রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আর রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয মুহাম্মাদের একজন নারী সাহাবা ছিলেন। তিনি একজন হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবাও ছিলেন। তার পিতা ও চাচা বদরের যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছেন।

নাম ও বংশ পরিচয়[সম্পাদনা]

রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয মদিনার আদি ইবনে নাজ্জার গোত্রের মেয়ে। তার পিতার নাম মুয়াওবিয ইবনে আফরা এবং মাতার নাম উম্মে ইয়াজিদ বিনতে কায়স। তার দাদীর নাম আফরা বিনতে উবাইদে আল আনসারি এবং তার বোনের নাম ফুরাইয়া বিনতে মুয়াওবিয, যিনি একজন বিখ্যাত সাহাবা ছিলেন।[১] তার পিতা-চাচারা সবাই বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন।[২]

পরিবারের ইসলামী অবদান[সম্পাদনা]

রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিদের দাদী আফরা ইসলামের সূচনালগ্নেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুহাম্মাদ মদিনায় আসলে তাকে সর্বাত্নক সাহায্য করেন। আফরা দুইটি বিবাহ করেন এবং ৭টি সন্তানের জন্ম দেন, যারা সকলেই মদিনায় ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামের সেবায় আত্ননিয়োগ করেছিলেন।[৩][৪][৫] আফরা বিনতে উবাইদ প্রথম বিবাহ করেন হারিস ইবনে রিফা আন নাজ্জারীকে। এই সংসারে তার তিন ছেলের সকলেই পিতার নামে পরিচিত না হয়ে মায়ের নামে পরিচিটি লাভ করেছেন। তারা হলেন মুয়াওবিয, ইয়াস ও আকিল। এরপর বুকাইর ইবনে আবদি ইয়ালিল আল লায়সির সাথে সাথে রুবায়িয়ু দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এই সংসারে জন্মগ্রহণ করে চার ছেলে। তারা হলেন খালিদ, আমির, আওফ, মুয়ায। আফরা বিনতে উবাইদের এই ৭ ছেলে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেনন[৬] এবং দুইজন মৃত্যুবরণ করেছেন।[৭][৮] এরা সকলেই রুবায়িয়ুের চাচা ছিলেন। তার পিতা ও চাচা মুয়ায আকাবার প্রথম শপথে অংশগ্রহণ করেছেন। এই বদরের যুদ্ধেই রুবায়িয়ুর পিতা মুয়াওবিয ইবনে আফরা আবু জেহেলের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।[৯]

ইসলাম গ্রহণ[সম্পাদনা]

মুহাম্মাদ মদিনায় হিজরতের পূর্বেই কিশোরী অবস্থায় রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয ইসলাম গ্রহণ করেন। রুবায়িয়ুর মতো মদিনার কিশোর-কিশোরীরা ছড়া বলে মুহাম্মাদকে স্বাগতম বার্তা জানিয়েছিল,

‘আমরা বনু আন নাজ্জারের কিশোর-কিশোরী।

কি মজা! মুহাম্মাদ আমাদের প্রতিবেশী।’[১০]

জীবনী[সম্পাদনা]

রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিযের পরিবারের সাথে মুহাম্মাদের সুসম্পর্ক ছিল। উভয় পরিবারের মধ্যে উপহার বিনিময় চলতো। যেমন: রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয বর্ণনা করেছেন, আমার পিতা মুয়াওবিয ইবনে আফরা একটি পাত্রে এক সা‘ তাজা খেজুর ও তার উপর কিছু কচি শশা দিয়ে আমাকে মুহাম্মাদের নিকট পাঠান। কেননা নবী তাজা খেজুর ও কচি শশা পছন্দ করতো। সেই সময় বাহরাইন থেকে মুহাম্মাদ নিকট কিছু গহনা এসেছিল।[১১] তিনি তার থেকে কিছু গহনা নিয়ে আমাকে দেন।[১২][১৩][১৪][১৫]

রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিযের বিয়ে হয় বিখ্যাত মুহাজির সাহাবা ইয়াস ইবনে আল বুকাইর আল লায়সির সাথে। এই সংসারে জন্মগ্রহণ করে ছেলে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াস। তার বিয়ের দিন মুহাম্মাদ তার বাড়িতে গিয়ে রুবায়িয়ুর জন্য দোয়া করেন এবং দেখেন ছোট্ট শিশুরা দফ বাজিয়ে বাবা এবং চাচাদের যুদ্ধের প্রশংসামূলক গীত গাইতেছে।[১৬][১৭][১৮][১৯][২০] ইমাম আয যাহাবী বলেন, রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিযের বিয়েতে যাওয়ার কারণ ছিল হয়তো তার নিহত পিতা ও চাচাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য।[২১]

উমরের খিলাফতকালে[সম্পাদনা]

উমরের খিলাফতকালে তার পিতার হত্যাকারী আবু জাহেলের মা আসমা বিনতে মাখরামার নিকট আতর কিনতে চায় এবং শত্রুভাবাপন্ন হয়ে বিতর্কে জড়িয়ে যান এবং সেখান থেকে আতর না কিনেই ফিরে আসেন।[২২][২৩][২৪][২৫]

