অনুঘটন
রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাহ্যিক কোন পদার্থের উপস্থিতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাকে অণুঘটন বলে এবং ঐ বাহ্যিক পদার্থকে প্রভাবক বা অণুঘটক বলে।[১] অণুঘটকের উপস্থিতিতে বিক্রিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তির (সক্রিয়ন শক্তি ইংরেজিঃ activation energy) পরিমাণ কমে যায় এবং ফলস্বরূপ বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। অণুঘটক বিক্রিয়ার পরে অপরিবর্তিত থাকে।[১]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]১৭৯৪ সালে রসায়নবিদ এলিজাবেথ ফুলহেম অণুঘটকের ধারণা প্রথম প্রয়োগ করেন তার লেখা বইয়ে।[২] এরপর ১৮৩৫ সালে আরেক রসায়নবিদ জন্স জেকন ব্রাজিলিয়াস অণুঘটকের কথা উল্লেখ করেন।[৩] এদের ছাড়াও ১৮শ শতাব্দী আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী অণুঘটকের ওপর কাজ করে গেছেন। বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি প্রথম প্ল্যাটিনামকে অণুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেন।[৪] ১৮৮০ সালের দিকে বিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ উইলহেল্ম অসওয়াল্ড অণুঘটকের ওপর নিয়মানুগ বিশ্লেষণ শুরু করেন।[৫]
শ্রেণিবিভাগ
[সম্পাদনা]অণুঘটক এবং অণুঘটন প্রধানত চার প্রকারের হয়ে থাকে।[৬]
ধনাত্মক অণুঘটক এবং অণুঘটন
[সম্পাদনা]যে অণুঘটকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায় তাকে ধনাত্মক অণুঘটক এবং ঐ প্রক্রিয়াকে ধনাত্মক অণুঘটন বলে। উদাহরনঃ পরিক্ষাগারে অক্সিজেন প্রস্তুতির সময় পটাশিয়াম ক্লোরেটের সাথে ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড ধনাত্মক অণুঘটক হিসেবে কাজ করে।
ঋনাত্মক অণুঘটক এবং অণুঘটন
[সম্পাদনা]যে অণুঘটকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি হ্রাস পায় তাকে ঋনাত্মক অণুঘটক এবং ঐ প্রক্রিয়াকে ঋনাত্মক অণুঘটন বলে। উদাহরনঃ সোডিয়াম সালফাইড বায়ুর অক্সিজেন দ্বারা জারিত হওয়ার সময় গ্লিসারিন ঋনাত্মক অণুঘটকের কাজ করে।
স্বপ্রভাবক ও স্বপ্রভাবন
[সম্পাদনা]কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থ যদি ঐ বিক্রিয়াতে অণুঘটকের কাজ করে তখন সেই উৎপন্ন পদার্থকে স্বপ্রভাবক ও ঐ প্রক্রিয়াকে স্বপ্রভাবন বলে। যেমন, পারম্যাঙ্গানেটকে অ্যাসিড দ্রবনে যোগ করলে শুরুতে পারম্যাঙ্গানেটের বর্ণ ধীরে ধীরে অন্তর্নিহিত হতে থাকে এবং পরে এই প্রক্রিয়ার বেগ বৃদ্ধি পায়। কারণ, শুরুতে পারম্যাঙ্গানেটের সঙ্গে অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় ম্যাঙ্গানিজ আয়ন (Mn+) স্বপ্রভাবক রূপে কাজ করে।
আবিষ্ট অণুঘটক এবং অণুঘটন
[সম্পাদনা]একটি বিক্রিয়ার প্রভাবে অন্য আরেকটি বিক্রিয়কের ক্রিয়া প্রভাবিত হলে প্রক্রিয়াটিকে আবিষ্ট অণুঘটন বলে। যেমন, সোডিয়াম সালফাইট দ্রবণ এবং সোডিয়াম আর্সেনাইট দ্রবণ কেউই পৃথকভাবে অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয় না। কিন্তু এই দুই লবণের মিশ্র দ্রবণ অক্সিজেন কর্তৃক জারিত হয়।
সমসত্ত্ব ও অসমসত্ত্ব অণুঘটন
[সম্পাদনা]অণুঘটক কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয়, এই তিন অবস্থাতেই বিরাজমান হতে পারে। বিক্রিয়ক এবং অণুঘটকের ভৌত অবস্থার ওপর নির্ভর করে অণুঘটন এবং অণুঘটককে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ
সমসত্ত্ব অণুঘটক এবং অণুঘটন
[সম্পাদনা]যখন বিক্রিয়ক এবং অণুঘটকের ভৌত অবস্থা একই হয় তখন সেই বিক্রিয়াকে সমসত্ত্ব অণুঘটন এবং ঐ অণুঘটককে সমসত্ত্ব অণুঘটক বলে। যেমন, কার্বক্সিলিক অ্যাসিড থেকে এস্টার তৈরীর সময় দ্রবীভূত H+ সমসত্ত্ব অণুঘটকের কাজ করে।[৭]
