মোসাদ
গোয়েন্দা ও বিশেষ অভিযান সংস্থা המוסד למודיעין ולתפקידים מיוחדים الموساد للاستخبارات والمهام الخاصة | |
সংস্থার রূপরেখা | |
---|---|
গঠিত | ১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯ | (কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সংস্থা নামে)
সদর দপ্তর | তেল আবিব, ইসরায়েল |
কর্মী | গোপনীয় (আনু. ৭,০০০) |
বার্ষিক বাজেট | গোপনীয় (আনু. $২.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) |
সংস্থা নির্বাহী |
|
মূল সংস্থা | প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় |
ওয়েবসাইট | www |
মোসাদ (ইউকে: /ˈmɒsæd/, ইউএস: /moʊˈsɑːd/; হিব্রু ভাষায়: הַמּוֹסָד, IPA: [hamoˈsad]; আরবি: الموساد, প্রতিবর্ণীকৃত: al-Mōsād, আইপিএ: [almoːˈsaːd]; আক্ষ. 'সংস্থা'; পূর্ণনাম হিব্রু ভাষায়: המוסד למודיעין ולתפקידים מיוחדים, ha-Mosád le-Modiʿín u-le-Tafkidím Meyuḥadím, আক্ষ. 'গোয়েন্দা ও বিশেষ অভিযান সংস্থা') হল ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। আমান (সামরিক গোয়েন্দা) ও শিন বেতের (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) পাশাপাশি এটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান সংগঠন।
মোসাদ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, গোপন অভিযান ও সন্ত্রাসবাদ দমনে কাজ করে। এর পরিচালক সরাসরি এবং শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করেন। এর বার্ষিক বাজেট আনুমানিক প্রায় ১০ বিলিয়ন শেকেল ($২.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং অনুমান করা হয় যে, এটি প্রায় ৭,০০০ লোককে সরাসরি নিয়োগ করে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম গুপ্তচরবৃত্তি সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম।[১] মোসাদ অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা, যেমন: ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ইসরায়েল নিরাপত্তা সংস্থা থেকে ভিন্ন, কেননা এর উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ভূমিকা, কার্যভার, ক্ষমতা বা বাজেট কোনো আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়।
মোসাদের কাজের রিপোর্ট ও গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়।[২] এর নীতিমালা ও কার্যক্রম অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই৬ ও কানাডার সিএসআইএস এর অনুরূপ। মোসাদের হেডকোয়ার্টার তেলআবিবে।
ইসরাইলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলি যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা এবং দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধ করা, যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না, সেই সব দেশ থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করে ‘মোসাদ'।
সংস্থা
[সম্পাদনা]নির্বাহী অফিস
[সম্পাদনা]ইসরায়েলি সামরিক ও অসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের বাছাই করা কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালিত মোসাদের মোট আটটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি ডিপার্টমেন্টের কিছু তথ্য জানা যায় :
- কালেকশন ডিপার্টমেন্ট: এটি মোসাদের সবচেয়ে বড় বিভাগ। বহির্বিশ্বে ডিপ্লোম্যাট, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য ছদ্মবেশে কাজ করেন এই বিভাগের এজেন্টরা।[৩]
- পলিটিক্যাল অ্যাকশন এবং লিয়াজোঁ ডিপার্টমেন্ট: এ গ্রুপের কাজ প্রতিটি বন্ধুভাবাপন্ন দেশের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা।[৩]
- স্পেশাল অপারেশন ডিপার্টমেন্ট: এই গ্রুপকে গুপ্তহত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়।[২][৪]
- ল্যাপ ডিপার্টমেন্ট: এই গ্রুপ প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধের জন্য প্রচার চালায় ও শত্রু শিবিরে ভুল খবর ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
- রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট: যাবতীয় গোয়েন্দা গবেষণা ও 'কাউন্টার ইনটেলিজেন্স'-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির নিরন্তর কাজ করে চলেন এই গ্রুপের গবেষকরা।[৫]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]আরব লীগের প্রত্যাখানের মুখে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে দখলভূমিতে ইসরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ইউরোপে ইহুদী নিধনযজ্ঞ বা ‘শোয়া’র দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারে নি সেদেশের মানুষ৷ ফলে আরও একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছোট্ট এই ইহুদী রাষ্ট্র৷
রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ‘মোসাদ' প্রতিষ্ঠা করেন।[২] ডিসেম্বর ১৩, ১৯৪৯ সালে দ্য সেন্ট্রাল ইন্সিটিটিউট ফর করডিনেসন নামে মোসাদের কর্যক্রম শুরু হয় তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালের মার্চে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই যেসব ইহুদি নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালাচ্ছিল, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল, তাকে ‘মোসাদ' এর পূর্বসূরি বলা হয়। মোসাদ সামরিক সার্ভিস নয়। যওি অধিকাংশ কর্মকর্তাই ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের।[২]
১৯৪৯ সালে মোসাদের জন্ম হলেও ১৯৯৬ পর্যন্ত কেউই জানতো না এই সংস্থাটার প্রধানের কথা। ১৯৯৬ সালে যখন সাবতাই কে অপসারন করে ডেনি ইয়াতমকে নিয়োগ দেওয়া হয় এক ঘোষণার মাধ্যমে, তখন প্রথমবারের মত বিশ্ববাসী জানতে পারে এই সংস্হাটার প্রধান কে। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২৮তম কম্যুনিস্ট সম্মেলনে যখন নিকিটা ক্রুশ্চেভ এক গোপন মিটিংয়ে 'স্টালিনকে' অভিযুক্ত ও অস্বীকার করে নিজেই প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করে, ঐ বক্তব্যের এক কপি মোসাদ সিআইএর হাতে দিয়ে দেয়। এই প্রথম সিআইএ মোসাদের কার্যক্রম উপলব্ধি করে যাতে সিআইএ অভিভূত হয়। কারণ সিআইএর মত সংস্থাটিও এই রকম একটা স্পর্শকাতর সংবাদ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিল।
পরিচালক
[সম্পাদনা]- রিউভেন শিলোয়াহ : দায়িত্বকাল- ১৯৫১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ১৯৫২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। মোসাদ প্রতিষ্ঠার আগে তিনি দ্য সেন্ট্রাল ইন্সিটিটিউট ফর করডিনেসন-এর ডিরেক্টর ছিলেন।
- ইসার হারেল : দায়িত্বকাল- ১৯৫২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত।
- মীর অমিত : দায়িত্বকাল- ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত।
- ভি যামির : দায়িত্বকাল- ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত।
- ঈঝাক হোফি : দায়িত্বকাল- ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত।
- নাহুম আদমনি : দায়িত্বকাল- ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত।
- শাবতাই শাভিত : দায়িত্বকাল- ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত।
- দানি ইয়াতুম : দায়িত্বকাল- ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।
- ইফরাইম হেলভি : দায়িত্বকাল- ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত।
- মেয়ার দাগান : দায়িত্বকাল- ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত।
- তামির পারদো : দায়িত্বকাল- ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।[৬]
- ইয়োসি সোয়েন : ২০১৬ সাল - ২০২১ সাল।
- ডেভিড বার্নে : ২০২১ সাল - বর্তমান। [৭]
বিভিন্ন দেশে মোসাদের কার্যক্রম ও অপারেশনের অভিযোগ
[সম্পাদনা]দক্ষিণ আমেরিকা