বিবাহ বিচ্ছেদ[সম্পাদনা]

৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বা ৩৫ হিজরিতে তার স্বামী ইয়াস ইবনে আল বুকাইরের সঙ্গে মনোমালিন্য ও কলহ সৃষ্টি হয়। রুবায়িয়ুর ইচ্ছা অনুসারে তার স্বামী তার থেকে সব কিছু নিয়ে নেয়।[২৬][২৭]

যুদ্ধে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

যুদ্ধের ময়দানে রুবায়িয়ু তার পিতার মত বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বেশ কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন, রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয মুহাম্মাদের সাথে জিহাদে যেতেন। আহতদের ঔষুধ সেবন এবং ক্ষত-বিক্ষতদের পানি পান করাতেন। তিনি নিজেই বলেছেন।[২৮][২৯]

৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় ১৪০০ সাহাবার মধ্যে তিনিও উপস্থিত ছিলেন, এবং সেই সময় সকলের সাথে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াতকে বাইয়াতে রিদওয়ান বলা হয়।

হাদিস বর্ণনা[সম্পাদনা]

তিনি হাদিস শোনার জন্য মাঝে মাঝে উম্মুল মুমিনিন আয়িশার নিকট যেতেন। রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয সর্বমোট ২১টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।[৩০] এর মধ্যে একটি হাদিস মুত্তাফাকুন আলাইহি[৩১] উঁচু স্তরের আলিম ও তাবেয়ী তার নিকট হাদিস বর্ণনা করেছেন।

একবার মুহাম্মাদ রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিযের বাড়িতে ওযু করেন। রুবায়িয়ু এটা দেখে পরবর্তীতে তা বর্ণনা করেন। এটা শোনার জন্য বহু মানুষ তার নিকট আসতেন।[৩৫][৩৬][৩৭]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

রুবায়িয়ু বিনতে মুয়াওবিয মৃত্যু সন সম্পর্কে অভিমত হচ্ছে, ইমাম যাহাবি বলেন, তিনি ৭০ হিজরির পরে আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের খিলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।[৩৮] অবশ্য কোন সূত্র হিজরী ৪৫ সনে তার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। আল্লামা আয যিরিকলি বলেছেন, তিনি মুয়াবিয়ার খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।[৩৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. [আল-ইসতী‘আব-৪/৩৭৫] 
  2. মুসলিম : ফী আল-জিহাদ (১৭৫২) 
  3. [ ফী আল-মাগাযী (৩৯৬৪ম ৩৯৮৮) ] 
  4. [বানাত আস-সাহাবা-৬৬] 
  5. সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-১/২৫০ 
  6. [সহীহ আল-বুখারী : ফী ফারদিল খুমুস (৩১৪১)] 
  7. [আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যা-১/৩৮৯] 
  8. [ আনসাব আল-আশরাফ-১/২৯৯ ] 
  9. [আল-ইসতিবসার-৬৬] 
  10. [নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-১৫০,১৫১] 
  11. ইবন মাজাহ (৩৩২৫) 
  12. [বুখারী, ফী আল-আত‘ইমা-৯/৪৯৫] 
  13. [মাজমা‘উ যাওয়ায়িদ লিল হায়ছামী-৯/১৩] 
  14. মুসলিম ফী আল-আশরিয়া (২০৪৩) 
  15. তিরমিযী (১৮৪৫) 
  16. [তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৬০৯] 
  17. [বুখারী ফী আন-নিকাহ (৫১৪৭)] 
  18. ফী আল-মাগাযী (৪০০১) 
  19. [তাবাকাত-৮/৩২৮] 
  20. [তিরমিযী-১০৯০] 
  21. [ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -৩/১৯৮ ] 
  22. [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-৩/১৯৯] 
  23. [আনসাব আল-আশরাফ-১/২৯৮] 
  24. [তাবাকাত-৮/৩০০.৩০১] 
  25. [আল-মাগাযী লিল ওয়াকিদী-১/৮৯] 
  26. [আল-ইসাবা-৪/২৯৪] 
  27. [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-৩/৩০০] 
  28. [সিফাতুস সাফওয়া-২/৭১] 
  29. [আত-তাজ আল-জামি’ লিল উসূল-৪/৩৪৪] 
  30. [বানাত আস-সাহাবা-১৬৭, ১৬৮] 
  31. [জাওয়ামি‘উ আস-সীরাহ্‌ আন-নাবাবিয়্যা-২৮২] 
  32. [আল-ইসতী‘আব -৪/৩০২] 
  33. তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪১৮ 
  34. [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/১৯৮] 
  35. [ইবন মাজাহ (৪১৮)] 
  36. আত-তিরমিযী: আত-তাহারাত (৩৩) 
  37. [আবূ দাঊদ : ফী আত-তাহারা-বাবু সিফাতি ওয়াদুয়িন নাবীয়ি্য ] 
  38. [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/৩০০] 
  39. [আল-আ‘লাম-৩/৩৯]