অসমসত্ত্ব অণুঘটক এবং অণুঘটন
[সম্পাদনা]যখন অণুঘটকের ভৌত অবস্থা বিক্রিয়কের ভৌত অবস্থার থেকে পৃথক হয় তখন সেই বিক্রিয়াকে অসমসত্ত্ব অণুঘটন এবং ঐ অণুঘটককে অসমসত্ত্ব অণুঘটক বলে। যেমন, হেবার বস পদ্ধতিতে কঠিন লোহার টুকরো ব্যবহার করা হয় নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরীর সময়।[৮]
কর্ম পদ্ধতি
[সম্পাদনা]সমসত্ত্ব এবং অসমসত্ত্ব অণুঘটক এর কর্ম পদ্ধতি পৃথক হয়।
সমসত্ত্ব অণুঘটকের ক্ষেত্রে অণুঘটক সাধারনত যে কোন এক বা একাধিক বিক্রিয়কের সাথে বিক্রিয়া করে একটি মধ্যবর্তী অস্থায়ী যৌগ (ইন্টারমিডিয়েট, intermediates) তৈরী করে। পরে সেই মধ্যবর্তী অস্থায়ী যৌগ নিজে বিয়োজিত হয়ে অথবা অন্য বিক্রিয়কের সাথে বিক্রিয়া করে মূল বিক্রিয়াজাত পদার্থ উৎপন্ন করে এবং বিক্রিয়ার শেষে অণুঘটক অপরিবর্তিত থাকে। যেমন,
ক + খ → গ এই বিক্রিয়ায় যদি "অ" অণুঘটক ব্যবহার করা হয় তবে নিম্নরূপ চারটি ধাপের মধ্যে দিয়ে "গ" পদার্থ উৎপন্ন হবে।[৯]
ক + অ → কঅ (১)
খ + কঅ → কখঅ (২)
কখঅ → গঅ (৩)
গঅ → গ + অ (৪)
অন্যদিকে অসমসত্ত্ব অণুঘটনের ক্ষেত্রে বিক্রিয়ক এবং অণুঘটকের ভৌত অবস্থা পৃথক হওয়ায় কর্ম পদ্ধতি সামান্য আলাদা হয়। অণুঘটক যদি কঠিন পদার্থ হয় তাহলে নিম্ন লিখিত ভাবে বিক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়ঃ
(১) প্রথমে অণুঘটকের পৃষ্ঠতলে একটি বিক্রিয়কের অণুগুলি রাসায়নিকভাবে অধিশোষিত হবে।
(২) ফলস্বরূপ অণুঘটকের পৃষ্ঠতলের সাথে বিক্রিয়কের অণুগুলির এক ধরনের বন্ধনের সৃষ্টি হয় এবং অণুর অধিশোষিত প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।
(৩) এরপর অন্য বিক্রিয়ক অণু সহজেই অধিশোষিত বিক্রিয়ক অণু্র দূর্বল প্রান্তে আঘাত করে বন্ধনটিকে সহজেই ভেঙ্গে ফেলতে পারে এবং বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। সব শেষে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থ অণুঘটকের পৃষ্ঠতল থেকে মুক্ত হয়।
যেমন, পার্শ্ববর্তী চিত্রে দেখানো হয়েছে প্রথমে অণুঘটক পৃষ্ঠে হাইড্রোজেনের অধিশোষনের ফলে হাইড্রোজেন অণু ভেঙ্গে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে পরিনত হয়েছে হয়েছে। পরে ইথিনের অণু অণুঘটক পৃষ্ঠে আসাতে একটি পরমাণু একটি কার্বনের সাথে যুক্ত হয়েছে। পরে আরো একটি হাইড্রোজেন পরমাণু অন্য কার্বনের সাথে যুক্ত হয় এবং ইথেন প্রস্তুত হয়।
অণুঘটক সহায়ক ও অণুঘটক বিষ
[সম্পাদনা]যে সব পদার্থ কোন বিক্রিয়ায় অণুঘটক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হয় না কিন্তু কোন অণুঘটকের সাথে উপস্থিত থেকে সেই অণুঘটকের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাদের অণুঘটক সহায়ক (Promoters) বলে। যেমন, হেবার বস পদ্ধতিতে অণুঘটক লোহার সাথে অল্প পরিমাণ মলিবডিনাম (Mo) বা অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (অ্যালুমিনা, Al2O3) থাকলে বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। অণুঘটক সহায়ক সাধারনত বিক্রিয়কের অণুঘটকের পৃষ্ঠতলে অধিশোষিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়।
যে সকল পদার্থ কোন বিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকলে অণুঘটকের ক্ষমতা হ্রাস এমনকি লোপ পেয়ে যায় তাদের অণুঘটক বিষ (catalyst poison) বলে। ধূলিকণা, গন্ধক, আর্সেনিক অক্সাইড ইত্যাদি অনেক বিক্রিয়ায় অণুঘটক বিষ হিসেবে কাজ করে। যেমন, সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুতির সময় প্ল্যাটিনামের উপস্থিতিতে সালফার ডাই অক্সাইডের জারনের সময় সামান্য আর্সেনিক অক্সাইড উপস্থিত থাকলে বিক্রিয়ার গতি হ্রাস পেয়ে যায়।