[সম্পাদনা]অনেকদিন থেকে নাযি ওয়ারে অভিযুক্ত এডল্ফ ইচম্যানকে খুজছিল মোসাদ। ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় তার খোঁজ পাওয়া যায়। ওই বছরের ১১মে মোসাদের এজেন্টদের একদল টিম তাকে গোপনে আটক করে ইসরাইল নিয়ে আসে। আর এ কথা আর্জেন্টিনার সরকার নিজেও জানত না। তার বিরুদ্ধে উত্তর ইউরোপে ক্যাম্প গঠন ও পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ইহুদিদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ইসরাইলের আদালতে একটি সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একই অভিযোগে জোসফ মেনজেলকে আটকের চেষ্টা ব্যার্থ হয়। ১৯৬৫ সালে নাযি ওয়ারে অভিযুক্ত লাটভিয়ার বৈমানিক হার্বার্টস কুকার্সকে উরুগুয়ে থেকে ফ্রান্স হয়ে ব্রাজিল যাওয়ার পথে মোসাদের এজেন্টরা হত্যা করে। ১৯৭৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কুটনৈতিক এবং চিলির প্রাক্তন মন্ত্রী অরল্যান্ডো লেটেলারকে ওয়াশিংটন ডিসিতে গাড়ি বোমায় হত্যা করে চিলির ডিআইএনএ’র এজেন্টরা। পরবর্তীতে জানা যায়, এটি ছিল মোসাদের একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তার সাথে তার সহকারী রনি কার্পেন মোফিট্টও খুন হন। রনি কার্পেন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
পশ্চিম ইউরোপ
[সম্পাদনা]১৯৬০ সালে ফ্রান্সের মিরাজ ফাইভ জেড বিমানের প্রযুক্তিগত দিকের বিভিন্ন দলিল চুরি করে নেয় মোসাদ। পরে ইসরাইল ওই প্রযুক্তিকে আরো উন্নত ও যেকোনো আবহাওয়ার উপযোগি করে জে৭৯ নামের ইলেক্ট্রিক টার্বোজেট ইঞ্জিন তৈরি করে। ফ্রান্স শিপইয়ার্ডে পাঁচটি মিসাইল বোট দিতে ফ্রান্সের সাথে চুক্তি করে ইসরাইল। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ফ্রান্সে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার আগে ইচ্ছাকৃতভাবে মিসাইল বোট সরবরাহ করেনি মোসাদ। ১৯৬৮ সালের একটি ঘটনা। ইসরাইলের একটি শিপে ২০০টন ইউরেনিয়াম অক্সাইড সরবরাহ করতে একটি কার্গো বিমান যাত্রা শুরু করেছিল। জার্মানি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিমানটি তাদের রাডারের বাইরে চলে যায়। পরে তুরস্কের একটি পোর্টের রাডারে এটি ধরা পড়লে ওই কার্গো বিমান থেকে বলা হয় পথ হারিয়ে তারা এদিকে চলে এসেছে এবং তাদের জ্বালানী ফুরিয়ে গেছে। গালফ থেকে জ্বালানী নিয়ে তারা আবার ফিরে যাবে। পরে তার নিরাপদে ওই ইউরেনিয়াম অক্সাইড ইসরাইলের একটি শিপে খালাস করে। এটি ছিল রেকেম ও মোসাদের একটি যৌথ অপারেশন। এটি অপারেশন প্লামব্যাট নামে পরিচিত। ইউরেনিয়াম অক্সাইড পারমাণবিক বোমার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭২ সালে মোসাদ জার্মানীর বিভিন্ন টার্গেট ব্যক্তির কাছে পত্র বোমা পাঠিয়েছিল। চিঠি খুললেই বোমা ফুটবে এবং সে মারা যাবে। অধিকাংশ চিঠিই পাঠানো হয়েছিল নাযি যুদ্ধে অভিযুক্ত এলোস ব্রানারের কাছে। অবশ্য মোসাদের এ প্রচেষ্টা জানাজানি হয়ে যায় এবং ব্যর্থ হয়।
পূর্ব ইউরোপ
[সম্পাদনা]যুদ্ধের সময় বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়ার রাজধানী সারাজেভো থেকে বিমান ও স্থলপথে ইহুদিদের ইসরাইলে স্থানান্তর করা হয় মোসোদের পরিকল্পনায়।
মিশর ও সিরিয়া
[সম্পাদনা]১৯৫৭ সালে মিশরে ওলফগ্যাং লজের নেতৃত্বে গোয়েন্দা মিশন পাঠায় মোসাদ। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি মিশরে গামাল আবদেল নাসেরের সামরিক বাহিনী ও তার যুদ্ধোপকরণ ও কৌশল জানতে গোয়েন্দা তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৪ সালে লজের চেয়ে বড় মিশন নিয়ে মিশরে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করেন মোসাদের আর এক স্পাই এলি কোহেন। তার সহযোগিতায় ছিল হাই প্রোফাইলের বেশ কয়েকজন স্পাই। এলি কোহেন ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে সিরিয়ায় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে তথ্য পাঠানোর সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হন। মিশর ও সিরিয়ায় মোসাদ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও লিঙ্ক স্থাপন করেছিল। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইলের বিপক্ষে ছিল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়া। এই যুদ্ধটি সিক্স-ডে ওয়ার নামে পরিচিত। যুদ্ধ শেষ হলেও এর রেশ ছিল দীর্ঘ দিন। ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই মিশরের ছোট দ্বীপ গ্রিন আয়ল্যান্ডে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স আকস্মিক হামলা চালায়। মোসাদ এই অভিযানের নাম দেয় অপারেশন বালমাস সিক্স। পরবর্তীতে অনেক ইসরাইলী ইহুদি ও পর্যটকরা সিনাই হতে মিশর আসে অবকাশ যাপনের জন্য। মোসাদ নিয়মিত এসব পর্যটকদের নিরাপত্তা দেখভালের জন্য গোয়েন্দা পাঠাত। ধারণা করা হয় এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ইরান
[সম্পাদনা]ইসরাইল ইরানকে বড় ধরনের হুমকি মনে করে। ফলে মোসাদের তৎপরতা ইরানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ড. আরদেশির হোসেনপুরকে হত্যা করে মোসাদ। মৃত্যুর ছয় দিন পর আল কুদস ডেইলি তার নিহতের খবর প্রচার করে। প্রথম দিকে তিনি গ্যাস বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সে দেশের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। ওয়াশিংটনের প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্রাটফোর হোসেনপুরকে মোসাদের টার্গেট ছিল বলে উল্লেখ করে। অবশ্য মোসাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। হোসেনপুর ছিলেন ইরানের একজন জুনিয়র সহকারী অধ্যাপক। ২০০৩ সাল থেকে ইরানে মোসদের হয়ে কাজ করতেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী রেজা আসগারি। তিনি মোহাম্মদ খাতামী প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ইরানের সহকারী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাকে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাননি।
ইরাক
[সম্পাদনা]সিআইএ’র সহায়তায় ইরাকে বাথ পার্টির শীর্ষনেতা আরিফ রহমান ও পরবর্তীকালে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় আসলেও ইরাককে বিশ্বাস করত না ইসরাইল। এজন্য ইরাকে ইসরাইলের গোয়েন্দা তৎপরতার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ইরাকে সিআইএ মোসাদের সহযোগি হিসেবে কাজ করেছে। ইরাকে অনেকগুলো বড় অপারেশন চালায় মোসাদ। এর একটি হচ্ছে ১৯৬৬ সালে। মিগ-২১ জঙ্গী বিমানের পাইলট ছিলেন খৃস্টান বংশদ্ভূত মুনির রেদফা। ১৯৬৬ সালে তাকে বিমানসহ কৌশলে ইরাক থেকে ইসরাইল নিয়ে আসে মোসাদ। তার কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ব্যবহার করা হয় ইরাক বিরোধী প্রচারণায়। সংবাদ সম্মেলন করে ইরাকে খৃস্টান নিধনের প্রচারণাও চালানো হয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইরাকের অসরিক নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর’র (নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদনের জন্য যন্ত্রবিশেষ) স্পর্শকাতর কিছু বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায়। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন স্ফিঙকস। ইরাক এই গবেষণা সম্পন্ন করতে পারলে পারমাণবিক গবেষণায় বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে অগ্রবর্তী থাকত। মোসাদ মনে করেছিল এখনই যদি এই প্রোগ্রাম ধ্বংস করা না হয় তাহলে শিগগিরই গবেষণা সেন্টারে পারমাণবিক অস্ত্রের কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে। এজন্য ১৯৮১ সালের ১৭ জুন এফ-১৬এ যুদ্ধ বিমানে বিপুল গোলাবারুদসহ একটি ইউনিটকে পাঠানো হয় ইরাকের এই প্রকল্প ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। ইরাক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোমা হামলা করে অসরিক নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর’র ব্যাপক ক্ষতি করে। ইরাক পরে আর এ প্রকল্পটি অব্যাহত রাখতে পারেনি। এই হামলাটি অপারেশন অপেরা নামে পরিচিত। কানাডার বিজ্ঞানী গিরাল্ড বুল বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইট গবেষণায় কাজ করতেন। ইরাক স্যাটেলাইট উন্নয়ন প্রোগ্রাম ‘প্রোজেক্ট ব্যবিলন’-এর ডিজাইন করলে তাকে ১৯৯০ সালের ২২ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে তার বাড়ির বাইরে গুলি করে হত্যা করে মোসাদ।
