান্ড্রেল অংশে (উভয় পাশে) ৮ টি করে গরুড় ভাস্কর্য রয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলি তে দেখা যায় গরুড় হাত গুটিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে আছে, যা প্রধান দেবতার (বিষ্ণু) প্রতি শ্রদ্ধার চিহ্ন। গরুড় ছাড়াও, অন্যান্য যে আলংকারিকগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল সম্পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত পদ্ম ও জ্যামিতিক নিদর্শন।[৬]

চিত্রশালা[সম্পাদনা]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "জোড় বাংলা মন্দির - বাংলাপিডিয়া" 
  2. ওল্ডহ্যাম, আর.ডি. (১৮৯৯)। "Report of the great earthquake of 12th June, 1897"Memoirs of the Geological Society of India। K. Paul, Trench, Trübner & co.। ২৯ 
  3. "জোড় বাংলা মন্দির, পাবনা -Department of Archaeology-Government of the People's Republic of Bangladesh - প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার" 
  4. Mukhopadhyay 2012, পৃ. 106।
  5. Mukhopadhyay 2012, পৃ. 105।
  6. Mukhopadhyay 2012, পৃ. 108।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  • Mukhopadhyay, Tirtha Prasad, সম্পাদক (নভেম্বর ২০১২)। "Volume 2, Issue 1, Special Issue on the Temples of Bengal"The Chitrolekha Journal on Art and Design। Chitrolekha International Magazine on Art and Design। 2 (1)। আইএসএসএন 2231-4822। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০২৩Representation in Monument Building and Schematic of Terracotta Narratives: Delving into Some Aspects of Gopinath Jor-Bangla Temple, Pabna, Bangladesh