ব্যবহার
[সম্পাদনা]শিল্প ক্ষেত্রে অণুঘটকের ব্যবহার অপরিসীম, তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবহার নিম্ন লিখিতঃ[১০][১১]
শিল্প | বিক্রিয়া | অণুঘটক |
---|---|---|
সালফিউরিক এসিড উৎপাদন | 2SO2 + O2 → 2SO3 | প্ল্যাটিনাম বা ভ্যানাডিয়াম অক্সাইড |
অ্যামোনিয়া প্রস্তুতি (হেবার বস পদ্ধতি) | N2 + 3H2 →2 NH3 | লোহা |
নাইট্রিক এসিড প্রস্তুতি | NH3 + O2 → HNO3 | প্ল্যাটিনাম |
মিথানল প্রস্তুতি | CO + 2H2 → CH3OH | জিঙ্ক অক্সাইড |
ইথানল প্রস্তুতি | C6H12O6 → 2C2H5OH + 2CO2 | জাইমেজ |
ভিনেগার প্রস্তুতি | C2H5OH + O2 → CH3COOH + H2O | অ্যাসিটো ব্যাক্টার ব্যাক্টেরিয়া |
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ IUPAC. "catalyst" in Compendium of Chemical Terminology, 2nd ed. (the "Gold Book"). Compiled by A. D. McNaught and A. Wilkinson. Blackwell Scientific Publications, Oxford (1997). ISBN 0-9678550-9-8. doi:10.1351/goldbook
- ↑ Rayner-Canham, Marelene; Rayner-Canham, Geoffrey William (January 2001). Women in Chemistry: Their Changing Roles from Alchemical Times to the Mid-Twentieth Century. American Chemical Society. ISBN 9780841235229
- ↑ Berzelius, J. J. (1835) Årsberättelsen om framsteg i fysik och kemi [Annual report on progress in physics and chemistry]. Stockholm, Sweden: Royal Swedish Academy of Sciences. After reviewing Eilhard Mitscherlich's research on the formation of ether, Berzelius coins the word katalys (catalysis) on page 245:
- ↑ Davy, Humphry (1817). "Some new experiments and observations on the combustion of gaseous mixtures, with an account of a method of preserving a continued light in mixtures of inflammable gases and air without flame". Philosophical Transactions of the Royal Society of London. 107: 77–85. doi:10.1098/rstl.1817.0009.
- ↑ Roberts, M.W. (2000). "Birth of the catalytic concept (1800–1900)". Catalysis Letters. 67 (1): 1–4. doi:10.1023/A:1016622806065
- ↑ [১] এডুকেশানপিডিয়া অফ বাংলাদেশ
- ↑ "mechanism for the esterification reaction"। www.chemguide.co.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৮-০৯।
- ↑ "The Haber Process for the manufacture of ammonia"। www.chemguide.co.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৮-০৯।
- ↑ Matthiesen J, Wendt S, Hansen J, Madsen GK, Lira E, Galliker P, Vestergaard EK, Schaub R, Laegsgaard E, Hammer B, Besenbacher F (2009). "Observation of All the Intermediate Steps of a Chemical Reaction on an Oxide Surface by Scanning Tunneling Microscopy". ACS Nano. 3 (3): 517–526. doi:10.1021/nn8008245. ISSN 1520-605X. PMID 19309169
- ↑ Chotani, Gopal K.; Gaertner, Alfred L.; Arbige, Michael V.; Timothy C. Dodge (2007). "Industrial Biotechnology: Discovery to Delivery". Kent and Riegel's Handbook of Industrial Chemistry and Biotechnology. Springer. pp. 32–34. ISBN 978-0-387-27842-1.
- ↑ Zhen Ma, Francisco Zaera "Heterogeneous Catalysis by Metals" in Encyclopedia of Inorganic Chemistry, 2006, John Wiley. doi:10.1002/0470862106.ia084