ইতালী
[সম্পাদনা]ইসরাইলের পারমাণবিক প্রোগ্রামের গোপন তথ্য বৃটিশে পাচার করার কারণে ১৯৮৬ সালে ইতালির রাজধানী রোম থেকে ইসরাইল নাগরিক মোডাচাই ভ্যানুনুকে অপহরণ করে ইসরাইল নিয়ে আসে মোসাদ। পরে তাকে জেলে ঢুকানো হয়। ১৮ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয় তাকে।
ফিলিস্তিন
[সম্পাদনা]১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনে এক নয়া গ্রুপ গড়ে উঠে ব্লাক সেপ্টেম্বর নামে। জার্মানির মিউনিখে অলিম্পিক গেমস চলাকালে এরা ১১ জন ইসরাইলী এথলেটকে কিডন্যাপ করে। ২০০ ফিলিস্তিনির মুক্তি ও নিজেদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া ছিলো ওদের দাবী। জার্মান সরকার মেনে নেয় এবং চুক্তির জন্য মিলিটারি এয়ারপোর্টে আসতে বলে।মিলিটারি এয়ারপোর্টে জার্মান এয়ারফোর্স কমান্ডোরা আগে হতেই প্রস্তুত ছিলো। অপহরনকারীরা যখনই বুঝতে পারে ওদের ফাদে ফেলা হয়েছে তখনই সব বন্দী এথলেটদের হত্যা করা হয়। পুলিশের পাল্টা গুলিতে ৫ জন অপহরনকারী নিহত ও তিন জন বন্দী হয়। ঘটনাটি ছিলো অতি ভয়াবহ। মোসাদ স্পেশাল টিম গঠন করে অপারেশান রথ অফ গড ঘোষণা করে। পুরো ইউরোপ জুড়ে ব্লাক সেপ্টেমবর গ্রুপকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়।৭২ হতে ৭৩ পর্যন্ত এই গুপ্তহত্যার কাজ চলতে থাকে। ব্লাক সেপ্টেম্বরের প্রধান নেতা আলি হাসান সালামেহকে বৈরুতে হত্যা করা হয়। পিএলওর নেতারা প্রায় দিশা হারাবার উপক্রম। ইউরোপ জুড়ে মোসাদের এই হান্টিং ডাউনে ভুলক্রমে নরওয়েতে এক নিরীহ মরোক্কান ওয়েটারকে হত্যা করে ফেলে মোসাদ।নরওয়ের পুলিশ ৬ মোসাদ এজেন্টকে গ্রেফতার করে।
মোসাদের কিছু সফল অপারেশন
[সম্পাদনা]মোসাদের কিছু ব্যর্থ অপারেশন
[সম্পাদনা]১৯৮০ হতে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মোসাদ দুর্দান্ত আকারে পিএলও এর নেতাদের হত্যা করে। পিএলও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে। অন্যদিকে হামাসের উত্থান হতে থাকে। খালিদ মিশাল তখন হামাসের সংগ্রামী নেতা, তাকে অনেক বড় হুমকি হিসেবে দেখে মোসাদ। ১৯৯৭ সালে খালিদ তার গাড়ি হতে নেমে হামাস অফিসে ঢুকার সময়ে হাতে ব্যান্ডেজ লাগানো তিন জন কানাডীয় টুরিস্ট তার গাড়ির পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। একজন টুরিষ্ট(মোসাদের স্পাই) হঠাৎ খালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কানের নিচে একটা পুশ করে বিষ ঢেলে দেয়। তখন হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। খালিদের অবস্হা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে, ধারণা করা হয়েছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি মারা যাবেন। জর্ডানের সাথে হামাস ও ইসরাইলের সুসম্পর্ক ছিলো তখন। জর্ডানের বাদশাহ হোসাইন তখন সরাসরি ফোন করে নেতানিয়াহুকে। বাদশা হুমকি দেয়, যদি খালিদ মিশাল মারা যায় তাহলে তিন মোসাদ স্পাইকে খুন করা হবে, এবং ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি বাতিল হবে। তখন মোসাদের সতর্ক হয়ে উঠে। মোসাদের চীফ নিজেই ল্যাবরেটরীতে মডিফাই করা বিষের প্রতিষোধক নিয়ে আম্মানে আসেন। প্রতিষোধক পেয়ে খালিদ মিশাল সুস্হ হয়ে উঠেন। এই ব্যর্থ হামলার ফলাফল এমনই করুন ছিলো যে, মোসাদের চীফকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। খালিদ মিশালের উপর এই হামলায় কানাডার গোয়েন্দা সংস্হা (csis) ও জড়িত আছে বলে মনে করা হয়।
আরো পড়ুন
[সম্পাদনা]- Dan Raviv and Yossi Melman. Spies Against Armageddon: Inside Israel's Secret Wars. Sea Cliff: Levant Books, 2012. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৯৮৫৪৩৭৮-৩-১.
- Ari Ben-Menashe. Profits of War: Inside the Secret U.S.-Israeli Arms Network. New York: Sheridan Square Press, 1992. আইএসবিএন ১-৮৭৯৮২৩-০১-২. ওসিএলসি 26586922.
- Black, Ian and Benny Morris. Israel's Secret Wars: A History of Israel's Intelligence Services. New York: Grove Weidenfeld, 1991. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮০২১-৩২৮৬-৪. ওসিএলসি 249707944.
- Central Intelligence Agency. Israel: Foreign Intelligence and Security Services: A Survey. Washington, D.C., 1979. (Included in Documents from the US Espionage Den. Tehran: Center for the Publication of the US Espionage Den's Documents, 1982.)
- Jonas, George. Vengeance: The True Story of an Israeli Counter-Terrorist Team. New York: Simon and Schuster, 1984. আইএসবিএন ০-৬৭১-৫০৬১১-০. ওসিএলসি 10507421.
- Victor Ostrovsky. By Way of Deception: The Making and Unmaking of a Mossad Officer. New York: St. Martin's Press, 1990. আইএসবিএন ০-৯৭১৭৫৯৫-০-২. ওসিএলসি 52617140.
- Ostrovsky, Victor. The Other Side of Deception: A Rogue Agent Exposes the Mossad's Secret Agenda. New York: HarperCollins Publishers, 1994. আইএসবিএন ০-০৬-০১৭৬৩৫-০. ওসিএলসি 30972282.
- Parsi, Trita. Treacherous Alliance: The Secret Dealings of Israel, Iran, and the United States. New Haven: Yale University Press, 2007. আইএসবিএন ০-৩০০-১২০৫৭-৫, আইএসবিএন ০-৩০০-১৪৩১১-৭. ওসিএলসি 124164797.
- Eric Frattini. Mossad, los verdugos del Kidon. Madrid: Atanor Ediciones, 2011. আইএসবিএন ৯৭৮-৮৪-৯৩৮৭১৮-৬-৪
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Levinson, Chaim (২০১৮-০৮-২৬)। "A Golden Age for the Mossad: More Targets, More Ops, More Money"। Haaretz। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০২।
- ↑ ক খ গ ঘ ফের আলোচনায় কুখ্যাত মোসাদ,কালের কন্ঠ
- ↑ ক খ Mossad profile, Global Security. Retrieved March 24, 2013.
- ↑ মোসাদ: গুপ্তহত্যার লাইসেন্সওয়ালা পর্যটকরা এখানেই থামবে না
- ↑ the Mossad profile, Federation of American Scientists. Retrieved March 24, 2013.
- ↑ "Israel's new head of Mossad"। Liveshots.blogs.foxnews.com। নভেম্বর ২৯, ২০১০। ১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৪, ২০১৩।
- ↑ "Director"। mossad.gov.il। অজ্ঞাত। Archived from the original on নভেম্বর ১৩, ২০২২। সংগ্রহের তারিখ November 13, 2022। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য)